তিনি অপরাজিতা

অপরাজিতা মোস্তফা
ছবি: কবির হোসেন

মঞ্চে তখন মমতাজ গাইছেন, ‘আল্লাহ মেঘ দে, পানি দে, ছায়া দে রে তুই, আল্লাহ মেঘ দে...’।

হ্যাঁ। কোক স্টুডিওর সাড়া ফেলে দেওয়া ‘ভিন্নতার উৎসব’ কনসার্টের কথাই বলছি। সেদিন মমতাজের গানের সঙ্গে তাল মিলিয়ে মঞ্চের এক কোণে ট্যাপ শু পরে নাচছিলেন একজন। শুধু ‘নাচ’ বললে অবশ্য ভুল বলা হয়। একটা কাঠের প্ল্যাটফর্মের ওপর পা দিয়ে তিনি বাজনা বাজাচ্ছিলেন। নাচ দেখে কিংবা বাজনা শুনে, যে কারণেই হোক, মুগ্ধ হয়েছেন দর্শক। অনেকেই হয়তো ভাবছিলেন, ‘কে এই মেয়েটা?’

যাঁরা চেনেন না, তাঁদের পরিচয় করিয়ে দিই। তাঁর নাম অপরাজিতা মোস্তফা।

জন্মের আগে থেকেই নাচ!

অপরাজিতা যখন মায়ের গর্ভে, তখন থেকেই নাচের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব। মায়ের নামটা যে মুনমুন আহমেদ! দেশের জনপ্রিয় নৃত্যশিল্পী। সন্তানকে গর্ভে নিয়ে নিয়মিত ক্লাস করাতেন মা।

অপরাজিতা মোস্তফা

সন্তান জন্মের পরও দেখা গেল, নাচের ক্লাসে ছোট্ট অপরাজিতা মায়ের এক পাশে চুপ করে বসে থাকে। এভাবেই কি ধীরে ধীরে নাচের প্রতি আগ্রহ জন্মাল? অপরাজিতা বললেন, ‘কী জানি! মা অবশ্য “রিভার্স সাইকোলজি” খেলত। বলত, তোমার এসব নাচ করার দরকার নেই। তুমি পড়াশোনা করো। শুনেই আমার মনে হতো, আমি তো নাচব। মূলত মা-ই আমার নাচের গুরু। এ ছাড়া বিভিন্ন সময় ভারত থেকে শিক্ষকেরা আসতেন বাংলাদেশে নাচের ওপর কর্মশালা করাতে। তাঁদের কাছ থেকেও শেখা হয়েছে। খুব ছোটবেলা থেকে দীর্ঘ সময় ধরে আমি কত্থক শিখেছি।’

ব্যস্ততাকে ‘হ্যাঁ’ বলুন

সানবিমস থেকে ও লেভেল আর এ লেভেল শেষ করে অপরাজিতা ভর্তি হন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে। সে সময়ই তিনি ডেইলি স্টার–এ চাকরি শুরু করেন। নাচও চলত সমানতালে। সঙ্গে যোগ হয়েছিল উপস্থাপনাও। অপরাজিতার ভাষায়, ‘জন্মের পর থেকে আমি সবকিছুতেই “না” বলতাম। খাবে? না। যাবে? না। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে আমি সবকিছুতেই হ্যাঁ বলা শুরু করলাম। সারা দিন তুমুল ব্যস্ত থাকতাম।’ এত কিছুর মধ্যেও স্নাতকে অপরাজিতার রেজাল্ট হলো দুর্দান্ত। ঝোলায় ভালো সিজিপিএ নিয়ে, স্নাতকোত্তর করতে চলে গেলেন যুক্তরাজ্যের লন্ডনে। ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের ইনস্টিটিউশন সোয়াসে (স্কুল অব ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজ) উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগে শুরু হলো তাঁর শিক্ষাজীবন।

লন্ডনে এক বছর

দেশে বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে তো নানা কিছু করেছেন। ভাবার সময় পাননি। লন্ডনে এক বছর সময় নিয়ে অপরাজিতা মূলত ভেবেছেন। কী চাই জীবনে? তার চেয়েও বড় প্রশ্ন, কী হতে চাই? বাকিটা শোনা যাক অপরাজিতার মুখ থেকে, ‘যুক্তরাজ্যে গিয়ে আমি কঠিন অসুখ বাঁধিয়ে বসলাম। নিজে নিজে হাসপাতালে ভর্তি হলাম। ওই সময় মাথাটা সবচেয়ে ফাঁকা ছিল। নিজেকে জিজ্ঞেস করলাম, আমি যদি এই মুহূর্তে মারা যাই, কোন কাজ না করতে পারার জন্য আমার আফসোস হবে?’ এভাবেই উত্তর পেয়ে গেলেন অপরাজিতা। ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনেও দারুণ রেজাল্ট হলো। দেশে ফিরে এসে কাজ শুরু করলেন একঝাঁক শিল্প ও সংস্কৃতিমনা তরুণের সঙ্গে।

নাচ, গান, সিনেমা...

২০২০–এর শেষে অপরাজিতা দেশে এসে ছোট ছোট কয়েকটা অডিও ভিজ্যুয়াল তৈরি করেছেন। সেগুলো নিজের ‘হাত পাকানো’র জন্য। তারপর কাজ করেছেন দেশের আরেক তরুণ নির্মাতা নুহাশ হুমায়ূনের সঙ্গে। আর ২০২১ সালের ডিসেম্বরে কাজ শুরু করলেন কোক স্টুডিওর সঙ্গে, সহকারী পরিচালক হিসেবে। এখন সেখানেই পোস্ট-প্রোডাকশন সুপারভাইজারের কাজ করছেন।

বহুদিন নাচ নিয়ে কাটানোর পর যুক্ত হলেন গানের সঙ্গে। এই ফাঁকে জানিয়ে রাখি, অপরাজিতার বাবা দেশের স্বনামধন্য নজরুলসংগীত শিল্পী। তিনি সুজিত মোস্তফা।

সেই নাচ, গান নিয়েই থাকা। তবে এত পড়াশোনা কেন? উত্তরে বললেন, ‘লেখাপড়া করেছি সার্টিফিকেট দেখিয়ে চাকরি করার জন্য নয়। নিজের সক্ষমতা যাচাই করতে। আমি যদি কাজটা মন দিয়ে করি, তাহলে কেমন ফলাফল পাব—এটা দেখতে চেয়েছিলাম! রেজাল্ট আমাকে আত্মবিশ্বাসী করেছে। বাব–মাকেও খুশি করেছে। তবে নাচ, গান আমার রক্তের সঙ্গে মিশে ছিল। আমি দেশের সেরা সৃজনশীল মানুষদের সঙ্গে দিন কাটাই, আড্ডা দিই। যতক্ষণ শিখি, আনন্দে থাকি। আনন্দে থাকার চেয়ে এক জীবনে আর কিছু কি বড় হয়?’