নাজমারা ছিলেন ১১ ভাইবোন। সবার ছোট নাজমা। ১৯৮৮ সালে গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার হরিণহাটি এলাকার আবুল হোসেনের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়ে যায়। স্বামীর তেমন কোনো আয়রোজগার ছিল না। সংসারে তাই অভাব–অনটন লেগেই থাকত। এলাকার নারীরাও তখন সেভাবে বাইরে কাজকর্ম করতেন না। সামাজিক বিধিনিষেধও ছিল। শ্বশুড়বাড়িরও সায় ছিল না। তারপরও সংসারের অভাব ঘোচাতে ১৯৯১ সালের ১৪ নভেম্বর বাড়ির কাছের এপেক্স ফুটওয়্যার নামের জুতা কারখানায় লাস্টিং সেকশনে যোগ দেন নাজমা। বেতন মাত্র ৬০০ টাকা। প্রথম দিনটার কথা নাজমা বেগমের আজও মনে আছে, ‘প্রথম যেদিন কারখানায় গেলাম, সেদিন চামড়ার গন্ধে মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিলাম। তবে সরে দাঁড়াইনি। ধীরে ধীরে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছি। কারখানায় কাজও দ্রুত শিখে যাই। যে কারণে কারখানার মালিকও খুবই পছন্দ করতেন। তিনি কারখানা ভিজিটে এলে সবার কাজ দেখতেন। আমার নাম ধরে ডাকতেন, প্রশংসা করতেন। খুবই ভালো লাগত। কাজে উৎসাহ পেতাম।’ সেই কারখানাতেই টানা প্রায় ১৪ বছর চাকরি করেছেন। নিজের যোগ্যতা দিয়ে অপারেটর পর্যন্ত হয়েছিলেন। পদোন্নতির সঙ্গে সঙ্গে বেতনও বেড়েছিল।
২০০৪ সালে নিশ্চয়তার সেই চাকরি ছেড়ে দিয়ে বাড়ির পাশেই একটি খাবারের হোটেল দেন নাজমা। স্বামীও সহযোগিতা করেন। দুজনের মিলিত চেষ্টায় বেশ আয় হতে থাকে। পরে এ ব্যবসাও ছেড়ে দিয়ে ডিমের আড়ত দিলেন। সেই ব্যবসা এখনো চলছে। ঘুরে দাঁড়ানোর প্রবল ইচ্ছা নিয়েই সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন নাজমা, ফলও পেয়েছেন। নিজেদের টাকা দিয়ে জমি কিনেছেন, তৈরি করেছেন দুটি বহুতল ভবন। ব্যবসার টাকা দিয়ে গাড়িও কিনেছেন। নাজমার বড় মেয়ে আমেনা আক্তারও মা–বাবাকে দেখে বাড়িতে চালু করেছেন পারলার। মেজ মেয়ে আনিতা সুলতানা এবার উচ্চমাধ্যমিক পাস করেছেন। আর ছোট মেয়ে ফাতেমা ইয়াসমিন পড়ছে উচ্চমাধ্যমিকে।
সম্প্রতি নাজমা বেগমের টুপিতে যুক্ত হয়েছে আরেকটি পালক। গাজীপুরের কালিয়াকৈর পৌরসভার কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছেন তিনি। বরাবরই মানুষের পাশে থাকার চেষ্টা করেন। সে কাজই আরও সরাসরি করার বাসনা থেকেই ২০১১ সালে নির্বাচনে অংশ নেন। সেবার অল্প ভোটের ব্যবধানে হেরে যান। হেরে গেলেও মানুষের পাশেই ছিলেন। অন্যের বিপদ–আপদের কথা শুনলেই ছুটে গিয়েছেন। দীর্ঘ প্রায় ১০ বছর পর আবার কালিয়াকৈর পৌরসভার তফসিল ঘোষণা হলে চশমা প্রতীক নিয়ে প্রচার–প্রচারণা শুরু করেন নাজমা বেগম। এবার আর জনগণ তাঁকে হতাশ করেননি। ২৮ নভেম্বর কালিয়াকৈর পৌরসভা নির্বাচনে বিপুল ভোটে সংরক্ষিত ৭, ৮ ও ৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছেন তিনি। ১৬ হাজার ৫৮৭ ভোট পেয়ে জয়লাভ করেন নাজমা বেগম। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী পান ৫ হাজার ৯৯৩টি ভোট।
নাজমা বেগম এখন বেজায় ব্যস্ত। সম্প্রতি তাঁর বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল, এলাকার কয়েকজনের সঙ্গে স্থানীয় নানা সমস্যা নিয়ে বৈঠক করছেন। সেই আলোচনা শেষ করেই নিজের ব্যবসাকেন্দ্রে গেলেন। খোঁজখবর নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। স্থানীয় ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে এলেন রাস্তার পাশে ন্যায্যমূল্যের চাল বিক্রির ট্রাকের কাছে। ওজনে যাতে কম দেওয়া না হয়, তার নির্দেশনা দিলেন। দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ তদারকও করলেন।
কথা বলতে বলতেই বাড়ির পাশে এপেক্স কারখানায় নিয়ে গেলেন। পুরোনো সহকর্মীদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। নিজ হাতে জুতা তৈরি করেও দেখালেন। নাজমা বেগম বলেন, ‘চাকরি ছেড়ে দিলেও জুতা বানানো ভুলিনি।’
এরই মধ্যে ওয়ার্ডের নানা উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড শুরু করেছেন নাজমা বেগম, ‘এলাকাবাসীকে কথা দিয়েছিলাম, নির্বাচিত হলে পরিচ্ছন্নতা নিয়ে কাজ করব। এরই মধ্যে সেই কাজ শুরু করেছি। সম্প্রতি পৌরসভার ৭ ও ৮ নম্বর ওয়ার্ডে মেয়র মজিবুর রহমান ও স্থানীয় কাউন্সিলরদের সহযোগিতায় পরিচ্ছন্নতার কাজের উদ্বোধন করা হয়েছে।’
এলাকার সব বয়সী মানুষের মধ্যে নাজমার জনপ্রিয়তা আছে। হরিণহাটি এলাকার বাসিন্দা মীর রবিউল করিম বলেন, ‘নাজমা বেগম পরিশ্রমী নারী। জীবনে অনেক সংগ্রাম করে এ পর্যায়ে এসেছেন। কাউন্সিলর হয়েও অতীতকে ভুলে যাননি। এখনো তাঁর চাকরিজীবনে সেই প্রতিষ্ঠান থেকে পাওয়া নানা সহযোগিতার গল্প করেন।’
কালিয়াকৈর পৌরসভার মেয়র মজিবুর রহমান বলেন, ‘জনপ্রতিনিধি হওয়ার জন্য একজন মানুষের মধ্যে যে গুণাবলি থাকা প্রয়োজন, নাজমার মধ্যে সেই গুণাবলি আছে। তাই এলাকার জনগণ তাঁকে বিপুল ভোটে জয়ী করেছেন। এলাকার জনগণকে যেসব প্রতিশ্রুতি তিনি দিয়েছেন, সেগুলো যাতে পূরণ করতে পারেন, তার জন্য সব রকমের সহযোগিতা করা হবে।’