জুরাইনের মুশকিল আসান

মিজানুর রহমান। ছবি: সংগৃহীত
মিজানুর রহমান। ছবি: সংগৃহীত
সুন্দরবন রক্ষার আন্দোলনে ভূমিকা রাখায় ভিনদেশি গণমাধ্যম তাঁকে তুলে ধরেছে পরিবেশ রক্ষা গেরিলাযোদ্ধা হিসেবে। সম্প্রতি ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালককে (এমডি) ‘সুপেয়’ পানির শরবত পানের উদ্যোগ নেওয়ার মতো অভিনব প্রতিবাদ করে ফের আলোচনায় এসেছেন মিজানুর রহমান। ঢাকার জুরাইনের এই বাসিন্দা জীবন কাটিয়ে দিচ্ছেন মানুষের পক্ষে আন্দোলন করে। তাঁর এই প্রতিবাদী জীবনের কথা শুনে এসে লিখেছেন মাহফুজ রহমান

মিজানুর রহমান অর্থপূর্ণ একটা হাসি হেসে বললেন, ‘প্রতিটা আন্দোলনে আমার স্বার্থ থাকে। আমি নিঃস্বার্থভাবে আন্দোলন

 করি না!’

ঢাকার পূর্ব জুরাইন। ১ মের ঢিলেঢালা বিকেল। বিশ্ববিদ্যালয়ছাত্র রাইয়ান খান এলাকার আরও কজনের সঙ্গে বিশুদ্ধ পানির জন্য আন্দোলনে শরিক হয়েছেন প্রথমবারের মতো। হাতে এক তোড়া লিফলেট। ‘আন্দোলনে এলেন কার ডাকে?’ পাশেই দাঁড়িয়ে থাকা মিজানুর রহমানকে দেখিয়ে রাইয়ান বললেন, ‘মিজান ভাইয়ের ডাকে। ছোটবেলা থেকে তাঁকে দেখছি আমাদের জন্য আন্দোলন করছেন। মিজান ভাইদের বয়স হয়েছে। এখন এসব আন্দোলন-প্রতিবাদ আমাদের করা জরুরি! মিজান ভাইয়ের মতো নিঃস্বার্থভাবে আন্দোলনে থাকতে চাই।’

তখনই রাইয়ানের কথায় দ্বিমত করলেন ৪৫ বছর বয়সী মিজানুর রহমান, ‘শোনো, আমি কিন্তু নিঃস্বার্থভাবে আন্দোলন করি না। প্রতিটা আন্দোলনে আমার স্বার্থ থাকে। জুরাইন এলাকার মানুষের স্বার্থই আমার স্বার্থ।’

মিজানুর রহমান, জুরাইন এলাকার আবালবৃদ্ধবনিতার কাছে যিনি একনামে পরিচিত, আক্ষরিক অর্থেই জীবন কাটিয়ে দিচ্ছেন মানুষ ও পরিবেশের জন্য আন্দোলন করে। মিজানুর রহমান হয়ে উঠেছেন জুরাইনের মুশকিল আসান।

প্রতিবাদের বীজ

গত ২৩ এপ্রিল রাজধানীতে ‘সুপেয়’ পানি দিয়ে শরবত তৈরি করে ওয়াসার এমডিকে পান করানোর জন্য এক অভিনব কর্মসূচি হাতে নেন মিজানুর রহমান। সেই সূত্রেই মিজানুর রহমান সম্পর্কে জানা। তাঁকে আরও জানতে আমরা গিয়েছিলাম জুরাইনে। রেলগেটে নেমে ফোন করতেই মিজানুর রহমান বললেন, ‘মিষ্টির দোকানে চলে আসেন।’

মিষ্টির দোকানের নাম কী?

মিষ্টির দোকান বললেই হবে।

ওয়াসার পানি নিয়ে মিজানুর রহমানের সেই অভিনব প্রতিবাদ। ছবি: দীপু মালাকার

তথাস্তু। অপরিসর রাস্তার ত্রিমোহনায় ততোধিক অপরিসর ‘মিষ্টির দোকানে’র বাইরে থেকেই দেখা গেল মিজানুরের মিষ্টি হাসি। বিনয়ের সঙ্গে অনুমতি নিয়ে বেঞ্চে পা তুলে বসলেন। বললেন, সারা দিন দৌড়াদৌড়ি করতে করতে পেরেশান! বিকেলে আবার প্রচারপত্র বিতরণ করতে হবে।

কত দিন ধরে এ ধরনের আন্দোলন করছেন?

