>তিরন্দাজ রোমান সানা। দেশের হয়ে আটটি আন্তর্জাতিক সোনা জয় করেছেন। সর্বশেষ ১৫ সেপ্টেম্বর, ফিলিপাইনে এশিয়ান র্যাঙ্কিং আর্চারিতে রিকার্ভ ইভেন্টের ফাইনালে সোনা জিতেছেন রোমান। যাঁর জয় নিয়ে ক্রীড়াঙ্গনে এত আলোচনা, সেই রোমান সানার মা–বাবা কী ভাবছেন। মা বিউটি পারভীন আর বাবা আবদুল গফুর সানা শোনালেন রোমানের বেড়ে ওঠার কথা, দুঃসময়ের দিনগুলোর কাহিনি।
বাড়ির বসার ঘরটায় টেবিলের ওপর সারি সারি পত্রিকার কাটিং। আগের দুদিন এই পরিবারের ছোট ছেলেকে নিয়ে সচিত্র প্রতিবেদন বেরিয়েছে সব জাতীয় ও স্থানীয় পত্রিকায়। প্রাণখুলে সেসব দেখে আনন্দে আত্মহারা আবদুল গফুর সানা ও বিউটি পারভীন। জীবনের দুর্গম পথ পেরিয়ে তাঁদের সব কষ্ট আজ অনেকটা সফল। মনের দুঃখ উড়ে গেছে বাষ্প হয়ে।
রোমান সানার মতো সন্তান থাকলে এমনই তো হওয়ার কথা। মা-বাবার জীবনে সুখের ফুল ফুটবেই। খুলনা শহরের তালতলায় ভাড়া করা ছোট্ট বাসায় গিয়ে ১৭ সেপ্টেম্বর সেই ফুলের সুবাসই যেন মিলল। মনে হলো, আজ আর তাঁরা জীবনের নানা জটিল অঙ্কের জালে বন্দী নন। জীবনকে দেখছেন নতুন আয়নায়।
সুযোগটা করে দিয়েছেন তাঁদেরই কৃতী ছেলে রোমান সানা। যাঁকে তাঁরা ডাকেন সুজন নামে। দেশের সেরা আর্চারের এ পর্যন্ত আটটি আন্তর্জাতিক সোনাজয় পরিবারের দুঃখ ঘুচিয়েছে অনেকটা। শুরুটা গত ১৩ জুন হল্যান্ডে বিশ্ব আর্চারি চ্যাম্পিয়নশিপে রিকার্ভ ইভেন্টে ব্যক্তিগত ব্রোঞ্জজয়ের মধ্য দিয়ে। গলফার সিদ্দিকুর রহমানের পর বাংলাদেশের দ্বিতীয় খেলোয়াড় হিসেবে অলিম্পিক গেমসে খেলার যোগ্যতা মান অর্জন করেছেন। খেলবেন ২০২০ টোকিও অলিম্পিকে। সর্বশেষ ১৫ সেপ্টেম্বর ফিলিপাইনে এশিয়ান র্যাঙ্কিং আর্চারিতে রিকার্ভ ইভেন্টের ফাইনালে চীনের লি শি ঝেনঝিকে ৭-৩ ব্যবধানে হারিয়ে তাঁর সোনাজয় দেশের ক্রীড়াঙ্গনে এখন তুমুল আলোচিত। দেশের রুগ্ণ ক্রীড়াঙ্গনে এটিকে ব্যক্তিগত সেরা সাফল্য বলছেন অনেকে।
খেলার জগতে নিজের শরীর আর মনকে সুশাসনে রেখে রোমান এগিয়েছেন নিজের যোগ্যতায়। পরিবার ছিল পাশে। তবে পরিবারের কর্তা গফুর সানার জীবনের গল্পটা সংগ্রামমুখর।
২০০৭ সালে খুলনা অঞ্চলে ছোবল হানা ঘূর্ণিঝড় সিডরের আঘাতে অজানা ঠিকানার উদ্দেশে বাড়ি ছাড়ে সানা পরিবার। গফুর সানা বলতে থাকেন, ‘সেই ঝড়ে আমি সব হারায়ে ফেলি। আমার মাটির ঘরসহ সব ভেঙে গেলে বাড়ির সামনে চাচাদের ঘরে আশ্রয় নিলাম। সাত কি আট মাস পর তিন ছেলেমেয়ে নিয়ে আমরা শূন্য হাতে শহরে চলে আসি। গ্রামে তখন রোজগার ছিল না। আমি বাস্তুহারা। ১৫০ টাকায় গোলপাতার ছোট্ট একটা বাসা নিই। ২৫ টাকা দিয়ে একটা চাটাই কিনি। ১৫০ টাকায় একটা চৌকি।’
