ঢাকার ছেলে মাস্টার শেফ নাজিম খান

যুক্তরাষ্ট্রে সম্প্রতি মাস্টার শেফ সনদ পেয়েছেন বাংলাদেশের নাজিম খান। নিকোল কিডম্যান বা অ্যালেক বল্ডউইনের মতো তারকা খেয়েছেন তাঁর রান্না। মিশেল ওবামার জন্যও একবার এক পদ করেছিলেন তিনি।

নাজিম খান

নিকোল কিডম্যান বা অ্যালেক বল্ডউইনের মতো হলিউডের আরও অনেক অভিনেতা খেয়েছেন নাজিম খানের রান্না। একবার তিনি একটি পদ করেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক ফার্স্ট লেডি মিশেল ওবামার জন্যও। জগৎজুড়ে বিখ্যাত এমন অনেকের জন্য রান্না করেছেন। বিখ্যাত মার্কিন হোটেলে চাকরির সুবাদে এ সুযোগ মিলেছে পুরান ঢাকার ছেলে নাজিম খানের। সম্প্রতি তিনি পেয়েছেন মাস্টার শেফ সনদ। বাংলাদেশের একজন কীভাবে হলেন নিউইয়র্কের বিখ্যাত শেফ, বিজয় দিবসের সন্ধ্যায় হোয়াটসঅ্যাপে সেই গল্পই করলেন নাজিম খান।

রিয়েলিটি শো বনাম মূল সনদ

দেশ-বিদেশের অনেক রান্নাবিদের নামের আগে মাস্টার শেফ আছে। তবে তাঁদের কেউ কেউ আবার রান্নাবান্নার প্রতিযোগিতা ‘মাস্টার শেফ’ অনুষ্ঠানে বিজয়ী হওয়ার কারণে এটি লিখে থাকেন। তবে এর সঙ্গে নাজিমের মাস্টার শেফের পার্থক্য বিস্তর। যাঁরা নিয়মিত খাবার ও রান্নার খোঁজ রাখেন, তাঁরা জানেন ‘সার্টিফায়েড মাস্টার শেফ’ মূলত রান্নাশিল্পের একটি বিশেষ সনদ, যা বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশ থেকে দেওয়া হয়। নাজিম খান এই সনদ অর্জন করেছেন ফ্রান্সের ওয়ার্ল্ডশেফ অর্গানাইজেশনের কাছ থেকে। এর আগে ২০০৭ সালে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের আমেরিকান কুলিনারি ফেডারেশনের সার্টিফায়েড এক্সিকিউটিভ শেফের সনদ পান।

নাজিম খান জানান, রান্না শিল্পের সর্বোচ্চ এই মাস্টারশেফ সনদের পরীক্ষায় বসার আগে একজন শেফকে আরও একাধিক ডিগ্রিধারী হতে হয়। থাকতে হয় সার্টিফায়েড এক্সিকিউটিভ শেফের দক্ষতা। নির্দিষ্ট ফি দিয়ে বসতে হয় কয়েক দফা পরীক্ষায়। দেখাতে হয় নিজের রান্নার দক্ষতা। দেশ–বিদেশের বিচারকদের সামনে খাবার নিয়ে নিজের মুনশিয়ানা দেখিয়ে খুশি করতে পারলে তারপর মেলে রান্নার এ বিশেষ সনদ। এই সনদপ্রাপ্তদের তালিকায় নাজিম খানই প্রথম বাংলাদেশের নাম লেখালেন। এক ই–মেইলে তথ্যটি নিশ্চিত করেছেন ওয়ার্ল্ডশেফের এডুকেশন ডিরেক্টর জন ক্ল্যানসি।

নাজিম খানের তৈরি পাস্তা

উর্দু রোড টু নিউইয়র্ক

পুরান ঢাকার উর্দু রোডে বাড়ি নাজিম খানের। ছোটবেলা থেকেই খাবারের প্রতি বিশেষ আকর্ষণ। নাজিম খান বলেন, ‘পুরান ঢাকার বড় বাপের পোলায় খায়, হাজির বিরিয়ানি, নীরব হোটেলের ভর্তা, নানা রকম কাবাব আর বিরিয়ানি খেয়েই বড় হয়েছি। আমার বাড়িতেও নানা রকম রান্না হতো। বাবার মতো আমিও ছিলাম খাবার পাগল।’