মিজানুর রহমানের শ্মশ্রুমণ্ডিত মুখে মিষ্টি হাসির বিরাম নেই, ‘সেটা আশির দশক থেকেই, যখন আমার বয়স হবে ধরেন ছয়-সাত বছর। এখানকার জনতা ক্লাবের ঠিক পাশেই আমাদের বাড়ি। সেই জনতা ক্লাবের প্রভাবশালী লোকজন আমাদের বাড়ির একাংশ দখল করে বসল। খুব বিপন্ন বোধ করলাম তখন। ভীষণ প্রভাবও ফেলল আমার ওপর। তখন থেকেই আমি প্রতিবাদী হয়ে উঠেছি বলতে পারেন।’

প্রতিবাদী হয়ে ওঠার যে বীজ বপন হলো মনে, সেটি চারা হয়ে গজাল ১৯৮৮ সালের বন্যার সময়। ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ-ডেমরা (ডিএনডি) বাঁধের ভেতরেই পড়েছে জুরাইন। ফলে মহাবন্যায় মহাসংকট। সেই সময়ের স্কুলছাত্র মিজানুর মূল বাঁধের ওপর বালুর বাঁধ দেওয়ার কাজে নেমে পড়লেন। সমাজের জন্য কিছু করার সেই শুরু। এরপর কলেজে উঠে যুক্ত হলেন একটি প্রধান রাজনৈতিক দলের ছাত্রসংগঠনের সঙ্গে। ১৯৯৬ সালের জাতীয় নির্বাচনে স্থানীয় সংসদ সদস্য প্রার্থীর জন্য প্রাণপণে কাজ করলেন। হতাশ হতেও সময় লাগল না। মিজানুরের ভাষায়, ‘নির্বাচনের আগের ও পরের অনেক কিছুই মেলাতে পারছিলাম না। ফলে বুঝে গেলাম রাজনীতি করে সমাজসেবা করার জায়গা নেই। মনে আছে, সে সময় এই এলাকায় বিদ্যুতের প্রচণ্ড সমস্যা, আমরা পথে নামলাম। কিন্তু সরকারদলীয় লোকজন উল্টো আমাদের মারতে এল। ফলে মন উঠে গেল পুরোপুরি।’

২০১৭ সালে সুন্দরবন রক্ষার দাবিতে পথে দাঁড়িয়ে পুলিশি নির্যাতনের শিকার হন মিজানুর

রাজনীতি থেকে সরে এলেও সমাজসেবা থেকে হাত গুটিয়ে নেওয়ার মানুষ নন মিজানুর। প্রতিবাদ করতে লাগলেন মাদক, আবর্জনা, সন্ত্রাসসহ যেকোনো অন্যায়ের। চালাতে লাগলেন রক্তদান কর্মসূচি। উদ্যোগ নিলেন বইমেলা আয়োজনের। উৎসবে-পার্বণে স্কুল-কলেজের দেয়ালে লিখে গেলেন প্রতিবাদী স্লোগান। মানুষও সাড়া দিতে লাগল তাঁর ডাকে। মিজানুর তখন জুরাইন এলাকার হাজারো মানুষের সোচ্চার কণ্ঠের প্রতিনিধি।

মানুষ মানুষের জন্য

২০০২ সালে তেল-গ্যাস–খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ–বন্দর রক্ষা কমিটিতে যোগ দিলেন মিজানুর। অংশ নিলেন লংমার্চে। ছোটবেলা থেকেই ভূপেন হাজারিকার গানের ভক্ত মিজানুর। ‘মানুষ মানুষের জন্য’ গানটি তাঁর প্রিয়। ‘আমি এক যাযাবর’ গানটি শুনে কল্পনা করতেন বাইসাইকেলে চেপে দুনিয়া ঘুরবেন। সেই স্বপ্নই মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগল সে সময়। মিজানুর বলছিলেন, ‘একদিন ঠিক করলাম, ঢাকা থেকে কক্সবাজার বাইসাইকেলে যাব। সাত দিনের ওই ভ্রমণে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের হয়ে ডেঙ্গু জ্বরবিষয়ক সচেতনতার স্লোগান নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম আমরা কজন বন্ধু।’

এভাবেই চলছিল। বাড়ছিল বয়স। জীবিকার তাগিদে ভালো লাগার বিষয় আলোকচিত্র এবং চলচ্চিত্র নিয়ে একাধিক কোর্স করলেন। কিছুদিন কাজ করলেন টেলিভিশনে। ভালো লাগল না। ব্যবসা শুরু করলেন। ব্যবসার টাকা দিয়ে শিক্ষা তহবিলও গঠন করলেন একসময়। কিন্তু লোকসান হওয়াতে ব্যবসার পাততাড়িও গোটাতে হলো। চার ভাই, তিন বোনের মধ্যে মিজানুরের বৈষয়িক অবস্থান সবার নিচে। বাধ্য হয়ে ভাইয়ের গাড়ি নিয়ে ড্রাইভিং পেশাও চেষ্টা করে দেখলেন। এর মধ্যে আন্দোলন কিন্তু থেমে নেই। সমাজসেবায় বিরতি বলে কোনো শব্দ ভেবেও দেখেননি কখনো। জীবিকার এত চেষ্টায় একবার তেল-গ্যাস রক্ষা জাতীয় কমিটির এক লংমার্চে অংশ নেওয়া হলো না। মিজানুরের আফসোসের সীমা নেই তাতে। এত কিছুর মধ্যে অনেক ভেবেচিন্তে ঠিক করলেন, প্রেমের সম্পর্কটা বিয়েতে গড়াক। স্ত্রী শামীম হাসেমের ভবিষ্যৎ নিয়ে খুব ভাবনায় পড়ে গেলেন। কিন্তু শামীম হাসেম, যাঁর ডাকনাম খুকী, মিজানুরের জন্য ভবিষ্যতের ভাবনা সহজ করে দিলেন। অভয় দিয়ে বললেন, ‘অত ভেবো না।’

