‘স্বামীর হাতের মার খাওয়া ছিল আমার নিত্যদিনের ঘটনা। হাত দিয়ে, পা দিয়ে, লাঠি দিয়ে যখন-যেভাবে পারত মারত আমাকে। একসময় মনে করলাম, এইভাবে আর না। স্বামীর ঘর ছেড়ে বের হয়ে আসি। এখন আমি নিজে আয়-রোজগার করি। আগের চেয়ে অনেক ভালো আছি।’
কথাগুলো বলছিলেন আসমা খাতুন (৩৭)। স্বামীর নির্যাতনের শিকার হয়ে একসময় জীবনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু দমে যাননি। ঘুরে দাঁড়িয়েছেন আবার। গত ৩০ নভেম্বর কথা হয় তাঁর সঙ্গে।
আলাপচারিতায় জানা যায়, রাজশাহীর মতিহার থানার ধরমপুর গ্রামের একটি সাধারণ পরিবারের মেয়ে আসমা খাতুনের বিয়ে হয় ১৯৯৭ সালে। তখন তাঁর বয়স ১৮ বছর। শ্বশুরবাড়ি দুর্গাপুর থানার পলাশবাড়ি গ্রামে। স্বামী কৃষিকাজ করতেন। বিয়ের পর বছর খানেক ভালোই কাটে তাঁর। এরপর জীবনে নেমে আসে দুর্যোগ। স্বামী চাষবাস করা ছেড়ে দেন। অন্য কোনো চাকরিবাকরির চেষ্টাও কখনো করেননি। ফলে সংসারে অভাব-অনটন দেখা দেয়। তখন টাকার জন্য আসমার ওপর চাপ দিতে থাকেন স্বামী। বাবার বাড়ি থেকে টাকা আনতে বলেন। কিন্তু আসমা তাতে রাজি হন না। আর তখনই নেমে আসে আসমার ওপর অকথ্য নির্যাতন।
আসমা বলেন, ‘পারিবারিকভাবে আমার বিয়ে হয়। বিয়ের সময় কোনো যৌতুক দিতে হয়নি আমার বাবাকে। তবে সোনার গয়না ও আসবাব দেন। শ্বশুরবাড়ি থেকেও সোনার গয়না দেওয়া হয়। স্বামী যখন টাকার জন্য মারধর করতে শুরু করে, তখন এক এক করে সব গয়না বেঁচে দিই। তারপরও মারধর করা থামে না। সহ্য করতে না পেরে মাঝেমধ্যে বাপের বাড়ি থেকে টাকা এনে দিয়েছি। টাকা এনে দিলে কয়েক দিন মারধর করত না। টাকা শেষ হয়ে গেলেই শুরু হতো মার। বিয়ের তিন বছর পর আমার একটি মেয়ে হয়। এর দুই বছর পর আবার আমি গর্ভবতী হই। কিন্তু একদিন এ রকম টাকা চেয়ে না পেয়ে স্বামী আমার পেটে এমন জোরে লাথি মারে যে আমার বাচ্চাটি নষ্ট হয়ে যায়।’
তিনি বলেন, ‘এরপর ২০০৮ সালে স্বামী আমাকে আবার বাবার বাড়ি থেকে টাকা আনতে বললে, আমি প্রতিবাদ করি। তখন স্বামী আমাকে বাঁশের লাঠি দিয়ে ভীষণ মারে। লাঠির আঘাতে কপাল ফেটে রক্ত পড়তে থাকে। অজ্ঞান হয়ে যাই। খবর পেয়ে আমার বড় বোন আমাকে নিয়ে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে (ওসিসি) ভর্তি করেন। সেখানে চিকিৎসার পাশাপাশি আইনি সহায়তাও পাই। তারা আমার পক্ষ হয়ে আদালতে স্বামীর বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা করে। কিন্তু একটা মামলা চালানোর খরচ অনেক। টাকার অভাবে আমি আর মামলা চালাতে পারছিলাম না। তাই একসময় মামলা তুলে নিই।’
উল্লেখ্য, ২০০১ সালে নারী ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে ‘নারী নির্যাতন প্রতিরোধকল্পে মাল্টিসেক্টরাল প্রোগ্রাম’ এর আওতায় প্রথমে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ওসিসি চালু হয় । এরপর একে একে রাজশাহী, চট্টগ্রাম, সিলেট, খুলনা, বরিশাল, ফরিদপুর ও রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ওসিসি কার্যক্রম চালু করা হয়। এই আটটি ওসিসি নির্যাতনের শিকার নারী ও শিশুদের বিনা মূল্য সেবা দিচ্ছে।
আসমা জানান, হাসপাতাল থেকে তিনি আর স্বামীর ঘরে ফিরে যাননি। মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে বাবার বাড়ি চলে যান। পরে স্বামীকে তালাক দেন। বিয়ের আগে এইচএসসি পরীক্ষা দিয়ে অকৃতকার্য হয়েছিলেন আসমা। তালাকের পর আবার পরীক্ষা দেন এবং পাস করেন।
আসমা এখন স্বাবলম্বী। রাজশাহী মেডিকেল কলেজের ওসিসি ওয়ার্ড থেকে তাঁকে একটি সেলাই মেশিন দেওয়া হয়েছিল। সেটাই এখন তাঁর রোজগারের অবলম্বন। জামাকাপড় সেলাইয়ের পাশাপাশি জামা-শাড়িতে অ্যাপ্লিক ও হাতের কাজ করেন। নকশিকাঁথাও তৈরি করেন। আশপাশের এলাকা থেকে অনেক ফরমাশ আসে। মাসে রোজগার হয় ছয় থেকে সাত হাজার টাকা।
আসমা খাতুন বলেন, ‘আমি আগের জীবনের কথা মনে করতে চাই না। আমি অন্য মেয়েদেরও বলতে চাই, আপনারা স্বামীর নির্যাতন সহ্য করবেন না। নিজের পায়ে দাঁড়ান। অনেক ভালো থাকবেন। আমি যেমন এখন ভালো আছি। নিজের রোজগার দিয়ে মেয়ের পড়াশোনার খরচ চালাচ্ছি। এর চেয়ে আনন্দের আর কী আছে!’