চীনে পড়তে যেতে চাইলে যে ১০ প্রশ্নের উত্তর জেনে রাখা ভালো

উচ্চশিক্ষার জন্য অনেক শিক্ষার্থীরই প্রিয় গন্তব্য এখন চীন। চীনে পড়ালেখা–সংক্রান্ত ১০টি প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন সে দেশের কি ল্যাব অব ইয়াংজি রিভার ওয়াটার এনভায়রনমেন্টের গবেষণা সহকারী হিসেবে কর্মরত বাংলাদেশি তরুণ মো. শহিদুল ইসলাম। প্রায় ছয় বছর ধরে তিনি চীনে আছেন। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করেছেন। শিগগিরই চীনের শিংহুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি শুরু করবেন।

বন্ধুদের সঙ্গে লেখক (বাঁ থেকে পঞ্চম)
ছবি: সংগৃহীত

১. এইচএসসির পরই কি স্নাতকের জন্য চীনে যাওয়া যায়?
অধিকাংশ বিদেশি শিক্ষার্থী স্নাতক প্রোগ্রামের অধীনেই চীনে পড়তে আসেন। চীনা ও ইংরেজি—দুই মাধ্যমেই পড়া যায়। তবে চীনা মাধ্যমে পড়তে হলে আগে থেকেই চীনা ভাষায় দক্ষতা থাকতে হবে। অথবা এখানে এসে ১ বছর চীনা ভাষা শিখে তারপর মূল কোর্সে প্রবেশ করতে হয়। চীনা ভাষায় পড়লে বেশ কয়েকটি সুবিধা আছে। বৃত্তি পাওয়া যেমন সহজ, বৃত্তির সুযোগ-সুবিধাও তেমনি বেশি। প্রকৌশল, মেডিকেল, ব্যবসায় শিক্ষাসহ সব ধরনের বিষয়ে পড়ালেখা করার সুযোগ এখানে আছে। তবে মেডিকেল স্কুলগুলোয় পড়তে চাইলে আগে থেকেই বিএমডিসির (বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল) অনুমতিপত্র সংগ্রহ করতে হয়।

২. চীনে পড়তে যাওয়ার জন্য সবচেয়ে ভালো বৃত্তি কোনটি?
সবচেয়ে ভালো বৃত্তি হলো চীনা সরকারি বৃত্তি (সিএসজি)। চায়না স্কলারশিপ কাউন্সিল থেকে এই বৃত্তি দেওয়া হয়। www.campuschina.org ওয়েবসাইটে গেলে বিশ্ববিদ্যালয় এবং বৃত্তি সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যাবে। এই বৃত্তির জন্য আবেদন করার দুটি পথ আছে। সরাসরি বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন অথবা বাংলাদেশের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশে অবস্থিত চীনা দূতাবাসে আবেদন। টিউশন ফি, হোস্টেল ফি, স্বাস্থ্যবিমা—সবই বৃত্তির আওতায় পড়ে। ভাতা হিসেবে প্রতি মাসে স্নাতক, স্নাতকোত্তর এবং পিএইচডির জন্য যথাক্রমে ২ হাজার ৫০০, ৩ হাজার এবং ৩ হাজার ৫০০ ইউয়ান দেওয়া হয়। বাংলাদেশি টাকায় যা প্রায় যথাক্রমে ৩৬ হাজার, ৪৩ হাজার এবং ৫০ হাজারের সমতুল্য। বাংলাদেশে অবস্থিত চীনা দূতাবাস থেকে আবেদন (টাইপ এ) করলে চীনে যাওয়া এবং ফিরে আসার খরচ দেওয়া হয়। তবে সরাসরি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে আবেদন করলে এ সুযোগ থাকে না।

৩. চীনা সরকারি বৃত্তির জন্য কী কী যোগ্যতা লাগে?
বৃত্তি পাওয়া খুব একটা কঠিন না। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের আবেদনের ন্যূনতম যোগ্যতা আছে। সব স্কুলেই স্নাতক আবেদনের জন্য উচ্চমাধ্যমিক, স্নাতকোত্তরের জন্য স্নাতক এবং পিএইচডির জন্য স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাগে। প্রথম কাতারের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য আইইএলটিএস বা এইচএসকে (চীনা ভাষার দক্ষতা পরীক্ষা) দরকার হয়। তবে কেউ যদি ইংরেজি মাধ্যমে লেখাপড়া করে থাকে, তাহলে এমওআই (মিডিয়াম অব ইনস্ট্রাকশন) সনদ দিয়ে আবেদন করা যাবে। এবার বলি—কোন কোন বিষয় বৃত্তি পেতে সাহায্য করে। প্রথমত, একটা ভালো ‘স্টাডি প্ল্যান’ লেখা খুব জরুরি। সহশিক্ষা কার্যক্রমকে এ ক্ষেত্রে খুব গুরুত্ব দেওয়া হয়। চীনা ভাষা বা সংস্কৃতির ওপর কোনো কোর্স বা অভিজ্ঞতা থাকলে সংযুক্ত করা যেতে পারে। মাস্টার্স বা পিএইচডি লেভেলে আবেদনের জন্য যদি পাবলিকেশন থাকে, সংযুক্ত করা যাবে। এটা বৃত্তি পাওয়ার সম্ভাবনা অনেক বাড়িয়ে দেয়। গবেষণার অভিজ্ঞতাকে খুবই প্রাধান্য দেওয়া হয়। চীনা সরকারি বৃত্তির জন্য কমপক্ষে দুটি ‘রিকমেন্ডেশন লেটার’ প্রয়োজন হয়। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিষয়ভিত্তিক বৃত্তির কোটা থাকে। তাই পছন্দের বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইট থেকে বৃত্তির বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করা জরুরি।

