শুরু করি দুটি ঘটনা দিয়ে। পুরো বিশ্ববিদ্যালয়জীবনটা শোভন আর রুমার প্রেমের ঝগড়া মেটাতেই গেছে রুপমের (ছদ্মনাম)। একবার শোভন এসে বলেন, রুমা এটা করেছেন তো একবার রুমা এসে বলেন, শোভনের সঙ্গে আর সম্পর্ক রাখা যায় না। আর দুজনের বন্ধু রুপম প্রতিবারই তা মিটিয়েছেন ধৈর্য ধরে। একসময় বিশ্ববিদ্যালয়জীবন শেষ হয়, শোভন–রুমার সম্পর্কেও ছেদ ধরে। তবে রুপমের সঙ্গে দুজনেরই ভালো সম্পর্ক থেকে যায়। একদিন এক অনুষ্ঠানে ওই দুই বন্ধুকে দাওয়াত দিয়ে বেশ বিব্রতকর অবস্থায় পড়েন রুপম। পুরো অনুষ্ঠানে শোভন ও রুমা কেউ কারও সঙ্গে কথা বলেননি, সেই সঙ্গে তাঁদের একসঙ্গে দাওয়াত দেওয়ায় রুপমের ওপরও খেপে যান দুজনই। তবে দুই বন্ধুর মধ্যে একজনকে বেছে নেওয়া সম্ভব ছিল না রুপমের।
আদিলের বন্ধু দম্পতি সায়মা–আনিস। সম্প্রতি দুজনের বিচ্ছেদ হয়েছে। বাসার এক আয়োজনে দুজনকেই দাওয়াত দেন আদিল। আলাদাভাবে দুজনই আসেন। নিজেদের মধ্যে তেমন কোনো কথা না বললেও আগত সবার সঙ্গেই গল্প হাসিঠাট্টায় চমৎকার একটি সময় কাটান তাঁরা।
এই দুটি গল্প থেকেই বোঝা যায়, স্বাভাবিকভাবে নিলে সব সম্পর্কই সুন্দর থাকে। প্রায় দেখা যায় দুই বন্ধুর সম্পর্ক যখন নষ্ট হয়, তখন তার প্রভাব পড়ে অন্য বন্ধুদের মধ্যে। তিন বন্ধুর মধ্যে দুজনের সম্পর্কের অবনতি হলে, আরেক বন্ধু বেশ বিপাকে পড়েন। কার সঙ্গে সম্পর্ক ভালো রাখবেন বা সম্পর্ক রাখা না রাখায় কে কষ্ট পাবে, এসব হিসাব মেলাতে হিমশিম খেতে হয় তৃতীয় পক্ষকে। এমনটা যে শুধু সম্পর্কের ক্ষেত্রে হয় তা নয়, ছোটখাটো নানা ঘটনাকে কেন্দ্র করেই ফাটল ধরে বন্ধুত্বে।
তিন বন্ধু সামি, জরি আর নীলা। জরিকে সব সময় খ্যাপায় সামি। হাসতে হাসতেই নাম বিকৃত করে নানা ধরনের মজা করত সে। বিষয়টা কখনো ভালো না লাগলেও বন্ধুত্বের খাতিরে চুপ করেই থাকত জরি। একদিন আর সহ্য করতে না পেরে বেশ কিছু কঠিন কথা শুনিয়ে দেয় সামিকে। সামিও সেসব কথা স্বাভাবিকভাবে নেয় না। দুই বন্ধুর কথা বন্ধ হয়ে যায়। নীলাকে জানায় সে কথা। তবে নীলা সামিকে বোঝায়, আসলেই জরিকে এভাবে বলা তার ঠিক হলো না। ব্যস, এতেই নীলার ওপরও খেপে যায় সামি। শত বুঝিয়েও তাকে স্বাভাবিক করতে পারে না নীলা। জরি আর নীলার কোনো অনুষ্ঠানে আসা বাদ দিয়ে দেয় সে। এ ঘটনা ধরেই তৈরি হয় সম্পর্কের দূরত্ব। একসময় ছিঁড়ে যায় তিনজনের মধ্যে বন্ধুত্বের মূল্যবান সম্পর্কের সুতোটি।
মনে রাখা উচিত, নিয়ম-অনিয়ম, বিশ্বাস, নির্ভরতা আর বাঁধভাঙা সম্পর্কের মিলনস্থল হচ্ছে বন্ধু। যে কথা কাউকে বলা যায় না, তার আগল অকপটে খুলে দেওয়া যায় একজন প্রকৃত বন্ধুর সামনে। এই সম্পর্ক যেমন আস্থার আবার কর্তৃত্বের। প্রেমের মতোই বন্ধুত্বও সাবলীল এবং স্বতঃস্ফূর্ত। বুঝতে হবে সম্পর্ক সহজ না হলে কেউ কখনো কারও বন্ধু হয়ে উঠতে পারে না। সহজ সম্পর্ক তৈরি করতে এটাও বুঝতে হবে, সবারই একটি নিজস্ব জগৎ থাকে, সেখানে আপনি ছাড়াও আরও অনেকের স্থান রয়েছে।