সবুজের পক্ষে যুদ্ধ

শামীম হাসেমের কথা বলছিলেন মিজানুরের আন্দোলন-জীবনের দীর্ঘদিনের সঙ্গী সাগর ইসলাম। জুরাইনের সাগর যুক্ত আছেন একটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের গবেষণা ও উন্নয়ন বিভাগে। তিনি বলছিলেন, ‘মিজান ভাই আমাদের জ্বালানি, কিন্তু তাঁকে অনুপ্রেরণা দেন ভাবি (মিজানুর রহমানের স্ত্রী)। মিজান ভাইয়ের জীবন ও আন্দোলনের যোগ্য সহযাত্রী তিনি।’

মিজানুর আন্দোলনে নেমে জীবনের ঝুঁকি নিয়েছেন একাধিকবার। গ্রেপ্তার হয়েছেন মানুষ ও পরিবেশের পক্ষে কথা বলার জন্য। ২০১৭ সালেও তুমুল আলোচনার বিষয় হয়েছিলেন মিজানুর। ওই বছরের ২৬ জানুয়ারি সুন্দরবন রক্ষায় রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প বাতিলের দাবিতে ডাকা জাতীয় কমিটির হরতালের সময় পুলিশ তাঁকে পিটিয়ে মারাত্মকভাবে আহত করে। রাজপথে তাঁকে বুট-বন্দুকের বাঁট দিয়ে পেটানোর ছবি এবং ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে দেশে-বিদেশে নিন্দার ঝড় ওঠে। নির্যাতনের বিবরণ প্রকাশিত হয় আন্তর্জাতিক পরিবেশবিষয়ক সংবাদমাধ্যমগুলোতে। একই বছরের ৫ অক্টোবর সুইডেনের পত্রিকা রিপাবলিক-এ পরিবেশ রক্ষায় গেরিলাযোদ্ধা হিসেবে বিশ্বের পাঁচ পরিবেশ আন্দোলনকারীর কথা তুলে ধরা হয়। সুন্দরবন রক্ষা আন্দোলনের সংগঠক মিজানুর রহমানের নামও উঠে আসে পাঁচজনের মধ্যে।

এগিয়ে চলেছেন মিজানুর

বিশুদ্ধ পানির জন্য সচেতনতা সৃষ্টিতে লিফলেট বিতরণ করছিলেন মিজানুর রহমান। সঙ্গে ছিলেন জুরাইনের অনেক তরুণ। আরও ছিল মিজানুরের তিন কন্যার একজন পূর্ণতা হাসিনা। কলেজছাত্রী পূর্ণতাকে জিজ্ঞেস করি, ‘বাবা যে এত সাহসী কাজ করেন, তোমাদের ভয় করে না?’ পূর্ণতা বাবার দিকে তাকিয়ে বলে, ‘এটা তো করতেই হবে।’

পূর্ব জুরাইনে পথ চলতে চলতে লিফলেট বিতরণ করেন মিজানুর। এলাকার মানুষের সঙ্গে কথা বলেন। পানির সমস্যা এখনো আছে আগের মতোই। মানুষ মসজিদে বসানো গভীর নলকূপের পানি নিচ্ছে সারি বেঁধে। পথচলতি মানুষ নিজে থেকে এসে দেখাচ্ছে মুঠোফোনে তুলে রাখা ‘সুপেয়’ পানির নমুনা। মিজানুর বলেন, ‘ভুক্তভোগী মানুষ সমস্যা থেকে মুক্তি চায়। কিন্তু আস্থা রাখার মানুষ বা সংগঠনের সংখ্যা অনেক কমে গেছে। তাই আমি মাথায় রাখি, মানুষ যেন ভরসা হারিয়ে না ফেলে। ওয়াসার এমডির বক্তব্যের প্রতিবাদ ওই জায়গা থেকেই এসেছে। এই জীবনে মানুষের কাছ থেকে অনেক কিছু পেয়েছি। তাই আমি চিন্তা করি, আমারও কিছু দেওয়ার আছে। আর এই আন্দোলনগুলো মোটেও সাহসের কাজ নয়। মানুষের পক্ষে কথা বলা খুব স্বাভাবিক একটি কাজ বলে মনে করি।’

লিফলেট বিতরণের সময় পূর্ব জুরাইনের এক প্রবীণ তাঁর দোকান থেকে মিজানুরকে ডাকলেন। সস্নেহে বললেন, ‘তুমি থাকলে বাবা চিন্তা নাই।’

সন্দেহ নেই, মিজানুর এই আস্থার জন্যই প্রতিনিয়ত কাজ করে চলেছেন।