জলে পড়া আর প্রেমে পড়া কি একই রকম?

ভালোবাসার গল্প আহ্বান করেছিল ‘ছুটির দিনে’। বিপুল সাড়া দিয়েছেন পাঠকেরা। কেউ লিখেছেন দুরন্ত প্রেমের গল্প, কেউবা শুনিয়েছেন দূর থেকে ভালোবেসে যাওয়ার অনুভূতি। বাছাই একটি গল্প রইল এখানে।

ঘড়ির দিকে না তাকালে বুঝতামই না আড়াই ঘণ্টা হেঁটেছি। পোস্তগোলা সেতুর কাছে আসতেই দেখি যান চলাচল বন্ধ। খাঁটি বাংলাদেশি স্টাইলের লকডাউন শুরু। এখন হেঁটে যেতে হবে মাওয়া ঘাট। রাগে মাথা টগবগ করছে। অথচ সুমির হাসি রোগটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে।

ওর হাসিকেই আমি ভয় পাই। মনে হয় হাসির পেছনে লুকিয়ে আছে রাগ কিংবা ক্ষোভ। কিংবা কান্না। আমার সামনে সুমি কাঁদে না। কিন্তু আমি জানি একা একা কাঁদে। আমিই ওকে কাঁদাই প্রতিদিন। ও যেদিন খুব হাসে, কে যেন বলে আমাকে, একাকী বদ্ধ কামরায় বৃষ্টি নামবে আজ।

হাসছ কেন?

তোমার রাগ দেখে। চলো হাঁটি। তোমার সাথে আজ গল্প করব।

ব্যাগ হাতে নিয়ে তো আর ভিডিও কল জমবে না। আমার সাথে গল্প করবে আজ।

আমাদের বিয়ে হয়েছে এক মাস। এক সপ্তাহ গ্রামে কাটিয়ে সস্ত্রীক চলে এসেছি মেসে। সকালে কিন্ডারগার্টেনে পড়াই, বিকেলে ফুচকা বিক্রি করি। চলেই যাচ্ছিল একরকম। করোনা এসে ওলটপালট করে দিল সব। আর কফিনের শেষ পেরেক ঠুকল লকডাউন। গ্রামে পালানো ছাড়া উপায় নেই। মেসের দুপুর আর সন্ধ্যাগুলো কাটে আমার ফোনে, ভিডিও কল করে। সুমিকে বলতাম স্কুলের জরুরি মিটিং। একদিন ধরা পড়ে গেলাম।

তোমার সব জরুরি কাজ শুধু বকুল ম্যাডামের সঙ্গেই? ঘণ্টায় ঘণ্টায় ভিডিও কল? প্রেমট্রেম করো না তো?

বলেই কলজে ঠান্ডা করা অট্টহাসি। আমি জানি সেদিন অনেক কেঁদেছিল সুমি। আজ কেন হাসছে ও?

বকুল ম্যাডামের সাথে কথা হয়নি আজ?

কিসের কথা? কেন কথা বলব আমি?

রেগে যাচ্ছ কেন? দেখো, ফেরিতে না দেখা হয়ে যায়?

ওর বাড়ি দিনাজপুর। ট্রেনে যাবে…

ছোট ফেরিটায় কয়েক হাজার মানুষ

বলেই থতমত খাই আমি। আবার সেই হাসি। সারাটা রাস্তা বকবক করে যায় সুমি। আমার গলা শুকিয়ে কাঠ।

ঘাটে পৌঁছে চোখে অন্ধকার দেখি। লঞ্চ, স্পিডবোট চলাচল বন্ধ। যেতে হবে ফেরিতে। ছোট ফেরিটায় কয়েক হাজার মানুষ। জনসমুদ্রের মাঝে পড়ে আমরা বিধ্বস্ত হতে থাকি। সুমির হাত আমার শক্ত মুঠির ভেতর। ‘এই হাত ছাড়া যাবে না সারা জীবন,’ কে যেন বলছে আমায়। কিন্তু হাত ছুটে যায়। পুলিশের একটা বাঁশির শব্দের সঙ্গে লোকের জটলা উঠে পড়ে আমাদের ওপর। আমি ছিলাম ফেরির বাইরের দিকে। এক ধাক্কায় ছিটকে পড়ি পদ্মার জলে।

সাঁতার জানি না। ঠান্ডা জলে হাবুডুবু খাই। সুমির চিৎকার, ভাইরাল ভিডিও লোভী ক্যামেরার ঝলকানির মধ্যে তলিয়ে যেতে থাকি। দম বন্ধ হয়ে আসে।

জ্ঞান ফিরলে নিজেকে একটা ভেজা কোলের ওপর আবিষ্কার করি। ভিজে জবুথবু হয়ে আমাকে নিয়ে বসে আছে সুমি। চোখে জল।

আমি এখন কোথায়?

হাসপাতালে। এটা মুন্সিগঞ্জের একটা হাসপাতাল।

তোমার কাপড় ভেজা কেন?

শরীয়তপুরের ছেলে হয়ে সাঁতার জানো না? বলোনি কেন?

তোমার সাথে কথাই তো হলো না ঠিক করে? আমাকে তুলেছে কে, তুমি?

না, তোমার বকুল ম্যাডাম!

সুমির হাতটা চেপে ধরি।

কে বকুল? নদীর পানি শুধু ফুসফুসে না, মস্তিষ্কেও ঢুকেছে। ধুয়েমুছে দিয়েছে সব জঞ্জাল।

জলে পড়া আর প্রেমে পড়া কি একই রকম?

কার প্রেমে পড়েছ আবার? বকুল ম্যাডামের?

আবার সেই হাসি। এখন আর কোনো ভয় হচ্ছে না। কাজ করছে না কোনো অপরাধবোধ। সুমির হাতটা আমার শক্ত তালুতে। প্রেমের মতো কোনো একটা মহাসমুদ্রে পড়ে হাবুডুবু খাচ্ছি।