৪. আর কী কী বৃত্তি আছে?
ব্যাচেলর বা মাস্টার্সের শিক্ষার্থীদের জন্য বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়েই টিউশন ফি মওকুফের বৃত্তি আছে। স্নাতক শ্রেণিতে ইংরেজি মাধ্যমে পড়লে এই বৃত্তি তুলনামূলক সহজে পাওয়া যায়। চীনের প্রতিটি প্রদেশের আলাদা বৃত্তি আছে। এই বৃত্তিগুলোকে বলা হয় প্রভিন্সিয়াল স্কলারশিপ। সাধারণ বৃত্তিগুলোর পাশাপাশি পিএইচডি ফেলোশিপ বা বিশেষ ট্যালেন্ট বৃত্তি আছে। এগুলো পুরোপুরি গবেষণানির্ভর প্রোগ্রামগুলোর জন্য। এই ফেলোশিপগুলোতে টাকার পরিমাণ সাধারণ বৃত্তির চেয়ে অনেক বেশি থাকে। এর বাইরে বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য বেল্ট অ্যান্ড রোড বৃত্তি, মফকম বৃত্তি, এন্টারপ্রাইজ বৃত্তিসহ নানা ধরনের বৃত্তি চালু আছে।

৫. চীনে পড়তে হলে চীনা ভাষা কি শিখতেই হয়?
চীনে পড়তে হলে চীনা ভাষা শেখাটা বাধ্যতামূলক না। তবে এখানে জীবনযাপন সহজ করার জন্য চীনা ভাষা শেখা জরুরি। চীনে ইংরেজি মাধ্যমে পড়তে এলেও বিশ্ববিদ্যালয় জেনারেল কোর্স হিসেবে ১-২টি চীনা ভাষার কোর্স দিয়ে থাকে। এগুলো থেকে প্রাথমিক জ্ঞান অর্জন করা যায়। আমাদের দেশে অনেকেরই চীনা ভাষাভীতি আছে। কিন্তু এখানে এলে ভাষা শেখাটা সহজ হয়ে যায়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো চীনা ভাষার অনেক ফ্রি কোর্স অফার করে। ওগুলোতে অংশ নিলেও ধীরে ধীরে ভাষাটা আয়ত্তে চলে আসে। আর ওই ক্লাসগুলো খুবই মজার হয়। কিছু কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষা শেখাটা বাধ্যতামূলক। যাঁরা চীনা ভাষা জানেন, তাঁরা চাকরির বাজারে আলাদা কদর পান। তাই আমার মনে হয় ভাষাটা শিখে নেওয়াই ভালো। প্রায় ১৩০ কোটি মানুষ চীনা ভাষায় কথা বলে। অতএব নিশ্চয়ই এমন একটা ভাষার সুবাদে আপনার সামনে খুলে যেতে পারে সুযোগের অনেক দরজা।

৬. চীনে জীবনযাত্রার ব্যয় কেমন?
নির্ভর করে শহরের ওপর। বেশির ভাগ ছোট ও মাঝারি শহরগুলোতে খরচ অনেক কম। অনেকটা আমাদের ঢাকার মতো। তবে বড় শহরগুলো, যেমন বেইজিং, সাংহাই—এগুলো বেশ ব্যয়বহুল। ছোট বা মাঝারি মানের শহরগুলোতে থাকলে ১০ হাজার টাকায় খাবার খরচ হয়ে যায়। হোস্টেল ফি তুলনামূলক কম। প্রতি মাসে ৪০০-৬০০ ইউয়ান। টাকার অঙ্কে ৬-৮ হাজার টাকার মতো। বেশির ভাগ স্কুলে বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য রান্নাঘর থাকে। তাই কেউ চাইলে তাঁর পছন্দমতো খাবার রান্না করে খেতে পারবেন।