আসলে কেবল বন্ধুর মধ্যে নয়, জীবনের নানা সম্পর্কের ক্ষেত্রেই এই জটিলতা লক্ষ করা যায়। এক প্রতিবেশীর সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হলে অনেকে আশা করেন অন্য প্রতিবেশীরাও তাঁর সঙ্গে যোগ দেবেন। পক্ষ নেবেন। দাওয়াতে অনুষ্ঠানে আলাদা করে দেবেন। এমনটা না করলে সম্পর্ক ছেদ। অফিসের সহকর্মীর সঙ্গে, এমনকি আপন ভাইবোনের মধ্যেও ব্যাপারটি দেখা যায়। অথচ সবাই আলাদা সত্তা—বিষয়টি মেনে নিতে হবে।
এসব ক্ষেত্রে যাঁদের মধ্যে সম্পর্ক নষ্ট হয়েছে, তাঁরা কয়েকটি কাজ করতে পারেন। যেমন কিছু সময়ের জন্য আলাদা থেকে পরিস্থিতি বিবেচনা করতে পারেন। নিজের মনকে শান্ত করার জন্য সময় নিতে পারেন। যাঁর সঙ্গে মূল সমস্যা, তাঁর সঙ্গে মিটমাট করা সম্ভব না হলেও যেন অন্য মানুষগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক ঠিক রাখা যায়, সেটা নিয়ে ভাবতে পারেন। বন্ধুত্বের সমস্যাগুলো নিজেই সমাধান করা যায়। এ ক্ষেত্রে তৃতীয় কারও সাহায্য নিলে একদিকে যেমন নিজের কথা বাইরের লোকে জানেন, অন্যদিকে যাঁর সঙ্গে বলছেন সেই বন্ধু ব্যাপারটি পছন্দ না–ও করতে পারেন, আবার অন্য বন্ধুদের বিব্রতকর অবস্থায়ও পড়তে পারেন—এই বিষয়গুলো নিয়েও ভাবতে হবে।
তবে পরিস্থিতি বেশি জটিল হয় তৃতীয় পক্ষের ক্ষেত্রে। সামাজিক বিজ্ঞানীরা বলেন, দুজন মানুষের মধ্যে সম্পর্ক ভালো থাকলে তো আর তা ভাঙে না। খারাপ পরিস্থিতির কারণেই ভাঙে। তাই দুজনের সঙ্গে সম্পর্ক রাখার ক্ষেত্রে তৃতীয় পক্ষকে বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে। অনেক সময় দেখা যায়, সম্পর্ক ভেঙে আলাদা সংসার গড়েছেন দুজন। এঁদের আবার দেখা হলে নতুন সঙ্গী নিজেকে অনিরাপদ মনে করতে পারেন, তীব্র মানসিক চাপ অনুভব করেন। প্রচণ্ড কষ্ট পেতে পারেন। তৃতীয় পক্ষ যদি সত্যিকারের বন্ধু হন, তাহলে তাঁকে এসব বিষয় বুঝেই সম্পর্কে ভারসাম্য আনতে হবে। নিরপেক্ষভাবে দুজনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে মূল সমস্যা চিহ্নিত করতে হবে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সুলতানা মোস্তফা খানম বলেন, বিষয়টি অসম্ভব জটিল। এসব ক্ষেত্রে দেখা যায়, তিনজনের কোনো একজন মনে করেন, তাঁকে পুরোপুরি বন্ধু বলে মনে করা হচ্ছে না। দুজনের মধ্যে সম্পর্কের ব্যালান্স করতে গিয়ে তৃতীয় পক্ষ অনেক সময় বিষয়টি আরও জটিল করে তোলে। আসলে সামাজিক বিষয়গুলো কখনো তাত্ত্বিকভাবে, কখনো আকাঙ্ক্ষা দিয়ে আবার কখনো বাস্তবতা দিয়ে বিচার করতে হয়। আমরা আমাদের অনুভূতিকে পরিশীলিত করতে পারি, তার বহিঃপ্রকাশ হয়তো না–ও করতে পারি কিন্তু অন্তরে মেরে ফেলতে পারি না। তৃতীয় পক্ষ নিজের বন্ধুত্বের কথা ভেবে নতুন মানুষদের ওপর চাপ ফেলতে পারেন। তাই এই জটিল পরিস্থিতিকে সব দিক বিবেচনা করেই মোকাবিলা করতে হবে। দাওয়াতের ক্ষেত্রে ভাগ করে দাওয়াত দিয়ে অথবা, দুই পক্ষের সঙ্গে কৌশলে আলোচনা করে কিছুটা সমাধানে আসা যেতে পারে।