পরিবার, বন্ধু আর দেশি খাবারের স্বাদ ছেড়ে ১৯৯২ সালে নাজিম খান পাড়ি জমান যুক্তরাষ্ট্রে। তত দিনে শেষ করেছেন এসএসসি ও এইচএসসি। জর্জিয়া কলেজে বিবিএ পড়তে গিয়েছিলেন। তবে কিছুদিন যেতে না যেতেই পড়াশোনায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। মা তাঁকে দেশে ফিরে আসতে বলেন। নাজিম ফেরেন না। তিনি কাজ করে টিকে থাকার নতুন লড়াই শুরু করলেন।

নিউইয়র্কে পরিচয় হলো আসমা খান নামে এক দেশি তরুণীর সঙ্গে। পরিচয় থেকে বন্ধুত্ব গিয়ে গড়াল প্রেমে। ১৯৯৬ সালে তাঁরা বিয়ে করলেন। নাজিম তখন নিউইয়র্কের লং আইল্যান্ডে একটি রেস্তোরাঁয় কাজ করতেন। সেখানেই শেফ তোরাসানের কাছ থেকে শিখেছিলেন সুসি বানানো। সুসি শেফ হিসেবে দ্রুতই নিজের জায়গা করে নিলেন নাজিম। এরপর অভিজাত হোটেল নিউইয়র্ক ম্যারিয়ট ম্যারকুইস হোটেলের একটি জাপানি রেস্তোরাঁয় শেফ হিসেবে কাজের খোঁজে যান নাজিম। সেখানে পদ খালি না থাকায় তাঁকে হোটেলের ফরাসি রেস্তোরাঁ জে ডব্লিউস স্টেক হাউসের কুক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।

এখানকার নির্বাহী শেফ জর্জ ম্যাকনিলের কাছ থেকে নানা রকম নতুন খাবার তৈরির অনুপ্রেরণা পেলেন নাজিম। জর্জকে তিনি এখনো গুরু মানেন। ২০০১ সালে টুইন টাওয়ার হামলার পর বদলে গেল প্রেক্ষাপট। নাজিম তখন একটি ইতালীয় রেস্তোরাঁর শেফ।

নাজিম বলেন, ‘ভালোই কেটে যাচ্ছিল। এর মধ্যে আমার ছেলে নোহাদ আলী খানের জন্ম হলো। কিছুদিন যেতেই বুঝলাম আমি বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়েছি। সকালে যখন বের হই ছেলে ঘুমায়, রাতে ফিরেও তাকে ঘুমাতে দেখি। পরিবারে ঠিকমতো সময় দিতে না পারায় নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছিল। স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে সেই চাকরি ছেড়ে দিলাম।’

এরপর বেশ কিছুদিন নির্বাহী শেফ হিসেবে পড়িয়েছেন ভার্জিনিয়া পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে। এরপর আরও কয়েকটি হোটেলে কাজ করেন। ২০১৫ সাল থেকে নাজিম খান নেব্রাস্কার ব্রাইন হেলথ মেডিকেল সেন্টারের (যুক্তরাষ্ট্রের একটি বড় মেডিকেল ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল) রান্নাঘর সামলাচ্ছেন এক্সিকিউটিভ শেফ হিসেবে। নাজিম খানের অধীনে এখন প্রায় ৩০০ কর্মী (কুক ও শেফ) সেখানকার চিকিৎসক, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা, রোগী ও অতিথিদের জন্য খাবার তৈরি করেন। গত নভেম্বরের শেষ দিকে নাজিম খান তাঁর কাঙ্ক্ষিত মাস্টার শেফ সনদ পেয়েছেন পরীক্ষার নানা ধাপ পেরিয়ে।

