উঠতি বয়সী সন্তান ডিজিটাল মাধ্যমে অতিরিক্ত সময় কাটাচ্ছে। বিষয়টা নেতিবাচক। মা তাই ছেড়ে দিয়েছেন চাকরি। রাজধানীর বাসিন্দা এক পরিবারের এমনই দুঃখজনক বিষয় জানতে পারলাম সম্প্রতি। অনলাইনে হয়েছে সন্তানের পড়াশোনা, অবসরে সাহিত্যচর্চার অনলাইন মাধ্যমও আমাদের অদেখা নয়। তবে নেতিবাচকতা সৃষ্টি হয়েছে ডিভাইস-নির্ভরশীলতার মাঝে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম অতিমাত্রায় ব্যবহারে। শারীরিক, মানসিক নানান সমস্যার সম্মুখীন নতুন প্রজন্ম। মনে পড়ে আমাদের শৈশবের কথা। বিকেলে সমবয়সীদের সঙ্গে খেলা কিংবা নানুবাড়িতে মামাতো-খালাতো ভাইবোনেরা একসঙ্গে হলে ছবি আঁকার প্রতিযোগিতার আনন্দময় দিন। স্কুলে দেয়ালপত্রিকা তৈরির দিন। সেসব আজ স্মৃতি। কিন্তু ‘শৈশব’ কিংবা ‘কৈশোর’ তো নিত্যবিরাজমান এই পৃথিবীর বুকে। তবে ডিজিটাল যুগের পৃথিবীর ‘উঠতি’ বয়সকালটা আজ বড্ড যান্ত্রিক হয়ে পড়েছে। হারিয়েছে জীবনের মাধুর্যময় ইতিবাচকতাকে গ্রহণ করার দুর্নিবার শক্তি।
ডিজিটাল ডিভাইস ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের গোলকধাঁধায় হারিয়ে যাচ্ছে পারিবারিক সময়। পারিবারিক বন্ধন হারাচ্ছে দৃঢ়তা। ঘুমের ছন্দপতন ঘটেছে। স্থূলতার প্রবণতা বাড়ছে। চোখের সমস্যা দেখা দিচ্ছে। দীর্ঘ সময় ঘাড় নুইয়ে রাখার ফলে ঘাড়ে ব্যথাও হচ্ছে। আর মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ বিষয় হলো সাইবার বুলিং (সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কটূক্তি) এবং বিকৃত মানসিকতার বার্তা প্রেরণ। যেগুলোর কারণে কোমল মনের নীল আকাশে হানা দিতে পারে নেতিবাচকতার ভয়াল কালো মেঘ। বিষাদে ছেয়ে যেতে পারে উচ্ছলতার সময়গুলো।
সন্তানকে সময় দিন
সন্তানের বয়স অনুযায়ী তার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারের সীমা নিশ্চিত করুন। এর খারাপ দিকগুলো বুঝিয়ে বলুন। প্রয়োজন ছাড়া বড়জোর খানিক বিনোদনের জন্য, এর বেশি নয়। সময় বেঁধে দিতে পারেন। তবে কড়া বাক্য, শারীরিক আঘাত কিংবা শাস্তির মাধ্যমে নয়। জীবনের ব্যস্ততার মাঝেই আনুন সৃজনশীলতা। সন্তানকেও যুক্ত করুন সেখানে। সারা সপ্তাহে বা মাসে হয়তো আপনি দুটি বই পড়েছেন, সন্তানের সঙ্গে ভাগ করে নিন সেই আনন্দটুকু। সে কী বই পড়ল, কোনটা ভালো লাগল, কোনটা মন্দ লাগল—এসব আলাপ করুন। বই পড়তে উৎসাহ দিন। গাছ লাগাতে উৎসাহী করে তুলুন। পোষা প্রাণী ঘরে রাখতে পারেন। রোজকার কাজের শেষে রাতে পরিবারের সবাই মিলে বিনোদনমূলক খেলায় সময় কাটাতে পারেন। সুখে-দুঃখে সন্তানের পাশে থাকুন, কখনো জড়িয়েও ধরুন। ছুটির দিনে সন্তানকে ঘুরতে নিয়ে যান। দূরে কোথাও না হলেও সপ্তাহের অন্তত একটি দিন বাড়ির কাছেই কোনো রাস্তার অভুক্ত কুকুর-বিড়ালকে খাবার দিতে চলুন সন্তানের হাত ধরে।
নিজে যদি আসক্ত থাকেন, সন্তানকে শোধরাবেন কী করে? ঘুম থেকে উঠেই ডিজিটাল স্ক্রিনে চোখ রাখবেন না। ঘুমাতে যাওয়ার সময়ও ডিজিটাল ডিভাইস সঙ্গে নেবেন না, অ্যালার্মের বাহানায়ও নয়। প্রয়োজনে অ্যালার্ম ঘড়ির দিন ফিরিয়ে আনুন। খাওয়ার সময় ডিজিটাল ডিভাইস সঙ্গে রাখবেন না। ‘সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম মুক্ত এলাকা’ সৃষ্টি করতে পারেন বাড়িতে। এটি হতে পারে বইয়ের লাইব্রেরিতে। পরিবারের সঙ্গে ঘুরতে বেরিয়ে মুঠোফোনে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উৎসুক দৃষ্টি রাখবেন না। নানান ভঙ্গিতে ছবি তুলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সেগুলো ‘পোস্ট’ করা আর খানিকক্ষণ পরপর ‘লাইক’ আর ‘কমেন্ট’ দেখার বদভ্যাস পরিত্যাগ করতেই হবে। নিজে নিয়মগুলো মানুন। সন্তানকেও উৎসাহ দিন। আবার আত্মীয়-পরিজন-প্রতিবেশীর সঙ্গে দেখা হলে অনেকেই সন্তানদের মধ্যে তুলনামূলক আলোচনা শুরু করে দেন। এমন নেতিবাচকতা ওদের করে তুলতে পারে ‘ঘরকুনো’ এবং ডিভাইসনির্ভর। কখনো আপনার সন্তানকে কেউ ‘হীন’ বলে চিহ্নিত করতে চেষ্টা করলে তাঁকে সে সুযোগ দেবেন না। ভদ্রভাবে বুঝিয়ে বলুন যে তাঁর ধারণা ভুল। কারণ, প্রতিটি শিশু, প্রতিটি কিশোর তার নিজের গুণে অনন্য। কখনোই সন্তানকে তিরস্কার করবেন না।
আত্মিক পরিশুদ্ধতায় বেড়ে ওঠা
সন্তানকে পারিবারিক মূল্যবোধের শিক্ষা দিন ছোটবেলা থেকে। ‘এখন ছোট, বোঝে না। বড় হলে বুঝেশুনে সঠিক কাজটিই করবে’ এমন ভাবনা ভুল। ছোট্টবেলা থেকে সামান্য কারণে মিথ্যা বললে একসময় মিথ্যার জালে আটকে পড়বে আপনার সন্তান। সন্তানকে অনলাইন কনটেন্ট দেখতে দিলেও সেটি তার বয়সের উপযোগী কি না, তা জেনে নিন। প্রকৃতির কোলে কয়েকটি দিন কাটিয়েও আসতে পারেন সময়-সুযোগ মিললে। যা হতে পারে ‘সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম মুক্ত সপ্তাহ’।
সূত্র: ফেমিনা