তারুণ্য

তরুণ গবেষক খুঁজে ফেরেন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস

চৌধুরী শহীদ কাদের
ছবি: খালেদ সরকার

ট্রাংকভর্তি পুরোনো আমলের ক্যাসেট। কিসের ক্যাসেট এগুলো? গবেষক চৌধুরী শহীদ কাদেরের করা প্রশ্নটা শুনে আনন্দ ও বিষাদ দুটিই ফুটে উঠেছিল রবিন সেনগুপ্তর অভিব্যক্তিতে। তিনি জানান, মুক্তিযুদ্ধের সময়কার কুমিল্লা, আখাউড়া, বিলোনিয়া প্রভৃতি অঞ্চলের রণাঙ্গনের ভিডিও ক্যাসেট ওগুলো। যুদ্ধ-পরবর্তী ১৯৭২-৭৩ সালের পর আর চালিয়ে দেখা হয়নি। এখন তো রীতিমতো অচল। সেকেলে ওই ক্যাসেট চালানোর প্লেয়ারও নেই এখন।

রবিন সেনগুপ্তর সঙ্গে সেই কথোপকথনের দিনটির কথা আজও স্পষ্ট মনে করতে পারেন তরুণ গবেষক চৌধুরী শহীদ কাদের। ২০১২ সালে তিনি গিয়েছিলেন ভারতের চিত্রসাংবাদিক রবিন সেনগুপ্তর সাক্ষাৎকার নিতে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনের অনেক ছবির চিত্রগ্রাহক ত্রিপুরার এই চিত্রসাংবাদিক। এমন মানুষের সাক্ষাৎ পাওয়া বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ অন্তঃপ্রাণ একজন তরুণের কাছে নিঃসন্দেহে আনন্দের। সেই আনন্দ যেন আকাশ ছোঁয় দুষ্প্রাপ্য ক্যাসেটগুলোর আবিষ্কারে। কিন্তু ক্যাসেটের সারবস্তু কি উদ্ধার করা সম্ভব? সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ। এই ক্যাসেট অচল কিংবা সচল—যা-ই হোক, এগুলো বহন করছে মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকে। তাই উদ্ধারের অনিশ্চয়তা সত্ত্বেও তিনি নিয়ে আসেন সেগুলো। এরপর অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনের উদ্যোগে বাংলাদেশ টেলিভিশনের মাধ্যমে ক্যাসেটগুলো পরিস্ফুটন করে প্রায় ১০০ মিনিটের ভিডিও উদ্ধার করা হয়। বাংলাদেশ টেলিভিশন সেই ভিডিও ফুটেজ দিয়ে দুঃসময়ের বন্ধু রবিন সেন নামে একটি প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করে।
রবিন সেনের কাছ থেকে আরও একটি দুষ্প্রাপ্য জিনিস সেদিন সংগ্রহ করেছিলেন চৌধুরী শহীদ কাদের। ১৯৭১ সালের ১৫ ডিসেম্বর রবিন সেনের নেওয়া বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের একটি অপ্রকাশিত সাক্ষাৎকারের অডিও ফাইল। এ যেন দুষ্প্রাপ্য রত্ন আবিষ্কারের আনন্দ। কিংবা বুকে একাত্তর ধারণ করে বড় হয়ে ওঠা বাঙালি তরুণের ইতিহাসের ঋণ শোধের প্রচেষ্টা, যে আনন্দময় প্রচেষ্টা তাঁকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলেছে বাংলাদেশের মুক্তি–ইতিহাসের গভীর থেকে গভীরে।

