১৩ বছরের রিমু ইদানীং খুব জেদি হয়ে উঠেছে। তার ইচ্ছেমতো কোনো কিছু না হলেই ভীষণ রাগ। যখন যা চাইবে না দিলে চিৎকার–চেঁচামেচি, না খেয়ে থাকা; এমনকি ভাঙচুর করতেও দ্বিধা করে না। গতকাল মোবাইল ফোন ব্যবহার কমানোর কথা বলতেই চিৎকার করে বাড়ি মাথায় তোলার অবস্থা। ইদানীং বাবা-মা কোনোভাবেই তার জেদকে সামাল দিতে পারছেন না।
কৈশোরের (সাধারণত ১০ থেকে ১৯ বছর) আবেগের প্রাবল্য, কৌতূহলপ্রবণতা আর স্বাধীনচেতা মনোভাবের কারণে সবকিছু নিজের ইচ্ছেমতো করার ইচ্ছা এবং সেই সঙ্গে অভিভাবকের কঠোর শাসন বা অতিরিক্ত প্রশ্রয় সন্তানের জেদি মনোভাব তৈরি করতে পারে।
জেদ সামলাবেন কীভাবে
জেদে সম্পূর্ণ উপেক্ষা: মনোবিজ্ঞানের একটা সূত্র হলো, যে আচরণ মনোযোগ বা প্রশ্রয় পায়, সেটা বেড়ে যাবে। আর যে আচরণ উপেক্ষিত হবে, সেটি ধীরে ধীরে কমে যাবে। প্রশ্রয় বা মনোযোগ আমরা নানাভাবে দিয়ে থাকি। যেমন, জেদ করলে সে যা চাইছে সেটা পূরণ করার মাধ্যমে, তাকে বকা বা সমালোচনা করার মাধ্যমে, এমনকি অতিরিক্ত বোঝানোর মাধ্যমেও তার জেদকে প্রশ্রয় বা মনোযোগ দিয়ে থাকি।
সুতরাং সন্তানের জেদ কমানোর প্রথম পদক্ষেপ হলো তার অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণ সম্পূর্ণ উপেক্ষা করা অর্থাৎ জেদ নিয়ে কোনো কথা বলা বা প্রতিক্রিয়া না দেখানো। জেদ করে তার কোনো চাহিদা ক্রমাগত উপেক্ষিত হলে ধীরে ধীরে এ আচরণ কমে আসবে।
অগ্রহণযোগ্য আচরণে প্রাপ্য সুবিধা সাময়িকভাবে কমিয়ে দিন
জেদ করে পরিবারের নিয়ম ভঙ্গ করলে (যেমন: ভাঙচুর, গালাগালি, না বলে বাইরে থাকা, গায়ে হাত তোলা, হুমকি দেওয়া) উপেক্ষার পাশাপাশি সাময়িকভাবে তার প্রাপ্য সুবিধা অর্থাৎ তার প্রতি আপনার ভালোবাসার প্রকাশ (যেমন: ব্যবহারে উষ্ণতা, খাবার বেড়ে দেওয়া, পছন্দ অনুযায়ী রান্না, পকেট মানি, উপহার দেওয়া ইত্যাদি) প্রয়োজন অনুযায়ী কমিয়ে দিন। সন্তানকে পরোক্ষভাবে বুঝিয়ে দিন অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণ বা জেদ করে যেমন সে তার দাবি আদায় করতে পারবে না, তেমনি অগ্রহণযোগ্য ব্যবহারে তার ‘সুবিধা’ কমে যাবে।
যা চাইবে তা দেবেন না। আপনার সামর্থ্য থাকলেও সন্তানের কিছু চাহিদা অপূর্ণ রাখুন। এতে সন্তান যেমন বুঝতে শেখে আমাদের সব ইচ্ছা সব সময় পূরণ হয় না, তেমনি সে শেখে ‘না পাওয়াকে’ কীভাবে মানিয়ে নিতে হয়। ছেলেবেলা থেকেই এই মানিয়ে নেওয়ার শিক্ষা প্রাপ্ত বয়সে জীবনের নানা ‘না পাওয়া’, ব্যর্থতা, অপ্রতাশিত ঘটনা সহজভাবে মেনে নিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে সাহায্য করবে।
কাঙ্ক্ষিত আচরণে মনোযোগ
সন্তানের যেকোনো ভালো কাজে, যেমন—আপনার কথা শুনলে, জেদ কমিয়ে ফেললে, পরিবারের নিয়মকানুন মেনে চললে, খেলাধুলা বা পড়ালেখায় ভালো করলে তাকে তাৎক্ষণিকভাবে প্রশংসা ও ভালোবাসা প্রকাশ করুন।