৭. কেউ বৃত্তি ছাড়া পড়তে চাইলে খরচ কেমন?
বৃত্তি ছাড়া পড়ার জন্য মেডিকেল স্কুলগুলোয় খরচ একটু বেশি। তবে প্রকৌশল, ব্যবসায় শিক্ষাসহ অন্যান্য অনুষদে লেখাপড়ার জন্য খরচ কিছুটা কম। টিউশন ফি একেক স্কুলে একেক রকম। স্নাতক শ্রেণিতে পড়ার জন্য বছরে ১৫ হাজার ইউয়ান থেকে শুরু করে ৫০ হাজার ইউয়ান পর্যন্ত খরচ হতে পারে। মাঝারি মানের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় সাধারণত ১৫-৩০ হাজারের মধ্যে (প্রায় ২ লাখ ৮ হাজার টাকা) হয়ে যায়।

৮. ঘরে বসে কীভাবে চীনা ভাষা শিখতে পারি?
নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি বা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) কনফুশিয়াস ইনস্টিটিউট, ঢাবির ভাষা ইনস্টিটিউটে গিয়ে শিখতে পারলে সবচেয়ে ভালো। এ ছাড়া চীনের অনেকগুলো বিশ্ববিদ্যালয় অনলাইনে বিদেশিদের জন্য কিছু কোর্স অফার করে। এগুলোকে বলে ‘চায়না ব্রিজ উইন্টার ক্যাম্প’ বা ‘চায়না ব্রিজ সামার ক্যাম্প’। এই ক্যাম্পগুলোতে কম্প্রিহেনসিভ চাইনিজ কোর্স থাকে। এর মাধ্যমে আপনি এইচএসকে-১ (চীনা ভাষার দক্ষতার মাত্রা) থেকে এইচএসকে-৬ সম্পন্ন করতে পারবেন। এ ছাড়া এসব অনলাইন কোর্সে চীনা সংস্কৃতির সঙ্গেও পরিচিত হওয়ার সুযোগ থাকে। কোর্সগুলোর জন্য কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয় টাকা নেয়, কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয় আবার বিনা মূল্যেই করায়। ঘরে বসে ইউটিউবেও শিখতে পারেন। তবে কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে শেখার সুবিধা হলো, আপনাকে ওরা সনদ দেবে। পরে বৃত্তি পেতে বা ভর্তি হতে গেলে এই সনদ খুব কাজে লাগে।

৯. পড়ালেখার পাশাপাশি কাজ করার সুযোগ আছে কি?
চীনে বিদেশি শিক্ষার্থীদের কাজের সুযোগ আগে ছিল না। দেড়-দুই বছর হয় সরকার অনুমতি দিচ্ছে। তবে প্রক্রিয়াটা জটিল। অন্তত এক বছর পড়ালেখা করে তারপর বিশ্ববিদ্যালয় এবং সুপারভাইজারের অনুমতি নিয়ে আপনি খণ্ডকালীন কাজ করতে পারেন। বাংলাদেশিদের সঙ্গে যেহেতু চীনাদের অনেক রকম ব্যবসা আছে, তাই কিছু কিছু কাজের সুযোগও আছে। কিন্তু সত্যি বলতে কি, এখানে পড়ালেখার চাপ এত বেশি, বিশেষ করে স্নাতক পর্যায়ে, পড়া সামলে কাজ করা বেশ কঠিন।

১০. চীনে পড়ালেখা করে সে দেশে চাকরির সুযোগ কেমন?
চীনের লেখাপড়ার মান ভালো এবং বাস্তবমুখী। শিক্ষার্থীরা যখন কোনো চীনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হয়, তারা একটা ভালো দক্ষতা নিয়েই বের হয়। একটা বড় অংশের ছাত্রছাত্রী ক্যাম্পাসে থাকাকালেই চাকরির অফার পেয়ে যান। পড়ালেখা শেষ করে দেশে ফিরেও চাকরির সুযোগ আছে। বহু চীনা কোম্পানি বাংলাদেশে ব্যবসা করছে। চীনের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লেখাপড়া শেষ করলে এই কোম্পানিগুলোতে চাকরির সুযোগ থাকে। এ ছাড়া চীনেও বিদেশিদের জন্য একটা বিশাল চাকরির বাজার আছে। চীনের বড় কোম্পানিগুলো পৃথিবীর নানা দেশের সঙ্গে ব্যবসা করে। অন্যান্য দেশের সঙ্গে ব্যবসা করার জন্য নানা রকম টেকনিক্যাল এবং নন-টেকনিক্যাল কর্মকর্তা-কর্মচারী প্রয়োজন হয়। এসব কোম্পানিতে বিদেশিরা সহজে চাকরি করতে পারেন।