দূষণ-দখলের প্রভাব

ছোট হয়ে আসছে শুশুকের আবাস

‘একসময় কর্ণফুলী নদীর বিভিন্ন স্থানে পানির নিচ থেকে পিঠ কিংবা মাথা উঁচিয়ে লাফিয়ে উঠতো ‘উতোম’ (শুশুক)। এই দৃশ্য প্রতিদিন অসংখ্যবার দেখেছি। এখন আর আগের মতো তা চোখে পড়ে না। নদীতে জাহাজ আর যন্ত্রচালিত নৌকার চলাচল বেড়ে যাওয়ার পর থেকে এমন দৃশ্য খুব একটা চোখে পড়ে না।’ কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ পাড়ের জেলে মো. সেলিম ও আতর আলীর বিবরণ এটি। স্থানীয় লোকজনের কাছে উতোম বা হুতুম নামে পরিচিত কর্ণফুলীর এই স্তন্যপায়ী প্রাণীটি আসলে শুশুক বা ডলফিন। মো. সেলিম ও আতর আলীর মতো যাঁরা ২০ থেকে ২৫ বছর ধরে কর্ণফুলীতে মাছ ধরেন তাঁদের সবাই এক সময় নদীতে প্রচুর শুশুকের দেখা পেলেও এখন আর দেখেন না।সেলিম ও আতর আলীর কথার সঙ্গে মিল রয়েছে আন্তর্জাতিক পরিবেশ সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচারের (আইইউসিএন) সমীক্ষার। শুশুক বা গাঙ্গেয় ডলফিন নামে পরিচিত এই প্রাণীটিকে বর্তমানে লাল তালিকাভুক্ত অর্থাৎ অতি বিপন্ন হিসেবে চিহ্নিত করেছে সংস্থাটি। সংস্থার ওয়েবসাইটে গিয়ে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নদীতে ডলফিনের উপস্থিতি সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্যের ইঙ্গিতবাহী। নদী থেকে ডলফিন হারিয়ে যাওয়ার অর্থই হলো জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়েছে। কর্ণফূলী নদীর পানি দূষিত হয়ে পড়ায় হারিয়ে যাচ্ছে শুশুক বা ডলফিন। দূষণমুক্ত পরিষ্কার পানিতে শুশুক অর্থাৎ গাঙ্গেয় বা গেঞ্জেস রিভার ডলফিন বিচরণ করে। বাংলাদেশের কর্ণফুলী ও সাঙ্গু নদী এটির আবাসস্থল। এ ছাড়া ভারত ও বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত ব্রহ্মপুত্র নদ ও মেঘনা নদীতে এই ডলফিন পাওয়া যায়।পরিবেশবিদদের ধারণা ক্রমাগত নদীদূষণ, যান্ত্রিক জলযান বৃদ্ধি, বাঁধ দেওয়া ও সেচের কারণে দিন দিন ছোট হয়ে আসছে গাঙ্গেয় ডলফিনের বিচরণক্ষেত্র। এ ছাড়া জন্মহার কম হওয়াও ডলফিন কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। জেলেদের জালেও ডলফিন মারা যাচ্ছে। বেশকিছু দিন আগে বাগেরহাটের ভৈরব নদী-সংলগ্ন একটি খালে এক জেলের জালে আটকা পড়ে মারা যায় ৪৫ কেজি ওজনের একটি ডলফিন । ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ড লাইফ ফান্ড (ডব্লিওডব্লিওএফ) এর হিসেবে বর্তমানে ভারত, বাংলাদেশ ও নেপালের মিঠাপানির এই ডলফিনের সংখ্যা মাত্র এক হাজার ২০০ থেকে এক হাজার ৮০০। এর মধ্যে বাংলাদেশে আছে মাত্র ১৫০টির মতো। ডলফিন নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মো. বেনজির আহমেদ। তিনি আইইউসিএন এর বিশেষজ্ঞ হিসেবেও কাজ করেন। তিনি জানান, তিনিসহ একদল বিশেষেজ্ঞ ১৯৯৯ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত সমীক্ষা চালিয়ে দেখেছেন, কর্ণফুলী, সাঙ্গু ও হালদা নদীতে শুশুক বা ডলফিনের সংখ্যা ১২৫-এর বেশি নয়।জানতে চাইলে বেনজির আহমেদ আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, ‘যদি এখনই রক্ষা করা না যায় তাহলে গেঞ্জেস রিভার ডলফিন বিলুপ্ত হয়ে যাবে। দূষণ এবং জেলেদের জালের কারণে এ জাতের ডলফিন বিলুপ্তির পথে। এ ছাড়া নদীতে চর জেগে ওঠার কারণেও নষ্ট হচ্ছে এর আবাসস্থল। সরকারের উচিত দ্রুত ডলফিন প্রোটেকশান জোন তৈরি করা। সুন্দরবনে ইতিমধ্যেই এটি করা হয়েছে।’দূষণ: কর্ণফুলীর এই অনন্য স্তন্যপায়ী প্রাণীর হারিয়ে যাওয়ার প্রধান কারণ হলো নদী দূষণ। সম্প্রতি বিভিন্ন সমীক্ষায় কর্ণফুলীতে মাত্রাতিরিক্ত দূষণের প্রমাণ পাওয়া গেছে। নদী-সংলগ্ন বিভিন্ন খালের মুখে ও টিএসপি, কাফকো এবং সিইউএফএল সারকারখানা এলাকার পানিতে দূষণের মাত্রা সবচেয়ে বেশি। কেবল শিল্পবর্জ্য নয় গৃহস্থালীর বর্জ্যও নদী দূষণের অন্যতম কারণ।জানা গেছে, নদীর পানিতে দ্রবিভূত ও অদ্রবিভূত বস্তুকণার পরিমাণ স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি হলে এবং দ্রবিভূত অক্সিজেনের পরিমাণ কম হলে দূষণ ঘটছে বলে ধরে নেওয়া হয়।পরিবেশ অধিদপ্তরের বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা গেছে, কোথাও কোথাও কর্ণফুলীর পানিতে অদ্রবিভূত বস্তুকণা স্বাভাবিকের চেয়ে সাতগুণেরও বেশি। নির্দিষ্ট মানের চেয়ে দ্রবিভূত বস্তুকণার পরিমাণও বেশি পাওয়া গেছে। এ ছাড়া দ্রবিভূত অক্সিজেনের (ডিও) পরিমাণ আদর্শমানের অনেক কম। এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. মনজুরুল কিবরিয়া বলেন, ‘ডলফিন টিকে থাকার প্রথম শর্তই হচ্ছে দূষণমুক্ত পানি। কর্ণফুলী নদীতে ডলফিন এখন দেখা যায় না। কারণ নদী আস্তে আস্তে দূষিত হয়ে পড়েছে। ফলে সংকুচিত হয়ে আসছে তাদের আবাসস্থল।’ধূসর রংয়ের কর্ণফুলীর ডলফিন ২ দশমিক ১২ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। লম্বাটে মুখের এই ডলফিনগুলো ২৫ থেকে ৩০ বছর পর্যন্ত বাঁচে। ৯ থেকে ১১ মাস গর্ভধারণের পর একটি মাত্র বাচ্চা প্রসব করে এই প্রজাতির ডলফিন। গর্ভকাল লম্বা হওয়া ও জন্মহার কম হওয়াও ডলফিন কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ বলে মনে করেন বিজ্ঞানীরা।