ডিমের পুষ্টিগুণ নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। উচ্চ প্রোটিন, ভিটামিন, খনিজ—কী নেই ডিমে! ডিমকে বলা হয় সত্যিকারের ‘পাওয়ার হাউস’। রোগ প্রতিরোধে ভীষণ কার্যকর ভূমিকার কারণেই এই অভিধা পেয়েছে ডিম। এরপরও অনেকের ধারণা, একটি বয়সের পর ডিম খাওয়ায় একটু রাশ টানা দরকার। কারণ, তা নাকি হৃদ্রোগের ঝুঁকি বাড়ায়। অথচ গবেষণা বলছেন ভিন্ন কথা। চীনের একদল গবেষক সম্প্রতি জানিয়েছেন, প্রতিদিন একটি করে ডিম খেলে হৃদ্রোগে মৃত্যুর ঝুঁকি কমে ১৮ শতাংশ।
চীনের একদল গবেষক সম্প্রতি ডিমের পুষ্টিগুণ নিয়ে একটি গবেষণা চালান। এতে তাঁরা দেখেন, যাঁরা দিনে একটি করে ডিম খান, তাঁদের হৃদ্রোগে মৃত্যুর ঝুঁকি যাঁরা খায় না তাঁদের চেয়ে ১৮ শতাংশ কম থাকে। প্রায় চার লাখ প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির স্বাস্থ্যতথ্য পর্যালোচনা করে এ তথ্য জানিয়েছেন গবেষকেরা। এ নিয়ে একটি গবেষণা প্রতিবেদন ২১ মে ‘হার্ট’ সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়েছে।
গবেষণা নিবন্ধের সহলেখক ও পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব পাবলিক হেলথের সহযোগী অধ্যাপক ক্যানকি ইউ সিএনএনকে বলেন, ‘আগে চিকিৎসকেরা অনেক সময় একটি বয়সের পর বেশি ডিম খাওয়ার বিষয়ে সতর্ক করতেন। এর কারণ হিসেবে ডিমে থাকা কোলেস্টেরলের কথা বলতেন তাঁরা। কিন্তু আমাদের গবেষণায় ভিন্ন চিত্র উঠে এসেছে। এ নিয়ে হওয়া আগের গবেষণাগুলোতেও এই মতের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করা হয়েছে। কিন্তু ওই সব গবেষণায় ডিমের সঙ্গে হৃদ্রোগের সম্বন্ধ খুঁজতে গিয়ে অংশগ্রহণকারীদের জীবনাচরণ ও অন্য খাদ্যাভ্যাসের বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। সাম্প্রতিক গবেষণায় এই ঘাটতিগুলো কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করা হয়েছে।’
এখানে বলা প্রয়োজন, হৃদ্রোগ বলতে গবেষকেরা উচ্চ রক্তচাপ থেকে শুরু করে রক্ত সংবহনতন্ত্র-সংশ্লিষ্ট সব ধরনের রোগের কথাই বলছেন। হার্ট অ্যাটাক, এরিথমিয়া ও স্ট্রোকের মতো প্রাণঘাতী বিষয়কেও গবেষণার আওতায় রাখা হয়েছে। আর এসব রোগের পেছনে ধূমপান, বাজে খাদ্যাভ্যাসসহ নানা অনিয়ম কারণ হিসেবে কাজ করতে পারে। এই বিষয়গুলোকে বিবেচনায় রেখেই চীনের এই গবেষক দল ডিম ও হৃদ্রোগের মধ্যে সম্পর্কটি খুঁজতে চেয়েছেন। এ জন্য তাঁরা চীনের ১০টি অঞ্চলের ৩০ থেকে ৭৯ বছর বয়সী প্রায় পাঁচ লাখ মানুষের ওপর চলমান একটি গবেষণা থেকে তথ্য সংগ্রহ করেন। ওই গবেষণায় অংশ নেওয়া ব্যক্তিদের মধ্য থেকে তাঁরা ৪ লাখ ১৬ হাজার ২১৩ জনের তথ্য আলাদা করেন, যাঁদের ক্যানসার, হৃদ্রোগ বা ডায়াবেটিসের কোনো পূর্ব ইতিহাস নেই। পরে এদের ওপর একটি জরিপ চালান তাঁরা।
এতে দেখা যায়, অংশগ্রহণকারীদের ১৩ শতাংশ দিনে একটি করে ডিম খান। আর ৯ শতাংশ জানায়, তারা খুব কমই ডিম খায়। আরেকটি বিষয় তাঁরা লক্ষ করেন, অংশগ্রহণকারীদের কেউই হাঁসের ডিম খান না। খান মুরগির ডিম। প্রাথমিক এই তথ্য সংগ্রহের পর অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিদের নয় বছর পর্যবেক্ষণে রাখা হয়। এ সময় বিশেষত হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক, হৃদ্যন্ত্রে ব্লকসহ রক্ত সংবহনতন্ত্রের বড় ধরনের সংকটগুলোর দিকে নজর রাখেন গবেষকেরা। এই পর্যবেক্ষণকালে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ৯ হাজার ৯৮৫ জন মারা যান হৃদ্রোগে ভুগে। এ ছাড়া আরও ৫ হাজার ১০৩ জন মারা যান রক্ত সংবহনতন্ত্রের রোগে ভুগে। এই একই সময়ের মধ্যে আরও প্রায় ৮৫ হাজার অংশগ্রহণকারীর হৃদ্রোগ ধরা পড়ে। দ্বিতীয় ধাপের এই তথ্য প্রথম ধাপের তথ্যের সঙ্গে তুলনামূলক বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, দিনে একটি করে ডিম যাঁরা খেয়েছেন, তাঁদের মধ্যে যাঁরা খাননি তাঁদের চেয়ে হৃদ্রোগ হওয়ার ঝুঁকি কম।
আরও সুনির্দিষ্ট করে ক্যানকি ইউ বলেন, দিনে একটি ডিম খেলে স্ট্রোকের ঝুঁকি কমে ২৬ শতাংশ। আর স্ট্রোক থেকে মৃত্যুর ঝুঁকি কমে ২৮ শতাংশ। হৃদ্যন্ত্রে ব্লকের ঝুঁকি কমে ১২ শতাংশ।
তবে এই গবেষণাকে খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ মানছেন না কানাডার আলবার্টা বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি ও পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ক্যারোলিন রিচার্ড। তাঁর মতে, এটি একটি পর্যবেক্ষণনির্ভর গবেষণা। ফলে, এর ওপর ভিত্তি করে ডিম ও হৃদ্রোগের মধ্যে সরাসরি আন্তসম্পর্কের বিষয়ে উপসংহার টানা উচিত নয়। তবে যে বৃহৎ পরিসরে এই কাজ হয়েছে, তা এ-সম্পর্কিত গবেষণায় একটি বড় অগ্রগতি। বিশেষত এর সবচেয়ে বড় অবদান হলো, নিয়মিত ডিম খেলে হৃদ্রোগের ঝুঁকি বাড়ে না—এই সত্যকে সামনে নিয়ে আসা।