ঝড়ে ডুবে গেল নৌকা, তারপর?

আজ জুন মাসের তৃতীয় রোববার, বাবা দিবস। বিশেষ এই দিবস উপলক্ষে পাঠকের কাছে লেখা আহ্বান করেছিল গোদরেজ প্রটেক্ট ম্যাজিক হ্যান্ডওয়াশ ও প্রথম আলো অনলাইন। ‘বাবা, তোমাকে বলা হয়নি’ শিরোনামে বিপুলসংখ্যক পাঠক লিখেছেন তাঁদের মনের কথা। নির্বাচিত লেখাগুলোর একটি প্রকাশিত হলো এখানে।

শুরু হলো বিরামহীন ঝড়ঝঞ্ঝা...

আকাশে ঘন কালো মেঘ করেছে। যেকোনো সময় ঝড়-বৃষ্টি আসার আশঙ্কা প্রবল। আব্বা এর মধ্যেই বের হচ্ছেন গঞ্জে যাওয়ার জন্য। আব্বার চালের ব্যবসা। কমপক্ষে এক বস্তা চাল না আনলে পরের দিন বহরপুর হাটে বসা হবে না। আর হাটে না গেলে খাবারদাবারের ব্যবস্থাও হবে না। তবু দাদি অনেকবার যেতে নিষেধ করলেন। ‘ওরে ছোট যাসনে। একদিন হাট না করলে আমরা মরে যাব না।’ আব্বা শত নিষেধ উপেক্ষা করে বের হলেন। আকাশ মেঘডম্বর মুখ করে রইল সন্ধ্যা পর্যন্ত। আব্বা গঞ্জ থেকে এক বস্তা চাল কিনে নিয়ে নৌকায় রওনা দিলেন। খুব তাড়াতাড়ি বাড়ি পৌঁছাতে হবে। শুধু মাঝখানে পাড়ি দিতে হবে তালপাহাড়ির বিল। আব্বা বিলের ঠিক যখন মাঝামাঝি এলেন, তখন প্রচণ্ড আর্তনাদে কেঁপে উঠল আকাশ। শুরু হলো বিরামহীন ঝড়ঝঞ্ঝা। চারপাশে ঘুটঘুটে অন্ধকারে হতে দেখে মাঝি খেই হারিয়ে ফেললেন। হাত থেকে বইঠা ছুটে গেল।

ঢেউয়ের দাপটে নৌকার দুলুনি বাড়তে থাকে। নৌকায় আরও যে দু-তিনজন ছিল, তারা চিৎকার করে গ্রামের মানুষের সাহায্য চাইতে শুরু করল। কিন্তু উল্টো দিকের বাতাসে কোনো আওয়াজই আর গ্রামের দিকে যাচ্ছিল না। আব্বা সবাইকে সাহস দিলেন—কিচ্ছু হবে না, আল্লাহকে ডাকো।

নৌকা যে কোথায় চলে যাচ্ছে তার কোনো হদিস নেই। আব্বা চালের বস্তাটাকেও আগলে রাখলেন যক্ষের ধনের মতো। হঠাৎ সব সান্ত্বনা মিথ্যে করে দিয়ে নৌকা অকস্মাৎ ডুবে গেল। আব্বা ডুবে গেলেন পানির গভীর থেকে গভীরে। এই প্রথমবার মৃত্যু এত সন্নিকটে। দূর থেকে ভেসে আসা চিৎকারের আওয়াজ শোনা যায়। চারদিকে শুধু বাতাস, বৃষ্টি আর পানির শোঁ শোঁ শব্দ। আব্বা অনেক কষ্টে সাঁতরে ডুবে যাওয়া নৌকার ওপর দাঁড়ালেন। সঙ্গীদের জড়ো করলেন। প্রায় আধা ঘণ্টা এমন তাণ্ডবলীলা চলার পর ঝড় কমল। আব্বা পানিতে ডুবে যাওয়া চালের বস্তা খুঁজে বের করলেন। বহু কষ্টে প্রায় আধমরা অবস্থায় বাড়ি ফিরলেন।

এরই মধ্যে নৌকাডুবির খবর রটে গেছে গ্রামে। আমাদের বাড়িতে আব্বার জন্য সবার কলিজা শুকিয়ে গেছে। দাদি ছেলেকে জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ হাউমাউ করে কাঁদলেন। যেন মৃত ছেলে জীবিত হয়ে বাড়ি ফিরেছে। চালের বস্তা ভিজে প্রায় ভাত হয়ে গেছে। মা সারা রাত সেই ভেজা চাল চুলায় ভাজলেন। পরদিন সেই ভাজা চাল নিয়ে আব্বা হাটে গেলেন। খারাপ আবহাওয়ায় কোনো ব্যবসায়ীই চাল আনতে পারেনি বলে বিশ মিনিটের মধ্যেই চাল বিক্রি শেষ হয়ে গেল। আব্বার চোখেমুখে সে কি তৃপ্তির হাসি! যেন গত রাতে কিছুই ঘটেনি। অনেক ভালো বেচাকেনা হয়েছে। এবার ঠিকই একটা টিনের ঘর উঠবে বাড়িতে।

আব্বা বাড়ি ফিরলেন। মায়ের অগোচরে নিজেদের জন্য রাখা চাল নিয়ে দিয়ে এলেন মৃধা কাকাদের বাড়িতে। গত দুই দিন তাঁদের বাড়িতে হাঁড়ি জ্বলে না। মা রাতে রান্না করার সময় দেখেন ঘরে কোনো চাল নেই। আব্বা সব বুঝিয়ে বললেন মাকে, ‘আমাদের জন্য কয়েকটা রুটি বানাও, তাতেই হবে। মৃধাদের বাড়িতে সবাই না খেয়ে আছে।’

মা বুঝতে পেরে চুপ করে থাকেন। খাবার সময় আব্বা বড় আপাকে বলেন, ‘রুটি খুব শক্তিদায়ক খাবার। তাই নারে খুশি?’ আপার রুটি পছন্দ না। তবু মাথা নেড়ে বলে, ‘হুম।’ মা শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মোছেন আর পিতা-কন্যার এই কঠিন সত্য গল্পকে সমর্থন করে চলেন।

এমনই এক সৎ, সাহসী পিতার গর্বিত সন্তান আমি। আব্বা আজও পথ চলেন বীরদর্পে। মিথ্যের কাছে মাথা নোয়ানো তাঁর অভিধানে নেই। আমাদেরও দিয়েছেন সেই শিক্ষা। আমি গর্বিত এমন বাবার সন্তান হতে পেরে। যে কথাটা কখনোই বলা হয়নি, ‘আব্বা, আপনাকে অনেক ভালোবাসি। আপনি হাজার বছর বেঁচে থাকেন আমার মাথার ওপর বটবৃক্ষের ছায়া হয়ে।’