জীবন বাঁচানোর মতো আনন্দ আর কিছুতে নেই

সাগরে ভাসছেন রবীন্দ্রনাথ দাস
সাগরে ভাসছেন রবীন্দ্রনাথ দাস
ভারতীয় মৎসজীবী রবীন্দ্রনাথ দাসের বেঁচে ফেরার কাহিনি অনেকের জানা। গভীর সমুদ্রে পাঁচ দিন ভেসে থাকার পর তাঁকে উদ্ধার করেছিলেন বাংলাদেশি একটি জাহাজের কর্মীরা। সেই উদ্ধারমুহূর্তের কথাই জানিয়েছেন সমুদ্রগামী জাহাজ এমভি জাওয়াদের ক্যাপ্টেন এস এম নাসির উদ্দি

১০ জুলাই ২০১৯। বেলা ১১টা।

ভারত থেকে ক্লিংকারবাহী জাহাজ নিয়ে ফিরছিলাম চট্টগ্রাম বন্দরের পথে। উত্তাল সাগর। বড় বড় ঢেউ। এমন সময় জাহাজের ওপরে একটি যন্ত্রাংশ পরীক্ষা করতে উঠলাম আমি আর চিফ অফিসার প্রিয়তোষ চৌধুরী। হঠাৎ দেখি—আদিগন্তবিস্তৃত সমুদ্রে ভাসছেন একজন মানুষ। দুহাত নেড়ে নেড়ে জানাচ্ছেন বাঁচার আকুতি।

সেই দৃশ্য দেখে প্রিয়তোষ চিৎকার করতে করতে নেমে পড়েন জাহাজের নিচতলায়। এর মধ্যে জাহাজের অন্য কর্মীরাও ওপরে উঠে আসেন। এরপর আমরা ওই মানুষটির উদ্দেশে লাইফ জ্যাকেট ছুড়ে মারি। সেই জ্যাকেটটি তিনি ধরেও ফেলেন। কিন্তু হঠাৎ বিশালাকার এক ঢেউয়ের তোড়ে তিনি ছিটকে পড়েন অনেক দূরে।

চলছে উদ্ধার কাজ

উত্তাল সমুদ্র। আচমকা জাহাজ ঘোরানো বড় ধরনের ঝুঁকি। কারণ মালামালসহ জাহাজটি প্রায় ৫০ হাজার টন ওজনের। হঠাৎ ঘোরাতে গেলে উল্টে যাওয়ার শঙ্কা থাকে। কিন্তু আমরা একজন মানুষের প্রাণ বাঁচাতে চেয়েছি। তাই প্রথম দফায় ব্যর্থ হওয়ার পর দ্রুত আমাদের জাহাজের মালিকানা প্রতিষ্ঠান কেএসআরএম গ্রুপের প্রধান নির্বাহী মেহেরুল করিমের সঙ্গে যোগাযোগ করি। তিনি নির্দেশ দেন যেকোনোভাবে উদ্ধারের জন্য। তাঁর নির্দেশ পেয়ে আমরা জাহাজটি বাঁয়ে ঘোরাতে শুরু করি। প্রায় এক মাইল ঘোরার পর আমরা ওই ব্যক্তির কাছাকাছি চলে যাই। এরপর গতি কমিয়ে ঢেউ থেকে বাঁচাতে তাঁকে জাহাজের আড়ালে নিয়ে আসি। এরপর তাঁর উদ্দেশে স্বয়ংক্রিয় নেট পানিতে নামিয়ে দিই। একটু চেষ্টার পরেই ওই নেটের ভেতর ঢুকে পড়েন ওই জেলে। সেখানে ঢুকেই তিনি জ্ঞান হারান। এরপর তাঁকে ওপরে তুলে নিয়ে আসা হয়।