পরিবারের প্রথম বাউন্ডুলে
পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে সবার ছোট চৌধুরী শহীদ কাদের। চট্টগ্রামের দক্ষিণাঞ্চলে জন্ম, ১৯৮৬ সালে। বেড়ে ওঠার দিনগুলোতে সেই শিশুমনেই অবচেতনে যেন গেঁথে গিয়েছিল মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। মনে তৈরি হয়েছিল কিছু প্রশ্ন, যেসব জবাব খুঁজে ফিরেছেন নিরন্তর।
যৌথ পরিবারের অন্যান্য চাচাতো ভাইবোন কিংবা নিজের বড় চার ভাইবোন—সবাই পড়াশোনা করেছেন বিজ্ঞান কিংবা বাণিজ্য বিভাগে। এর মধ্যে তাঁর ইতিহাস বিষয়ে পড়াশোনা, গবেষণা কিংবা শিক্ষকতা—সবকিছু যেন পারিবারিক চলমান ধারার বাইরে বেরিয়ে আসার মতো ব্যাপার। পড়াশোনা করতে ভাইবোনদের মধ্যে তিনিই প্রথম ঢাকায় এসেছিলেন। ২০০৪ সালে চট্টগ্রাম সিটি কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করে চিকিৎসক পিতার স্বপ্নপূরণে মেডিকেলে ভর্তির কোচিংও করেছিলেন। মেডিকেলে সুযোগ না পেয়ে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে।
এই সুযোগ না পাওয়াটা কি ভবিষ্যতের বৃহত্তর কোনো অবচেতন ইঙ্গিত ছিল? কিংবা শিশুকাল থেকে খুঁজে ফেরা প্রশ্নগুলোর জবাবের যোগসূত্র! হবে হয়তো। তা না হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় অর্জিত মেধাক্রম অনুযায়ী অন্য অনেক বিভাগেই ভর্তি হওয়ার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও ইতিহাস বিভাগই বেছে নিলেন কেন? নিঃশর্ত কৃতজ্ঞতায় চৌধুরী শহীদ কাদের স্মরণ করলেন একটি নাম—মৃত্তিকা সহিতা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের শিক্ষক। সে বছর ইতিহাস বিভাগ থেকে সদ্য স্নাতকোত্তর মৃত্তিকা সহিতার উৎসাহেই মূলত বিষয়টি বেছে নেওয়া। এরপর ইতিহাস বিভাগ থেকেই স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন।
স্নাতকোত্তর শ্রেণিতে পড়ার সময়ই মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে গবেষণার প্রতি ঝোঁকটা তৈরি হয়। এই প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনের কথা উল্লেখ করলেন। কাদের বলেন, ‘আমি মূলত প্রাচীন বাংলার ছাত্র ছিলাম। ২০১১ সালে স্নাতকোত্তরে পড়ার সময় অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন আমাকে বাংলাদেশ শিশু একাডেমীর একটি প্রকল্পে যুক্ত করে নেন। বঙ্গবন্ধুর ওপর ২৬টি গ্রন্থ প্রকাশের সেই প্রকল্পভুক্ত একটি গ্রন্থ বঙ্গবন্ধু কোষ-এর সহকারী সম্পাদক হিসেবে কাজ করতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধ গবেষণার প্রতি একধরনের আত্মিক সংযোগ অনুভব করি। বলা যেতে পারে, বঙ্গবন্ধুর মধ্য দিয়েই মুক্তিযুদ্ধ, গণহত্যা তথা বৃহত্তর অর্থে বাংলাদেশ সৃষ্টিতে ১৯৭১-এর বিশালতা ধীরে ধীরে আমার কাছে উন্মোচিত হতে থাকে। এরপর মুনতাসীর মামুন স্যারের “মুক্তিযুদ্ধ কোষ” প্রকল্পেও সহকারী সম্পাদক হিসেবে কাজ করি।’

