তৃণমূল পর্যায়ের নারীদের মধ্যে পরিচালিত সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা যাচ্ছে, অংশগ্রহণকারী নারীদের ৬১ দশমিক ২ শতাংশ অর্থনৈতিক মুক্তি পেয়েছেন। কিন্তু অর্থনৈতিক মুক্তি এলে হবে কি, জীবনে সহিংসতা থেকে মুক্তি পাননি এই সব নারী। সহিংসতা প্রতিরোধে রাষ্ট্রীয়ভাবে জেন্ডার বাজেটেরও সুনির্দিষ্ট ব্যবহার নেই। বেসরকারি সংস্থা প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের গবেষণায় এমনটাই উঠে এসেছে। বাল্যবিবাহ, নারীর বৈবাহিক ধর্ষণ, যৌতুক এবং কর্মক্ষেত্রে নারীর অধিকার বিষয়ে যে আইনি চ্যালেঞ্জগুলো রয়েছে, তা এই গবেষণার মূল বিষয়। গবেষণার আলোকে তারা ‘লিগাল ফ্রেমওয়ার্ক অ্যানালাইসিস অন চ্যালেঞ্জিং ফিয়ার অব ভায়োলেন্স’ শীর্ষক প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে।
ঘর থেকে বের হয়ে পোশাকশিল্প, কারখানা কিংবা পরিষেবা খাতে কাজ করে নিজের জীবনের মোড় ঘুরিয়েছেন নারীরা। এর মাধ্যমে তাঁরা অসময়ে নিজের বিয়ে ঠেকানো, ভূমিহীনতা রোধ, পরিবারকে সমর্থন দিতে সক্ষম হয়েছেন। তবে ঘরের মধ্যে নারীর অবস্থা তেমন বদলায়নি। বিবাহিত নারীদের ৮৭ শতাংশই স্বামীর মাধ্যমে কোনো না কোনো সময়ে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এই সব নির্যাতনের মধ্যে আছে শারীরিক, যৌন, মানসিক ও অর্থনৈতিক নির্যাতন।
প্রশ্ন তোলা হয়েছে, আমাদের প্রচলিত আইন কি এ অনাচার রোধে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে? বাংলাদেশের আইন ভারতের চেয়েও শক্তিশালী। তবে আইনের প্রায়োগিক দিক না থাকায় অনেক ক্ষেত্রেই তা অকার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ (সংশোধিত ২০০৩)-এর ৯(১) ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো পুরুষ কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করে, তবে সে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবে। একই আইনের ৯(২) ধারায় আছে, ‘ধর্ষণ বা ধর্ষণ-পরবর্তী কার্যকলাপের ফলে ধর্ষিত নারী বা শিশুর মৃত্যু ঘটলে ধর্ষকের মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হবে।’
আইনজীবী শাহদীন মালিক বলেন, ‘সমাজে ক্ষমতার ভারসাম্যহীনতা ধর্ষণ বেড়ে যাওয়ার প্রধান কারণ। ধর্ষণের শাস্তির পরিমাণ কমানো হলে বেশির ভাগ অপরাধী শাস্তি পাবে। কঠোর শাস্তির বিধান অপরাধ কমায়—এমন ধারণার কোনো যৌক্তিক ভিত্তি নেই বলে আমি মনে করি।’
৪০টা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে জেন্ডার বাজেটের বরাদ্দের কথা বলা আছে। সেখানে জেন্ডার বাজেট বলে যে টাকাটা ধরা হয়, সেটা কি আসলে সঠিক কাজে খরচ করা হয়? প্রতিবেদনে সেই খরচের স্বচ্ছতা, প্রায়োগিক নানা দিকই তুলে ধরা হয়েছে। একজন নারী যখন সহিংসতার শিকার হন, তখন তাঁকে বিচারের জন্য আইনের সহায়তা নিতে হয়। সেখানে টাকাপয়সার বিষয়টি উঠে আসে। আইনি সেবাদাতা এবং সহিংসতার শিকার নারী-শিশু দুজনেরই দরকার হয় টাকার। এই খরচ জোগাতে না পেরে অনেকে বিচারপ্রক্রিয়া থেকে সরে আসে। রাষ্ট্রীয়ভাবে জেন্ডারে যে বাজেট প্রণয়ন করা হয়, তা থোক বরাদ্দ না দিয়ে সহিংসতা প্রতিরোধের তৃণমূল পর্যায়ে বণ্টন করা হলে নারীর প্রতি সহিংসতা কমে যেত অনেকখানি। তেমন করে বাল্যবিবাহ, কর্মজীবী নারীর কর্মক্ষেত্র থেকে ঝরে পড়াও হ্রাস পাবে। এই বিষয়গুলোই গবেষণার প্রতিবেদনে বিস্তারিতভাবে উঠে এসেছে।
এ বিষয়ে প্ল্যান ইন্টারন্যাশনালের গার্লস রাইটের পরিচালক কাশফিয়া ফিরোজ বলেন, ‘মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়সহ ৪০টি মন্ত্রণালয়ের বাজেটে জেন্ডার বাজেট থাকে। কিন্তু আমরা জানি না যে বাজেটের এই বরাদ্দটা কোন খাতে কতটুকু? সেটা কি শুধু উন্নয়ন-কর্মশালায় সীমাবদ্ধ, নাকি সহিংসতা-বাল্যবিবাহ রোধেও সম পরিমাণ বরাদ্দ আছে? এইখানে সরকারের স্বচ্ছতা জরুরি। তৃণমূল পর্যায়ে প্রতিটি খাতে যখন জেন্ডার বাজেটের সমবণ্টন, বরাদ্দ থাকবে, তখন নারীর প্রতি সহিংসতা, বাল্যবিবাহ অনেক কমে যাবে। আইনের আশ্রয়প্রার্থী নারীর খরচ, বাল্যবিবাহ বন্ধে কিশোরীর পড়াশোনার ব্যয় বহনের মাধ্যমে জেন্ডার বাজেটের উপযুক্ত ব্যবহার হবে। আবার সন্তান লালন-পালনের জন্যও আমাদের শিক্ষিত নারীরা কর্মক্ষেত্র থেকে ঝরে পড়ছেন। জেন্ডার বাজেটের সুষম বরাদ্দে যদি কর্মক্ষেত্রে দিবাযত্ন কেন্দ্র থাকে, তাহলে নারীরাও কর্মক্ষেত্র থেকে ঝরে পড়বেন না। বিষয়গুলো নিয়ে সরকারকে গভীরভাবে ভাবতে হবে।’