স্বামীর পাশে বসে বিউটি পারভীন তখন ছেলের সব পদক নাড়াচাড়া করছিলেন সযত্নে। ছোট ভাইয়ের সাফল্যে উদ্বেলিত বড় ভাই বিপ্লব সানাও পাশে বসেন। বিপ্লবের ছোট্ট ছেলে জিয়া সানা ‘আমিও কাকুর মতো তির–ধনুক নিয়ে খেলব’ বলে ওঠে হঠাৎ। হেসে ওঠেন সবাই। বিপ্লব বলেন, ‘রোমানের চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ। ছোটবেলায় ও প্রচুর মার্বেল খেলত।’ ওদিকে বাবার চোখের রাডারে ছোটবেলাতেই ধরা পড়ে গেলেন রোমান, ‘ছোটবেলায় চঞ্চল ছিল রোমান। গুলতি দিয়ে আম পাড়ত। তখনই কেন যেন মনে হতো, একদিন ও বড় কিছু করবে।’
২৪ বছর বয়সেই সেটি করেছেন রোমান। তাই আজ গফুর সানার আকাশে সুখপাখির আনাগোনা। কষ্ট আর অনটনের স্মৃতিটা তাঁকে এখন বরং আনন্দ দেয়। ‘অফিসে গেলে লোকজন বলে, মিষ্টি কই?’ গফুর সানার মুখে কথায় বেশ শোনায়। অনেক বছর ধরে মাছ রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান খুলনা রাজু ফিশ ট্রেডার্সে চাকুরে গফুর সানা আজ তৃপ্ত। মাছ ভালো কি না, এসব তদারকির কাজটা তাঁকে করতে হয় বেলা তিনটা থেকে ভোর পর্যন্ত।
তিন হাজার টাকায় শুরু। এখন বেতন সাকল্যে ছয় হাজার। এক–দেড় হাজার টাকা যাতায়াত খরচ পান। ‘তবে দুই হাজার টাকা তো আমার পান খাতিই চলি যায়। আর কোনো কিছু খাই না।’ গফুর সানা হেসে বলেন। বড় ছেলের চাকরিও খুলনায় একটা মাছ রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানে। ভাতাসহ তিনি প্রায় ৯ হাজার টাকা পান। বাংলাদেশ আনসারে চাকরির সুবাদে রোমান কিছু টাকা দেন সংসারে। তাতে ঘরভাড়া (ছয় হাজার), মায়ের চিকিৎসা খরচ চলে। বাবার টাকায় সংসারের বাজার হয়। কিন্তু এমন টানাটানি আর শিকলে বাঁধা ৫৪ বছরের এই জীবনে আজ অনেক আনন্দ।
দুই বছর আগে বাড়িতে একটা ঘর তৈরি করেছেন মাটির, কিন্তু টাকার অভাবে বেড়া দিতে পারেননি। ছাউনি দিয়েছেন গোলপাতা দিয়ে। বাড়িটা খুলনা জেলার কয়রা থানার বাদালী ইউনিয়নে বাদালী গ্রামে। ঘুঘরাকাতী বাজার থেকে পাঁচ–ছয় কিলোমিটার দূরে। যেখানে বর্ষায় রোমান যেতে পারেন না রাস্তা কাদায় থিকথিকে থাকায়। সাইক্লোন শেল্টারের পাশে বাদালী প্রাথমিক স্কুলে পড়ার সময় বড় মাঠটায় খেলাধুলা করত ছোট্ট রোমান সানা। সানা নামটা বংশপরম্পরায় পাওয়া। রোমানের দাদা মৃত সদর উদ্দিন সানা, দাদার বাবা মৃত আনসার উদ্দিন সানা।
সেসব স্মৃতিচারণার ফাঁকে গর্বিত মা বলেন, ‘রোমান এশিয়ার শ্রেষ্ঠ হয়েছে। খবরটা শুনে আমি কাদতি কাদতি অসুস্থ হয়ে গেছি। আমি সব সময় অসুখে পড়ে থাকি। ১৩ বছর ধরে চিকিৎসা চলছে। ইনসুলিন নিতে হয়, েস খরচ লাগে। বিভিন্ন ওষুধ খেতে হয়। আমার সামর্থ্য নেই। কিন্তু তিন ছেলেমেয়েকে সুপথে রেখেছি। এটাই আজ আমার বড় সুখ।’ ১৭ সেপ্টম্বের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবনে রোমান সানাকে মিষ্টিমুখ করান। তখন রোমানের মায়ের চিকিৎসার দায়িত্ব নেন তিনি।
দুরন্ত কোনো নদীর মতো বয়ে চলা এই জীবনে সানা পরিবার সুখী। কিন্তু পেছনে অনেক কষ্টের গল্প। নিঃশব্দে গফুর সানা বলেন, ‘খুলনা শহরে এসে তিনটা বাসা বদল করি আগে। রোমান চাকরি করার পর চার মাস আগে একটু ভালো বাসায় উঠেছি।’ বাসা নিয়ে একটা স্মৃতি ভোলেন না, ‘খুলনা শহরে প্রথমে দেড় শ টাকায় ছোট্ট একটা বাসায় উঠি। দেড় শ টাকা করে একটা চৌকি আর একটা হিটার কিনি। জ্বলন্ত হিটারে একবার হাত ঢুকিয়ে দেয় ছোট্ট রোমান। পাশে তালতলা হাসপাতালে নিতে হয় ওকে। ওর বুড়া আঙুলে এখনো পোড়া দাগটা আছে।’
৬০০/৭০০ বর্গফুটের এ বাসার দুটি ঘরের একটিতে মা–বাবা, অন্যটিতে ভাই-ভাবি থাকেন। রোমান এলে থাকার জায়গা নিয়ে ভাবতে হয়। আর রোমানের সব পুরস্কার, ৪০-৪৫টি পদক, সনদ—সব টিভি ট্রলির ভেতর।
খেলাটা রোমানের খুব পছন্দ। কতটা? বিউটি পারভীন বললেন, ‘এসএসসি পরীক্ষার প্রথম দিন আজানের সময় দেখি, ও বাসায় নেই। পরে শুনি সার্কিট হাউস মাঠে গেছে ক্রিকেট খেলতে।’ আজও মুগ্ধতা মায়ের কণ্ঠে। সেই ক্রিকেট ছেড়ে রোমান আর্চার হলেন বাংলাদেশ আর্চারি ফেডারেশনের উদ্যোগে স্থানীয় স্কুলে আর্চারির এক বাছাইয়ে টিকে। সবাই আজ তাঁকে নিয়ে গর্বিত।
জমি বন্ধক
২০১২ সালে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় আহত হন রোমান। খুলনা পঙ্গু হাসপাতালে ১ মাস ১৩ দিন কাটে। ভাইকে তখন বলেছিলেন, ‘আমার তো লাইফ শেষ।’ কিন্তু উঠে দাঁড়িয়ে ২০১৩ সালে বাংলাদেশ গেমসে পেলেন জীবনে প্রথম সোনার পদক। সেই সময় ছেলের চিকিৎসার টাকার চিন্তায় গফুর সানার জীবন হয়ে ওঠে তপ্ত মরুভূমির মতো। পৈতৃকসূত্রে একটা তালগাছ আর ১০ কাঠা জমি পান। গাছটা বিক্রি করেন। জমি বন্ধক দিয়ে নেওয়া ১২ হাজার টাকা এখনো শোধ দিতে পারেননি। গফুর সানা বলেন, ‘ছেলে বাড়ি এলে বলেছি, তোমার পা ভাঙার সময় জমি বন্ধক দিয়ে নেওয়া টাকাটা এখনো ফেরত দিতে পারিনি। ও বলেছে, আব্বা, চিন্তা করবেন না, আমি খেলে আসি।’
রোমান সানার আন্তর্জাতিক পদক
সোনা একক
২০১৯ এশিয়া কাপ বিশ্ব র্যাঙ্কিং টুর্নামেন্ট, ফিলিপাইন
ব্রোঞ্জ একক
২০১৯ বিশ্ব আর্চারি চ্যাম্পিয়নশিপ, নেদারল্যান্ডস
রুপা একক
২০১৯ আইএসএসএফ আন্তর্জাতিক
সলিডারিটি বিশ্ব র্যাঙ্কিং আর্চারি, ঢাকা
সোনা দলগত ও মিশ্র দলগত
২০১৮ আইএসএসএফ আন্তর্জাতিক
সলিডারিটি আর্চারি, ঢাকা
২টি সোনা দলগত ও রুপা একক
২০১৮ দক্ষিণ এশিয়ান আর্চারি, ঢাকা
সোনা একক
২০১৭ বিসকেক আন্তর্জাতিক আর্চারি, তুর্কিস্তান
সোনা দলগত ও মিশ্র দলগত
২০১৭ প্রথম আইএসএসএফ আন্তর্জাতিক
সলিডারিটি আর্চারি, ঢাকা
সোনা একক
২০১৪ প্রথম এশিয়ান আর্চারি গ্রাঁ প্রি, থাইল্যান্ড
রুপা দলগত
২০১১ প্রথম এশিয়ান যুব আর্চারি, ঢাকা