২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর রাত ১২টা। সেই সময় কেবল ঢাকার নয়, সারা বাংলাদেশের আকাশে তারা হয়ে উড়েছে হাজার হাজার ফানুস। মহামারিকালের সব থেমে থাকাকে বিদায় জানিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফেরার তীব্র তাড়না প্রকাশিত হয়ে পড়েছে উড়ন্ত ফানুশের ভেতর দিয়ে। সেই তাড়না দেশের ফ্যাশনের ক্ষেত্রেও সমানভাবে প্রযোজ্য। আন্তর্জাতিকভাবে ফ্যাশন দুনিয়ার জন্য ২০২১ সাল ছিল স্বাভাবিক ছন্দে ফেরার বছর। আর সেই ছন্দে শামিল হয়েছে বাংলাদেশও।
বিশ্ব ফ্যাশনে ট্রেন্ডি একটা শব্দ হয়ে দাঁড়িয়েছে টেকসই ফ্যাশন। অবশ্য বাংলাদেশের নিম্নবিত্ত আর নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষ আগে থেকেই রিসাইকেল (পুনর্ব্যবহার), আপসাইকেল (পুরোনোকে নতুন করে ব্যবহার) আর টেকসই ফ্যাশনে বিশ্বাসী। শাড়ি কেটে জামা বানানোর সংস্কৃতি আমাদের বহু পুরোনো। আবার পুরোনো শাড়ি, ওড়না দিয়ে কাঁথা বানিয়ে ফেলা হয় হরহামেশাই। উচ্চবিত্ত ফ্যাশনেও এখন ঢুকে পড়েছে এই রিসাইকেলের ধারণা। বাংলাদেশে প্রায় সব শ্রেণির মধ্যে সমান জনপ্রিয় ‘থ্রিফট শপিং’ (রিসাইকেল বা আপসাইকেল করা পোশাক কেনাবেচা)।
নব্বইয়ের দশকে যা ছিল বঙ্গবাজারের নিজস্ব সংস্কৃতি, তা এখন চলে এসেছে অনলাইনে। শীতের শপিংয়ের একটা বড় অংশজুড়ে রয়েছে থ্রিফট শপিং। প্রায়ই চোখে পড়ে গাড়ি থেকে নেমে উচ্চমধ্যবিত্ত আর উচ্চবিত্তরা রাস্তার পাশে ভ্যানের ওপর থেকে আপসাইকেল বা রিসাইকেল করা পোশাক কিনছেন। এগুলো তো আছেই, এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ‘চল’, ‘যাত্রা’, ‘কিউরিয়াস’-এর মতো নামকরা সব ব্র্যান্ড। তাদের একটা কর্নার থাকে এসব পোশাকের জন্য।
ওভারকোট এ বছর সারা বিশ্বেই রয়েছে ট্রেন্ডে। বাংলাদেশও ব্যতিক্রম নয়। এই শীতে যশোরের কালেক্টরেট মার্কেট ঘুরেও দেখা গেল, ক্রেতাদের মনোযোগের একটা বড় অংশ রয়েছে ওভারকোটের ওপর। অবশ্য এর কারণ আছে। ইতিমধ্যেই তাপমাত্রা কমে ১৮ থেকে ২২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে ওঠানামা করছে। আরও কঠিন শীতের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে এই শহর।
গরমে ট্রেন্ডে ছিল ঢোলা জিনস আর কর্ড প্যান্ট। আর সেই ঢোলা জিনস যদি হয় ছেঁড়াফাটা, তাহলে তো কথাই নেই! ওভারসাইজড ড্রেসও আছে। এখন মানুষ আঁটোসাঁটো পোশাক ছেড়ে হাত বাড়াচ্ছে আরামদায়ক, স্বস্তিদায়ক পোশাকের দিকে। আড়ং, তাগা, ইয়েলোতে ম্যাটারনিটি কালেকশনের সামনে ভিড় বেড়েছে সাধারণ তরুণীদের। তাঁদের মতে, ওভারসাইজের জন্য ম্যাটারনিটি কালেকশনগুলোই সেরা।