চৌধুরী শহীদ কাদেরের প্রকাশিত দুটি বইয়ের প্রচ্ছদ

সেই পথে হেঁটে হেঁটে
২০১৩ সালে ত্রিপুরা রাজ্য সরকার বিলোনিয়ায় একটি ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী উদ্যান প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়। এ উপলক্ষে বাংলাদেশ থেকে চারজন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষকের সমন্বয়ে যে উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করা হয়, সেখানে চৌধুরী শহীদ কাদেরকে দেওয়া হয় সমন্বয়কের দায়িত্ব। অধ্যাপক মোবাশ্বের হোসেন, অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন এবং চিত্রশিল্পী হাশেম খানের মতো বিদগ্ধ মানুষদের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ তাঁর ভবিষ্যৎ কাজের গতিপথ ঠিক করে দেওয়ার মতো একটি ঘটনা বলেই মনে করেন কাদের। কাজটি করতে গিয়ে দীর্ঘ সময় থাকতে হয়েছে ত্রিপুরায়।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক নানাবিধ পড়াশোনার পাশাপাশি বিশেষত পড়াশোনা করতে হয়েছে মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ভূমিকা নিয়ে। তবে সীমান্তবর্তী মানুষের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে তিনি প্রথমবারের মতো উপলব্ধি করেন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সীমান্তবর্তী সাধারণ মানুষ যে অপরিসীম অবদান রেখেছেন, ইতিহাসে তা একরকম অনালোচিতই। এ ব্যাপারে অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনের সঙ্গে কথা বললে তিনি ‘মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সীমান্তবর্তী রাজ্যসমূহের সাধারণ মানুষের ভূমিকা’ শিরোনামে বিষয়টি নিয়ে পিএইচডি করার পরামর্শ দেন।
পিএইচডির পাশাপাশি পুরোদমে চলতে থাকে মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বিরামহীন গবেষণা। সে সময়েই চৌধুরী শহীদ কাদের লেখেন মুক্তিযুদ্ধে ত্রিপুরা: শরণার্থী, সংবাদপত্র ও সাধারণ মানুষ; আসামের বরাক উপত্যকার কবিয়ালদের নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে বরাক উপত্যকার কবিতা ও কবিগান। গণহত্যা ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক ১০টি বই প্রকাশিত হয়েছে এরই মধ্যে।

চেতনা ছড়িয়ে পড়ুক প্রজন্মান্তরে
অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনের মস্তিষ্কজাত বাংলাদেশের প্রথম ‘গণহত্যা জাদুঘর’-এর প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছেন চৌধুরী শহীদ কাদের। এর ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্যও তিনি। তাঁর ভবিষ্যৎ স্বপ্নের অধিকাংশ অংশজুড়ে রয়েছে এই গণহত্যা জাদুঘর। অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন তাঁর এই ছাত্র সম্পর্কে বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ বিষয় নিয়ে আমার সঙ্গে অনেকেই কাজ করছে। যেমন, মামুন সিদ্দিকী, ড. মুরশিদা বিনতে রহমান, আহমেদ শরীফ, তপন পালিত এবং চৌধুরী শহীদ কাদের। সবাই খুব ভালো করছে। তবে এদের মধ্যে চৌধুরী শহীদ কাদের তরুণতম। বিষয়বৈচিত্র্য, সাংগঠনিক দক্ষতা এবং কাজের প্রতি আন্তরিকতা, বিশেষত গণহত্যা জাদুঘর প্রতিষ্ঠায় তাঁর নিরন্তর পরিশ্রম প্রশংসনীয়।’
পেশাগতভাবে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের সহকারী অধ্যাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ২০১৪ সালে অতিথি শিক্ষক হিসেবে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস’ কোর্সটি পড়িয়েছেন। বাংলাদেশ ইতিহাস সম্মিলনীর যুগ্ম সম্পাদক চৌধুরী শহীদ কাদের ২০১৮ সালে পেয়েছেন জাতীয় অধ্যাপক সালাউদ্দিন আহমেদ পুরস্কার। একই বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণা সংসদ প্রবর্তিত তরুণ মুক্তিযুদ্ধ গবেষক সম্মাননায় ভূষিত হন তিনি।
মুক্তিযুদ্ধের মাহাত্ম্য, বিশালতা এবং যথাযথ ইতিহাস-পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেওয়া জরুরি বলে গ্রহণ করেননি তথাকথিত আভিজাত্যের পেশা। গবেষণা এবং শিক্ষকতার মধ্য দিয়ে চেতনা ছড়িয়ে দিতে চান প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে।