প্রায় চার বছর ধরে চলা মন্দা থেকে ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে আবাসন খাত। কয়েক বছর ধরে অবিক্রীত থাকা ফ্ল্যাটের বিক্রি বেড়েছে। রাজনৈতিক অস্থিরতা না থাকায়, ব্যাংক ঋণের সুদহার কমে আসায় এবং ফ্ল্যাট কেনার ক্ষেত্রে প্রবাসীদের জন্য ব্যাংকের অর্থায়ন চালু হওয়ায় আশার আলো দেখতে পাচ্ছেন আবাসন ব্যবসায়ীরা। চট্টগ্রামের আবাসন ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে এমন চিত্র পাওয়া গেছে।
আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিহ্যাবের চট্টগ্রাম কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, আবাসন ব্যবসার মন্দার শুরু ২০১২ সাল থেকে। ২০১৪ সালের হিসাবে, চট্টগ্রামে রিহ্যাবের সদস্যভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর ১০ হাজার ফ্ল্যাটের মধ্যে অবিক্রীত পড়েছিল পাঁচ হাজার। এতে এ খাতে প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ আটকা পড়ে ছিল।
রিহ্যাবের কেন্দ্রীয় সহসভাপতি ও চট্টগ্রাম অঞ্চলের স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান এস এম আবু সুফিয়ান ২৩ ফেব্রুয়ারি প্রথম আলোকে জানান, কয়েক বছরের মন্দার পর ২০১৫ সালের জুন মাস থেকে স্থবিরতা কাটতে শুরু করেছে আবাসন খাতে। গত তিন মাসে সহস্রাধিক অবিক্রীত ফ্ল্যাট বিক্রি হয়েছে। ফ্ল্যাটের দামও যৌক্তিক পর্যায়ে নেমে এসেছে। নতুন বিনিয়োগের জন্য এখন জমি খঁুজছেন আবাসন ব্যবসায়ীরা।
আবাসন খাতের স্থবিরতা কাটাতে বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। গত ৬ ডিসেম্বর প্রবাসীদের জন্য গৃহঋণ উন্মুক্ত করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা নীতি বিভাগ থেকে জারি হওয়া সার্কুলারে বলা হয়, বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনকারী ব্যাংকগুলো প্রবাসীদের গৃহায়ণ খাতে ঋণ দিতে পারবে। এ ক্ষেত্রে প্রবাসীদের ঋণ সীমা হবে ৫০ অনুপাত ৫০। অর্থাৎ ৬০ লাখ টাকা দামের ফ্ল্যাটের জন্য ব্যাংক অর্ধেক বা ৩০ লাখ টাকা ঋণ দেবে। এর আগে ২০১২ সালে দেশে বসবাসকারী নাগরিকদের জন্য ব্যাংকঋণের সীমা করা হয়েছিল ৭০ অনুপাত ৩০। অর্থাৎ ফ্ল্যাটের নির্ধারিত দামের ৭০ শতাংশ ব্যাংক থেকে ঋণ হিসেবে পাওয়া যাবে। এ ছাড়া সরকারি সিদ্ধান্তে আবাসন খাতে গৃহঋণের সুদের হার ১০ শতাংশের নিচে নামিয়ে এনেছে কয়েকটি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান।
ফিনলে প্রপার্টিজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোফাখখারুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, গত এক থেকে দেড় বছরের মধ্যে ফ্ল্যাটের দাম ১০ থেকে ১৫ শতাংশ কমেছে। দাম কমায় ও ঋণসুবিধার আওতা বাড়ায় ফ্ল্যাট কেনার সুযোগ এখন বেড়েছে। তবে সরকার অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের সুযোগ দিলেও অর্থের উৎস সম্পর্কে প্রশ্ন করার সুযোগ রেখেছে। এ কারণে এখনো ফ্ল্যাট কেনার ক্ষেত্রে অপ্রদর্শিত অর্থ ব্যয় করতে ভয় পাচ্ছে অনেকে। বিনা প্রশ্নে অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়া হলে এই খাতে গতি ফিরবে বলে তিনি মনে করেন।
আবাসন ব্যবসার সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, আবাসন খাতের উত্থানের সময় ২০১০ সাল পর্যন্ত রিহ্যাবের বাইরেও শতাধিক আবাসন প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছিল। ঋণের সহজলভ্যতার কারণে চাহিদা বেড়ে গিয়েছিল প্লট ও ফ্ল্যাটের। অভিজাত এলাকায় বেড়ে যায় ফ্ল্যাটের দাম। তবে শেয়ারবাজারে ধসসহ নানা কারণে মধ্যবিত্তদের হাতে নগদ অর্থের প্রবাহ কমে গেলে এ খাতে মন্দা শুরু হয়। তিন বছর ধরে অনেক প্রতিষ্ঠান ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছে। রিহ্যাবের তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রামে রিহ্যাবের সদস্য প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ১০৩টি থেকে কমে দাঁড়িয়েছে ৯২টিতে।
রিহ্যাবের পরিচালক ও সিএ প্রোপার্টি ডেভেলপমেন্ট লিমিটেডের (সিপিডিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইফতেখার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘মন্দার সময় গত কয়েক বছরে ফ্ল্যাট কেনার জন্য গ্রাহকদের দেখা মিলত কম। ইদানীং অনেক গ্রাহক আসছেন। নতুন প্রকল্প সম্পর্কে গ্রাহকেরা জানতে চাইছেন। এ খাতে গতি ফিরে আসার ইঙ্গিত পাচ্ছি আমরা।’
আবাসন ব্যবসায়ীরা জানান, গত জানুয়ারি মাসের শেষে কাতারের দোহায় অনুষ্ঠিত আবাসন মেলায়ও প্রবাসীদের কাছ থেকে সাড়া পাওয়া গেছে। প্রবাসীদের জন্য আবাসন খাতে ব্যাংকের অর্থায়ন চালু হওয়ার কারণে তাঁরা ফ্ল্যাট কিনতে উৎসাহী হচ্ছেন। রিহ্যাবের নেতারা জানান, দোহায় অনুষ্ঠিত মেলায় প্রায় এক শ কোটি টাকার প্লট ও ফ্ল্যাট কেনার অঙ্গীকার পাওয়া গেছে। প্রবাসীদের মধ্যে চট্টগ্রামের বাসিন্দাদের কাছ থেকেই সাড়া পাওয়া গেছে বেশি।
রিহ্যাবের চট্টগ্রাম আঞ্চলিক কমিটির কো-চেয়ারম্যান আবদুল কাদের জিলানী বলেন, তিন বছরে স্থবিরতার সময় যেসব কোম্পানি টিকে ছিল, তারাই মূলত গ্রাহকদের আস্থা অর্জন করেছে।
গ্রাহকেরা সচেতন হওয়ার কারণে এখন ফ্ল্যাট কেনার আগে রিহ্যাবের সদস্যভুক্ত কি না, প্রকল্পের অনুমোদন আছে কি না, তা যাচাই করছেন। ভালো আবাসন কোম্পানির দিকেও নজর দিচ্ছেন গ্রাহকেরা।