তিন দিনেই বানানো যাবে যে বাড়ি

বিশাল সবুজ মাঠের এখানে–সেখানে কয়েকটি দলে ভাগ হয়ে কাজ করছেন একদল তরুণী। কেউ বাঁশ কেটে ফালি করে রাখছেন। কয়েকজন বুনছেন বেত। কারও হাতের রংতুলির ছোঁয়ায় খেজুরপাতার পাটিতে স্পষ্ট হয়ে উঠছে নারীর অবয়ব। কেউ বানাচ্ছেন আটকোনা বাঁশের ছাদ।

আপনি যদি ১৮, ১৯ বা ২০ ফেব্রুয়ারির যেকোনো এক দিন রাজধানীর আগারগাঁওয়ে ইনস্টিটিউট অব আর্কিটেক্টস, বাংলাদেশের (আইএবি) ভবনটিতে উপস্থিত হতেন, চোখে পড়ত এমন দৃশ্য।

বাঁশ দিয়ে তৈরি হচ্ছে বাড়ি

কিন্তু এখানে হচ্ছেটা কী

ইয়াসমিন লারি, পাকিস্তানের সেরা স্থপতিদের ভেতর একেবারে প্রথম সারিতে থাকবে এই নাম। ৩০ বছর ধরে তিনি পাকিস্তানের বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে দরিদ্র নারীদের কম সময়, শ্রম আর কম খরচে, প্রাকৃতিক উপাদানে টেকসই ঘর, চুলাসহ জীবনযাপনের জন্য জরুরি নানা কিছু বানাতে শেখান। সেসব তৈরিতে কারখানার কিছু নয়, বরং হাতের কাছেই পাওয়া যায়—এমন প্রাকৃতিক উপাদান ব্যবহার করা হয়। ফলে এ নির্মাণপ্রক্রিয়ায় কোনো কার্বন নিঃসৃত হয় না। তিনিই প্রথম বাংলাদেশের ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগের চেয়ারম্যান জায়নাব ফারুকী আলীর সঙ্গে বাংলাদেশেও এ রকম ঘর নিয়ে কাজ করার প্রস্তাব দেন। ধারণাটি জায়নাবেরও মনে ধরে। বাকি কথা শোনা যাক তাঁর মুখেই, ‘আমার বিভাগের অন্যদের সঙ্গে আলাপ করলাম বিষয়টি নিয়ে। মুখে মুখে রটে গেল। তখন সিলেটের লিডিং বিশ্ববিদ্যালয় ও চট্টগ্রামের প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগও প্রজেক্টটি নিয়ে কাজ করতে আগ্রহী হয়। রাঙামাটির চাকমা রানী জানালেন, তিনিও তাঁর মেয়েদের দিয়ে এ রকম ঘর বানাতে ইচ্ছুক। ধামরাইতে শৈলান সুরমা উচ্চবিদ্যালয়ের মেয়েরাও এ রকম বাঁশের বাড়ি বানাতে আগ্রহ দেখান।’ জায়নাব ফারুকীর নেতৃত্বে এ প্রজেক্টে যুক্ত হলেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালের স্থাপত্য বিভাগের কয়েকজন শিক্ষক। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন সায়কা ইকবাল, দিলরুবা ফেরদৌস, তানজিনা খান, শায়িকা বিনতে আলম, তারাননুম মাহমুদ, ইম্মাত আরা, নাবিলা নুশাইরাসহ আরও অনেকে।

ঘরের কাঠামো হিসেবে আছে বাঁশ

ছয়জন যাবেন লন্ডন

আগেই হয়ে গেছে প্রাকৃতিক উপাদানে বাড়ি তৈরির ওপর কর্মশালা। বিভিন্ন ক্যাম্পাসে আর শহরেও তৈরি হয়েছে এ বাড়ির মডেল। রাজধানীর আইএবির মাঠে ব্র্যাক আর সিলেটের লিডিং বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী শিক্ষার্থীরা এ তিন দিনে বানিয়ে ফেলবেন একটি আস্ত বাড়ি। সেখানে থাকবে বাঁশ, বেতসহ প্রাকৃতিক উপাদানে তৈরি ঘর, বাথরুম আর রান্নাঘর। এ ঘর তৈরিতে প্রকৃতিতে নতুন করে কোনো কার্বন যোগ হবে না।

এই নকশাতেই বানানো হচ্ছে বাড়িটি

ব্রিটিশ কাউন্সিলের অর্থায়নে পরে ছয় নারীর একটি দল যাবে লন্ডন। পাকিস্তানের ছয় নারীর একটি দলও যাবে। আর থাকবে ব্রিটিশ নারীদের একটি দল। এ ১৮ জন মিলে কিংস ক্রসস্টেশনে তিন দিনে বানাবেন এ রকম একটি মডেল। সেই মডেলে বাঁশ বা বেতের দেয়ালের পরিবর্তে ঝুলিয়ে দেওয়া হবে নকশিকাঁথা। সেখানে প্রদর্শনী শেষে মডেলটি উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে ওয়েলসে। প্রিন্স চার্লসের বাসভবনে স্থায়ীভাবে প্রদর্শনীর জন্য লাগিয়ে দেওয়া হবে। পুরো ব্যাপারটি ঘটবে ২০ থেকে ২৮ মার্চের ভেতর।

কী হবে এ বাড়ি বানিয়ে

নিজেদের প্রয়োজনমতো নানা কাজে ব্যবহার করা যাবে এ বাড়ি। রাঙামাটিতে চাকমা রানীর উদ্যোগে যে বাড়ি হয়েছে, স্থানীয় নারীরা সেখানে জড়ো হয়ে তাঁদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক বানাবেন। কেউ চাইলে এ বাড়িকে অফিস হিসেবেও ব্যবহার করতে পারেন। কড়াইলের বস্তিতে স্থানীয় ব্যক্তিদের নিয়ে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরা যে ঘর বানাবেন, সেটি ব্যবহৃত হবে সেলাই শেখার স্থান হিসেবে।

রংতুলির ছোঁয়ায় খেজুরপাতার পাটিতে স্পষ্ট হয়ে উঠছে নারীর অবয়ব

ঝিনাইদহতে যে বাড়ি বানানো হবে, সেটি প্রশিক্ষণকেন্দ্র আর বাচ্চাদের খেলার জায়গা হিসেবে ব্যবহার করা হবে। প্রাকৃতিক দুর্যোগে, যেমন ধরুন বন্যায় একটি গ্রাম ভেসে গেল। অন্য গ্রাম থেকে এ রকম ঘরের মডেল বানিয়ে বসিয়ে দেওয়া যাবে বন্যাকবলিত গ্রামে। সেটিকে তখন আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবেও ব্যবহার করা যাবে। বাহ্যিক কোনো প্রভাবক ছাড়া এ ঘর দিব্যি টিকে থাকবে ১৫ থেকে ২০ বছর।