গ্রামে বসেই জমজমাট তাঁর অনলাইন রেস্তোরাঁ

ঢাকার একটি রেসরকারি কলেজ থেকে সবে স্নাতক শেষ করেছেন জাকিয়া আফরোজ। স্নাতকোত্তরে ভর্তির আগেই করোনার কারণে বাড়িতে আটকা পড়লেন। সিরাজগঞ্জের বেলকুচি উপজেলার তামাই গ্রামে বসে থাকতে থাকতে জাকিয়ার নিজে কিছু করার ভাবনা এল। তিন বোন আর মা–বাবার সঙ্গে আলাপ করলেন। বাবা তো ভাবতেই পারেননি অনলাইনে ব্যবসা করা যায়। প্রথমে ফেসবুক পেজ খুলে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত শাড়ি, লুঙ্গি, থ্রি-পিস বাজারজাত শুরু করেন জাকিয়া। ভালো সাড়াও পেলেন। তবে এর চেয়েও নতুন কিছু করতে চাইলেন। সিদ্ধান্ত নিলেন একটি অলনাইন রেস্তোরাঁ দেবেন। নিজের গ্রামের নামে রেস্তোরাঁর নাম দিলেন তামাই ফুড কার্ট (টিএফসি)।

প্রযুক্তি ব্যবহার করে উদ্যোক্তা হয়েছেন জাকিয়া আফরোজ
ছবি: প্রথম আলো

২০২০ সালের ৮ ডিসেম্বর চালু হলো টিএফসি। গ্রামের মধ্যেই খাবার সরবরাহ করতে থাকেন। মা–বাবার পাশাপাশি জাকিয়াকে এ কাজে সার্বক্ষণিক সহযোগিতা করেছেন ছোট দুই বোন জুলিয়া আফরোজ ও নুসরাত জেরিন। গ্রামে বসেই নানা স্বাদের খাবার খেতে পারায় গ্রাহকও বাড়তে থাকে তরতর করে। ফলে শুরু থেকেই জমে ওঠে ব্যবসা।

গত ২৬ ফেব্রুয়ারি সকালে ওই রেস্তোরাঁতেই জাকিয়ার সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, ‘তেমন মূলধন ছিল না। আড়াই হাজার টাকা নিয়ে খাবারের উদ্যোগ শুরু করি। এখন শুধু আমাদের গ্রাম নয়, বাইরে থেকেও অর্ডার আসে। নিজ গ্রামসহ আশপাশের এলাকার মানুষের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে টিএফসি।’

জাকিয়াদের নিজের ঘর থেকেই যাত্রা শুরু করেছিল টিএফসি। তবে ছয় মাসের মধ্যেই অর্ডার বাড়তে থাকায় একটা বড় অফিস নিতে হয়েছে। পরিবারের সবাই ছাড়াও এখন টিএফসিতে কাজ করছেন আরও কয়েকজন কর্মী। জাকিয়া আফরোজ বলেন, ‘পরিবারের পাঁচজন থেকে রান্না আর ডেলিভারিসহ এখন আমরা ১৫ জন মিলে পুরো কাজটা করি। এর মধ্যে গ্রামীণফোনের ফিচারড স্টোরিতে টিএফসির গল্প দেখানো হয়েছে। ইচ্ছা ছিল নিজের উপার্জন দিয়ে পড়াশোনা চালাব। সেই সুযোগও তৈরি হয়েছে।’

অর্ডারের খাবার তৈরি করছেন জাকিয়া

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে হিসাববিজ্ঞানে এমবিএ পড়ছেন জাকিয়া আফরোজ। শুধু নিজের লেখাপড়াই নয়, বাকি দুই বোনের পড়াশোনাও সহজ করে দিয়েছে পারিবারিক এ অনলাইন খাবারের উদ্যোগ। ছোট বোন জুলিয়া আফরোজ ঢাকায় হোম ইকোনমিকস কলেজে রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট বিষয়ে স্নাতক করছেন আর সবার ছোট নুসরাত জেরিন এবার ভর্তি হয়েছেন ঢাকার হলিক্রস কলেজে উচ্চমাধ্যমিকে।

