২০১৯ সাল। যুক্তরাষ্ট্রে মিস ইউনিভার্সের মঞ্চে বাংলাদেশের লাল জামদানি আর রিকশাচিত্রকে তুলে ধরে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন শিরিন শিলা। দেশি ঐতিহ্যর প্রতি তাঁর এই ভালোবাসা যে স্রেফ লোক দেখানো নয়, আবারও তার প্রমাণ পাওয়া গেল। টিএসসির চায়ের দোকানগুলো রিকশাচিত্রে রাঙিয়ে তুলছেন তিনি।
কীভাবে একটু একটু করে পরিকল্পনাটা ডানা মেলল, শোনালেন মিস ইউনিভার্স বাংলাদেশ ২০১৯, ‘উন্নত দেশগুলো দেখুন। তাঁদের ক্যাফেগুলো খুব সুন্দর করে সাজানো। এসব দোকানই সেখানকার মানুষের গল্প করার জায়গা। তেমনি টংয়ের দোকানগুলো আমাদের দেশের সব ধরনের মানুষের যাওয়া–আসার জায়গা। বাঙালি মানেই তো চা, টঙের আড্ডা। প্রতিটি অলিগলিতে দেখা যায় এমন টং। সেখানেও সংস্কৃতির কিছু ছোঁয়া লাগানো প্রয়োজন। অন্যদিকে এখন সেভাবে আর রিকশা আর্ট চোখে পড়ে না। অথচ এটা আমাদের সংস্কৃতির অংশ। আর এই সবকিছু মিলিয়েই চা আর রিকশাচিত্র নিয়ে কাজ করার আগ্রহ জাগে। অনেক বড় মঞ্চে আমাদের শিল্পকে হয়তো তুলে ধরতে পারছি না। কিন্তু মানুষের দৈনন্দিন জীবনে তো রিকশাচিত্রকে নিয়ে আসতে পারছি। সেই ভাবনা থেকেই আমাদের এই ছোট্ট প্রয়াস।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কাছে ছাত্র–শিক্ষক কেন্দ্র (টিএসসি) তো নিজের ঘরের আঙিনার মতো। এখানে মনের মতো কাজ করা যাবে, সবার সহায়তা পাওয়া যাবে—তাই টিএসসির চায়ের দোকানগুলো রাঙানোর কার্যক্রম দিয়েই শুরু হয়েছে শিলার প্রকল্প। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে পড়ছেন এই মডেল-অভিনেত্রী। পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্রী হয়ে রং আর তুলির এই বিশাল কর্মযজ্ঞের ভার নেওয়া সহজ ছিল না। কে কে ছিল তাঁর সঙ্গী? শিলা বলছিলেন, ‘আমার মতো পাগলের পাল্লায় পড়ে আমার দুই বন্ধু ফেঁসে গেছে। চারুকলার ড্রয়িং বিভাগের সিন্থি, আর ফিজিকসের সীমান্ত। তা ছাড়া এই শিল্পের জন্য যথেষ্ট দক্ষ হাতের প্রয়োজন। পুরান ঢাকার অভিজ্ঞ রিকশা আর্টিস্ট পাপ্পু ভাইকে ভাগ্যক্রমে পেয়ে যাই। তিনি ছয়জনের একটি দল নিয়ে আসেন।’ প্রথম দিনের কাজে বেশ কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। চায়ের টঙের ওপরে ময়লা, পোস্টার—সব নিজ হাতে পরিষ্কার করতে হয়েছে। এরপর রঙের কাজ। শিলা জানান, শুরুতে অনেকে হাত লাগিয়েছিল। রাত পর্যন্ত টিকে ছিলেন পাঁচজন। তবে উদ্যমের কমতি ছিল না। তিন রাত নির্ঘুম কাজ করে গেছেন তাঁরা। শিলা বলছিলেন, ‘দিন শেষে টংয়ের মামাদের মুখের হাসি দেখে মনে হয়েছে—কষ্ট সার্থক।’
পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্রীর মাথায় রিকশাচিত্রের পোকা ঢুকল কী করে? শীলা বললেন, ‘পদার্থবিজ্ঞান তো শুধু একটা বিষয় নয়। আমাদের চারপাশের সবকিছুই ফিজিকস দিয়ে বর্ণনা করা যায়।’ পড়ার বিষয় হিসেবে পদার্থবিজ্ঞান যে তাঁর ভালো লাগে না, তা নয়; তবে এখনো জীবনের লক্ষ্য খুঁজছেন তিনি। এই মডেল-অভিনেত্রী বললেন, ‘সাঁতার শিখেছি, নাচ শিখেছি—এত দিন যা যা করার সৌভাগ্য হয়নি, একে একে সব করছি। লোকশিল্পেই আপাতত আমার বেশি মনোযোগ। যদি কোনো বড় প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে কাজ করার সুযোগ পাই, তবে অবশ্যই নিজেকে ভাগ্যবান মনে করব।’
প্রশাসনের অনুমতি পেলে এরপর শাহবাগ, ধানমন্ডি, বনানী, গুলশান—সব জায়গাতেই রিকশাশিল্পের ছবি ছড়িয়ে দিতে চান তিনি। শিলা বলছিলেন, ‘আরেক ধরনের লোকজ চিত্রকলা আছে। নাম গাজীর পট। সেটা নিয়েও কাজ করার ইচ্ছা আছে। দেশের অভিজাত এলাকাগুলোতে অনেক বিদেশি আনাগোনা করেন, যাঁরা জানেন না আমাদের দেশের লোকশিল্প কেমন। আমার ইচ্ছা, দেশি-বিদেশি সবাই জানুক এটা আমাদের সংস্কৃতি, আমাদের গৌরব। সেই চিন্তা থেকেই আমার স্বপ্ন—বাংলাদেশে যতগুলো চায়ের টং আছে, সব কটিতে রিকশা আর্ট করব।’