আপনি নিজে সন্তানের জন্য একটি ভালো উদাহরণ হয়ে উঠুন
শিশু-কিশোর মূলত দেখে শেখে। কাজেই আপনি যদি অল্পতেই রেগে যান, গালিগালাজ, ভাঙচুর করার মতো অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণ করেন, তাহলে স্বভাবতই আপনার সন্তান সেটাই শিখবে। সন্তানের ক্ষেত্রে আপনি যা চাইছেন সেটা নিজের আচরণে প্রতিফলন ঘটানোর চেষ্টা করুন।
নেতিবাচক আচরণ থেকে বিরত থাকুন
জেদ করলে বকা দেওয়া, গায়ে হাত তোলা, সমালোচনা করা থেকে বিরত থাকবেন। অতিরিক্ত বকা, সমালোচনা এর গুরুত্ব নষ্ট করে। সন্তান এ ধরনের আচরণে অভ্যস্ত হয়ে যায় এবং একসময় আর আমলে নেয় না। এ ছাড়া সন্তানকে বকা দিলে কিছুক্ষণ পর অভিভাবকের নিজেরই খারাপ লাগা কাজ করে এবং কোনোভাবে পুরস্কৃত করে পুষিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। পরিণামে অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণ কমার বদলে বেড়ে যায়।
পরিবারের মূল নিয়মকানুন অবহিত করুন
ছোটবেলা থেকেই সন্তানকে পরিবারের মূল নিয়মকানুন, যেমন—নিয়মিত স্কুল, বড়দের সম্মান, অনুমতি ছাড়া বাসার বাইরে সময় কাটানো বা অন্যের ব্যক্তিগত জিনিস, যেমন মানিব্যাগ, মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ ধরা যাবে না ইত্যাদি সম্পর্কে অবহিত করুন।
কী করবেন
* সন্তানকে যে আপনি ভালোবাসেন সেটা মুখে প্রকাশ করুন
* সন্তানের ‘প্রাইভেসি’কে সম্মান করুন (ঘরে ঢোকার সময় নক করুন)
* বয়স অনুযায়ী পরিবারের ছোটখাটো দায়িত্ব দিন, নিজের পছন্দে তার ব্যক্তিগত জিনিস কিনতে দিন (এতে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা বাড়ে, সন্তান আত্মবিশ্বাসী হয়)
* সাধারণ ব্যর্থতা (রেজাল্ট খারাপ করা ইত্যাদি) তিরস্কারের বদলে সহজে গ্রহণ করুন এবং তাকে মেনে নিতে শেখান (এতে চাপ মোকাবিলার ক্ষমতা বাড়বে)
* সন্তানের সঙ্গে সময় কাটান, তার আগ্রহের জায়গাগুলো নিয়ে কথা বলুন (যেমন: তার বন্ধুবান্ধব, খেলাধুলা, প্রিয় গায়ক, ভবিষ্যতের স্বপ্ন), একসঙ্গে সিনেমা দেখুন, গান শুনুন (এতে সন্তানের কাছাকাছি যেতে পারবেন)
যা করবেন না
* মনে আঘাত দিয়ে বা অসম্মান করে কথা বলা, গায়ে হাত তোলা, তুলনা করা (কারণ এতে সন্তানের হীনম্মন্যতা তৈরি হয়)
* সন্তানের জেদ নিয়ে অন্যের কাছে বা সন্তানের সামনে কথা বলবেন না (কারণ এতে জেদ গুরুত্ব পায়)
* মিথ্যা হুমকি দেবেন না, যা করতে পারবেন না, সেটা প্রকাশ করবেন না (কারণ, এতে আপনার কথার গুরুত্ব কমে)।
* ব্যক্তিগত বিষয়ে আপনার নিজস্ব মতামত চাপাবেন না (এতে সন্তানের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা কম হয়)