আলাদা অফিস নেওয়ার পর থেকে ফরমাশও বেড়েছে অনেক। আগে প্রতিদিন ১০-১৫টি ফরমাশ থাকত, সেটা বেড়ে এখন ২৫-৩০টি হয়েছে। জাকিয়া বলেন, ‘আমাদের সক্ষমতাও বেড়েছে। প্রায়ই এখন বিভিন্ন অনুষ্ঠানের ২৫০ থেকে ৩০০ মানুষের খাবারের অর্ডার নিতে হয়। এ ছাড়া বিভিন্ন অফিশিয়াল অর্ডারও আমরা সরবরাহ করছি।’

জাকিয়া বলেন, ‘আমি কখনো প্রফেশনালি রান্না শিখিনি। ছোটবেলা থেকে রান্নার প্রতি ঝোঁক ছিল, তাই নিয়মিত রাঁধতে পছন্দ করতাম। সেই রান্নার অভিজ্ঞতাই এখন কাজে লাগছে। ভবিষ্যতে ব্যবসাটি আরও বড় করার কাজ চলছে। ইচ্ছা আছে বিভিন্ন জেলায় তামাই ফুড কার্টের শাখা খুলব। হতে চাই দেশের সফল নারী উদ্যোক্তা।’

কী খাবার মেলে টিএফসিতে

পিৎজা, বার্গার, কাচ্চি বিরিয়ানি, রাইসবোল, পাস্তা, তেহারি, চিকেন ফ্রাই, শর্মা, চায়নিজসহ নানা ধরনের খাবার ফরমাশ অনুযায়ী তৈরি ও সরবরাহ করা হয়। সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয় পিৎজা, বার্গার ও রাইসবোল। ২৫০ থেকে ২৭৫ টাকায় পিৎজা, ৯৯ টাকায় রাসইবোল, ৯৯ থেকে ১৫০ টাকায় বার্গার পাওয়া যায়। এ ছাড়া সাধ্যের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন খাবার বিভিন্ন দামে চাহিদা অনুসারে বিক্রি হয়ে থাকে। প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত খাবারের ফরমাশ আসতে থাকে। বিকেলে ও শুক্রবারে ফরমাশের পরিমাণ বেশি থাকে।

যেভাবে চলছে টিএফসি

কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় খুলে যাওয়ায় তিন বোনকেই এখন রাজশাহী ও ঢাকায় ছুটতে হচ্ছে। তবে ব্যবসা পরিচালনায় তেমন সমস্যা হচ্ছে না। জাকিয়া বলেন, ‘আমরা তিন বোন দূরে থেকেও ইন্টারনেটের মাধ্যমে টিএফসি পরিচালনা করতে পারছি। আমার মেজ বোন ফেসবুক পেজের অর্ডার দেখে আর ছোট বোন সামলায় ফোনের অর্ডার। এরপর সেগুলো অনলাইনে মেসেজের মাধ্যমে টিএফসিতে কর্মরত আমাদের সহকারীকে পাঠিয়ে দেয়। তারপর পর্যায়ক্রমে অর্ডারগুলো প্রস্তুত করে গ্রাহকের কাছে পাঠানো হয়।’

টিএফসির খাবার ডেলিভারির জন্য প্রস্তুত

জাকিয়ার রাজশাহীতে ক্লাস থাকে সপ্তাহে দুই দিন। বাকি দিনগুলোতে গ্রামে ফিরে সব কাজের দেখাশোনা করেন। জাকিয়ার বাবা নাছিমুল গণি প্রতিদিনের প্রয়োজনীয় কেনাকাটা ও অর্ডার অনুযায়ী যথাসময়ে খাবার পৌঁছানোর তদারক করেন। এ কাজের জন্য আছে পাঁচজন কর্মী। পাঁচজন নারী কর্মীকে নিয়ে খাবার প্রস্তুতের দেখভাল করেন জাকিয়ার মা।

রান্না বিষয়ে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নিয়ে আরও দক্ষ হয়ে উঠতে চান জাকিয়া। গ্রামে বসে শুধু একটি ফেসবুক পেজের মাধ্যমে অনলাইনে রেস্তোরাঁ চালিয়ে সফল হওয়া যায়, বিষয়টি ভাবতেই এখন তাঁর অবাক লাগে। বলেন, ‘উদ্যোক্তা হওয়ার পর নিজেকে স্বাধীন মনে হচ্ছে। ভাবতে ভালো লাগে, আমাদের কারণে আরও কিছু মানুষ নিজের পায়ে দাঁড়ানোর সুযোগ পাচ্ছেন।’