ছেলে ও স্ত্রীর সঙ্গে নাজিম খান

নিজে কী খেতে ভালোবাসেন

যখন থেকে নাজিম খানের রান্নার প্রতি ভালোবাসা জন্মেছে, তখন থেকেই তিনি চেষ্টা করেন খাবারে অভিনবত্ব আনতে। কিন্তু নিজে কী খেতে ভালোবাসেন? উত্তর শুনলে আপনারও চোখ কপালে উঠে যাবে। ‘আমি আসলে ভেতো বাঙালি। ভাতের সঙ্গে ডাল আর মাছ থাকলেই জমে যায়। এখনো আমি নিয়মিত এক বেলা ভাত খাই।’ ভাত-ডালের এই গল্প বলতে বলতে নাজিম ফিরে গেলেন ছেলেবেলায়, ‘একাত্তরে তো আমি খুবই ছোট। ডাল খেতে ভালোবাসতাম। অনেক সময় বাসায় ডাল না থাকলে দাদি প্রতিবেশীর বাড়ি থেকে চাল দিয়ে ডাল পাল্টে নিয়ে আসতেন।’

মিশেল ওবামা একবার একটি সমাবর্তনে বক্তৃতা দিতে এসেছিলেন ভার্জিনিয়ায়। হোটেলের প্রেসিডেন্ট স্যুইটে ছিলেন। মিশেল আসার এক মাস আগে থেকে সেখানকার রান্নাঘরসহ কে কী রান্না করবে, সেটা ঠিক করতে আসে সিক্রেট সার্ভিসের একটি বিশেষ দল। যদিও এ ধরনের অতিথিরা বাইরের খাবার খুব কম খান। তারপরও মিশেলের জন্য একটি খাবার নিয়েছিল সিক্রেট সার্ভিস টিম। যেটি তৈরি করেছিলেন শেফ নাজিম খান। আম দিয়ে ম্যাঙ্গো পারফে (ডেজার্ট) বানিয়েছিলেন তিনি।

রান্নাঘরে বাজিমাত করতে

ভালো রান্নার জন্য কিসের দরকার পড়ে? উত্তরে নাজিম খান বললেন, ‘শুধু তিনটা পি। প্যাশন (আগ্রহ), পেশেনস (ধৈর্য) ও পার্সিসটেন্সি (অধ্যবসায়)। এই তিন পি কারও মধ্যে থাকলে তাঁকে কেউ আটকে রাখতে পারবে না।’

পাঠকদের জন্য নাজিম খান দিলেন রান্নার দুটি টিপস—

  • লেবুর বাইরের আবরণ কিন্তু দারুণ স্বাদবর্ধক। মাছ বা মাংস রান্নার শেষ পর্বে একটা লেবুর আবরণ কুচি করে দিলেই দেখবেন আপনার খাবার আলাদা হয়ে পড়েছে অন্যদের থেকে।

  • খাবারে পার্সলে, ধনেপাতা, পুদিনা বা অরিগানো দিতে হবে একেবারে শেষে। এটি পুরো রান্না হলে সুঘ্রাণ নষ্ট হয়ে যায়। তাই এসব উপকরণ দেওয়ার পর দ্রুত খাবারটি নামিয়ে নিতে হবে।

তিন ভাইবোনের মধ্যে সবার বড় নাজিম খান আলো ঝলমলে রান্নাঘরে জীবন কাটালেও তাঁর মন পড়ে থাকে উর্দু রোড বা নাজিমুদ্দিন রোডের ছোট ছোট খাবারের দোকানে। যতই তিনি মিশেলের জন্য ডেজার্ট বানান, নিজের লোভ সেই পুরান ঢাকার ছানা আর রসগোল্লার কড়াইয়ে। পৃথিবীর এই মহামারিকাল শেষ হলে ২০২১ সালে নাজিম খান দেশে আসতে চান। তেপ্পান্ন গলির শহর ঘুরে আশ মিটিয়ে খেতে চান শৈশবের খাবার।