ভিনটেজ পোশাক, শার্টে ফুলেল নকশা, স্কার্ফের নানান ব্যবহার, শর্টস, মিডি ড্রেস মহামারির আগে থেকেই ছিল ট্রেন্ডে। নতুন স্বাভাবিকতায় এগুলো আরও বেশি করে দৈনন্দিন জীবনযাপনের অংশ হয়েছে।
উৎসবের রং হিসেবে এখনো এক নম্বর অবস্থান থেকে নামেনি লাল। দুর্গাপূজায় একাধিক মণ্ডপ ঘুরে এমনটাই চোখে পড়েছে। আর শাড়ির সঙ্গে মিলিয়ে পাঞ্জাবি অথবা কোথাও ট্যুরে গেলে ‘কাপল’দের মিলিয়ে পোশাক পরা ছবি এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আগের চেয়ে অনেক বেশি। মহামারিকালে ফ্যাশন আর খাবারদাবারের ক্ষেত্রে অনলাইন ব্যবসা ব্যাপক জনপ্রিয়তা পাওয়ায় ‘কাস্টমাইজড’ করে পোশাক বানানোর প্রবণতাও বেড়েছে। বেড়েছে একটু বড় ব্যাগ, টোট ব্যাগ ব্যবহারকারীর সংখ্যা।
সময়ের সঙ্গে জনপ্রিয়তার পারদ বেড়েই চলেছে কফি কালচারের। গ্লোরিয়া জিনস, বারিস্তা, নর্থ অ্যান্ড, আপন কফি শপ, কিভা হ্যান, ক্রিম দে লা ক্রিম ছাড়াও পাড়ার মোড়ের কফি শপেও ভিড় লক্ষণীয়। সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত খিলগাঁওয়ের রাস্তায় একবার ঢুঁ দিলেই এর প্রমাণ মেলে।
বিয়েতে এখন শাড়ির পাশাপাশি লেহেঙ্গা, এমনকি গাউনও আছে ট্রেন্ডে। ব্যাচেলর পার্টি, ব্রাইডাল শাওয়ার, মেহেদি নাইটস, সংগীত—এগুলোও পালন করা হচ্ছে ঘটা করে। বিয়ের অনুষ্ঠানের জন্য মাস ধরে চলে গান ও নাচের মহড়া। প্রি ওয়েডিং ফটোশুট (বিয়ের আগে ঘটা করে ছবি তোলার আয়োজন) ও পোস্ট ওয়েডিং ফটোশুটও (বিয়ের পর সধারণত বর-বউয়ের ডেস্টিনেশন ফটোশুট বা কোথাও গিয়ে ঘটা করে ছবি তোলার অনুষ্ঠান) ট্রেন্ডে। তবে মহামারিকাল পেরিয়ে বিয়ের আয়োজন সংক্ষিপ্ত পরিসরে করাটাও পাশাপাশি রয়েছে ট্রেন্ডে। জনপ্রিয় হচ্ছে ‘ডেস্টিনেশন ওয়েডিং’ও।
মেকআপের ক্ষেত্রে সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে শহরাঞ্চলে ‘নো মেকআপ মেকআপ লুক’টাই রয়েছে ট্রেন্ডে। গ্রামে অবশ্য মেকআপটা ঠিক চোখে না লাগলে সেটাকে মেকআপ বলে ধরা হয় না।
সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে। তাই ভ্রমণ আর অন্দরসজ্জা এখন জীবনযাপনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। সাধারণ মানুষ এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি স্বাস্থ্যসচেতন। অবশ্য এর পেছনে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের পাশাপাশি বড় ভূমিকা রেখেছে করোনা। এখন মানুষ কম তেল, কম চিনি আর সবজি খাওয়ার দিকে ঝুঁকেছে। স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনের প্রতি আগ্রহ বেড়েছে সাধারণ মানুষের।