সফল উদ্ধার অভিযানের পর জাহাজের সবাই উল্লাসে ফেটে পড়ি যেন। জাহাজে তোলার পর রবীন্দ্রনাথকে জাহাজের হাসপাতালে নিয়ে প্রাথমিক চিকিৎসা দিই। পাশাপাশি মুঠোফোনে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়েও তাঁকে চিকিৎসা দিতে থাকি। এর মধ্যেই তাঁর জ্ঞান ফেরে।

উদ্ধারের পর জাহাজে যখন জ্ঞান ফিরে পেলেন রবীন্দ্রনাথ দাস। ছবি: সংগৃহীত

জ্ঞান ফেরার পর জানা গেল, তাঁর নাম রবীন্দ্রনাথ দাস। ভারতের দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার। পেশায় জেলে। মাছ ধরতে গিয়ে ৬ জুলাই ট্রলার উল্টে গভীর সমুদ্রে পড়ে গিয়েছিলেন তিনিসহ ১৫ জন জেলে। সবাই বাঁশ ও ভাসমান সরঞ্জাম ধরে আড়াই দিনের মতো ভেসে ছিলেন। তাঁর সঙ্গে যাঁরা ছিলেন, তাঁরাও ঢেউয়ে ঢেউয়ে আলাদা হয়ে যান। সম্বল বলতে ছিল এক টুকরো বাঁশ আর মনের জোর। ওপরে বৃষ্টি। চারপাশে ঢেউয়ের আনাগোনা। এর মধ্যে চলছে মাছেদের কামড় দেওয়ার যন্ত্রণা। মুখটা আকাশের দিকে দিয়ে বৃষ্টির পানি পান করছিলেন আর শুধুই অপেক্ষা করছিলেন—কখন ঝড় থামবে, সমুদ্র আবার শান্ত হবে আর পাশ দিয়ে যাবে কোনো জাহাজ! এভাবে প্রায় পাঁচ দিন ভেসে ছিলেন সমুদ্রে। এরপরেই আমাদের চোখে পড়া।

এস এম নাসির উদ্দিন

জাহাজে তোলার পর তরল খাবার দেওয়া হয় তাঁকে। পানিতে ভাসার কারণে রবীন্দ্রনাথ খুব দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন। তাই ওই দিন বেলা দুইটায় তিনি ঘুমিয়ে পড়েন। তাঁর সেই ঘুম ভাঙে রাত আটটায়। ঘুম ভাঙার পর তিনি তাঁর পরিবারের পরিচিত নিতাই নামের একজনের মুঠোফোন নম্বর দেন। পরদিন সকালে নিতাইকে ফোন দিয়ে বিষয়টি জানানো হয়। রবীন্দ্রনাথ তাঁর স্ত্রী ও বাচ্চা এবং পরিবারের সঙ্গে ভিডিও ফোনে কথা বলতে চান। ওই দিন বিকেলে সেই ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়। হারিয়ে যাওয়া রবীন্দ্রনাথকে দেখতে পেয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন তাঁর স্ত্রী ও পরিবারের সদস্যরা।

ঘরে ফেরা
বহির্নোঙরে ফেরার পর ১২ জুলাই ভারতে পাঠানোর জন্য রবীন্দ্রনাথকে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়। যাওয়ার বেলায় তিনি তাঁকে উদ্ধারের জন্য সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানালেন। নিজের দেশে ফিরেও আমাদের ফোন করেন রবীন্দ্রনাথ।

সেদিন প্রতিকূল আবহাওয়ায় তাঁকে উদ্ধারে ঝুঁকি ছিল। কিন্তু একজন জীবন্ত মানুষকে এভাবে ফেলে এলে প্রতিমুহূর্তে নিজের কাছে অপরাধী থাকতাম। জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে লড়াই করে কার্যত মৃত্যুর মুখে থাকা একজন মানুষকে তাঁর ছোট ছোট বাচ্চার কাছে জীবন্ত ফিরিয়ে দিতে পারলাম—একজীবনে এর চেয়ে বড় আনন্দ আর কী হতে পারে!

অনুলিখন: তাসনীম হাসান, চট্টগ্রাম