শৈশব থেকে ক্রিকেটের প্রতি অন্যরকম ঝোঁক ছিল তানজিদ হাসানের। কিন্তু ছেলের খেলাধুলায় সায় ছিল না মা-বাবার। বাবা-মায়ের ভয়ে লুকিয়ে মাঠে গিয়ে অন্যের ব্যাট-বল চেয়ে নিয়ে ক্রিকেট খেলতেন তানজিদ। পঞ্চম শ্রেণিতে ওঠার পর ডাক পড়ল অনূর্ধ্ব–১৪ দলের অনুশীলন শিবিরে। কিন্তু নিজের কোনো ব্যাট নেই। অন্যের ধার করা ব্যাটই ভরসা। নিজের একটা ভালো ব্যাটের স্বপ্ন ছিল ছোটবেলা থেকে। সেই স্বপ্ন পূরণ হতে দীর্ঘ অপেক্ষার প্রহর গুনতে হয়েছে। উচ্চমাধ্যমিকে ভালো ফলাফল করায় ছেলের ক্রিকেট অনুরাগের প্রতি বরফ গলে বাবার। অনূর্ধ্ব–১৭ দলে ডাক পাওয়ার পর ২৫ হাজার টাকায় তানজিদকে একটা ভালো ব্যাট কিনে দেন বাবা।
বগুড়ার সোনাতলা উপজেলার কর্পুর (ফাজিলপুর) গ্রামে বেড়ে ওঠা তানজিদের। এখন থাকেন বগুড়া শহরে। সেখানেই বাড়ির আঙিনায় বসে কথা হয় মা রেহানা আকতারের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘ওর বাবা চেয়েছিলেন পড়াশোনা শেষ করে তানজিদ চিকিৎসক বা প্রকৌশলী হোক। কিন্তু বগুড়া জিলা স্কুলে তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তির পরই তানজিদ ক্রিকেটের প্রতি ঝোঁকে। সহপাঠীদের কাছ থেকে ব্যাট-বল চেয়ে নিয়ে খেলত স্কুল মাঠে। ক্রিকেটের প্রতি তানজিদের ঝোঁক দেখে আমিও কৌশল নিই। স্কুল পরীক্ষায় ভালো করলেই স্টেডিয়ামে নিয়ে ক্রিকেট খেলা দেখানোর লোভ দেখাতাম। খেলা দেখার লোভে তানজিদ স্কুল পরীক্ষায় সত্যি সত্যি ভালো করত। বগুড়ার শহীদ চান্দু স্টেডিয়ামে ক্রিকেট অনুশীলন দেখাতে ওকে ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়ে বাইরে অপেক্ষা করতাম।’
গৃহিণী রেহানা আকতারের গল্প এগিয়ে চলে, বলেন, ‘ক্রিকেটের প্রতি তানজিদের এই ঝোঁক দেখে একদিন বিসিবির কোচ মোসলেম উদ্দিন বললেন, ছেলেকে ক্রিকেটে দিন। ভালো করবে। শহরে ভাড়া বাসায় থাকতাম। বাবার ভয়ে ওকে লুকিয়ে মাঠে পাঠাতাম।
‘এভাবে লুকিয়ে খেলেই পঞ্চম শ্রেণিতে ওঠার পর অনূর্ধ্ব–১৪ জেলা দলে নাম লেখায়। স্কুল থেকে পরীক্ষা দিয়ে ফিরে ব্যাট-বল হাতে ছুটত মাঠে। ওর ব্যাট, জুতা কেনার টাকা ছিল না। বাবার কাছেও ব্যাট চাইতে পারেনি। অনেক কষ্ট করে সাধনা করে পড়াশোনা এবং ক্রিকেট একসঙ্গে চালিয়েছে। অন্যের ব্যাট চেয়ে নিয়ে খেলত। মাঠ থেকে ফিরে বাবার ভয়ে সারা রাত জেগে পড়াশোনা করত। একদিন ক্রিকেট খেলার কথা বাবা জেনে গেলেন। রাগের মাথায় বাড়ি থেকে বের করে দিলেন। তবুও দমল না তানজিদ। পড়াশোনা এবং ক্রিকেট একসঙ্গে চালিয়ে গেল। অবাধ্য হয়ে ক্রিকেট খেলা ছেড়ে না দেওয়ায় রাগ করে আরও দুদিন বাড়ি থেকে বের করে দিলেন ওর বাবা।’
লুকিয়ে লুকিয়ে ক্রিকেট খেলেও বগুড়া জিলা স্কুল থেকে এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ ৫ পেলেন তানজিদ। সরকারি আজিজুল হক কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিকেও জিপিএ–৫ পেলেন। এখন পড়ছেন ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে।
তানজিদের বাবা তোজাম্মেল হোসেন সোনাতলা স্বাস্থ্য
কমপ্লেক্সের স্বাস্থ্য পরিদর্শক পদে চাকরি করেন। এক ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে ছোট তানজিদের সাফল্যে রীতিমতো আবেগাপ্লুত তিনি। বলেন, ‘চেয়েছিলাম ছেলে পড়াশোনা শেষ করে চিকিৎসক-প্রকৌশলী হোক। কিন্তু শৈশব থেকেই ক্রিকেটের প্রতি অন্য রকম ঝোঁক তানজিদের। ভেবেছিলাম, পড়াশোনায় খারাপ করবে। ক্রিকেট ছাড়াতে তিন দফা বাড়ি থেকে বেরও করে দিয়েছিলাম। এখন তো রাস্তাঘাটে বের হলেই লোকজন বলাবলি করে, ওই যে তানজিদের বাবা যায়।’