ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনার প্রতি অসীম আগ্রহ ছিল রংপুর তারাগঞ্জের মেয়ে বর্ষা রানীর। পেশায় ভ্যানচালক বাবার বয়স হওয়ায় আর ভ্যান চালাতে পারতেন না। ফলে বর্ষার মাকে অন্যের জমিতে কাজ করে সংসার চালাতে হতো। কিন্তু মায়ের আয়েও সংসার চলত না। খুব স্বাভাবিকভাবেই সংসারে অভাব–অনটন ছিল নিত্যসঙ্গী। তাই মায়ের সঙ্গে দিনমজুরি করতে হতো বর্ষাকেও। বর্ষা যখন নবম শ্রেণিতে উঠে বুঝতে পারলেন, পড়াশোনার জন্য বই কিনে দেওয়ার সামর্থ্য তাঁর পরিবারের নেই।
মা-বাবার ওপর চাপ দেননি বর্ষা। সহপাঠীদের কাছ থেকে বই ধার নিয়ে পড়াশোনা করেছেন। একসময় পরিবারের আর্থিক অবস্থা জানিয়ে বর্ষা স্কুল কর্তৃপক্ষের কাছে পরীক্ষার ফি মওকুফের আবেদন করেন। স্কুল কর্তৃপক্ষ তাঁর সেই আবেদন মঞ্জুর করে। কৃতজ্ঞচিত্তে বর্ষা তা স্মরণ করে বললেন, ‘সেদিন আমার স্কুলের স্যাররা এই সুযোগ না দিলে আজকে আমি এই পর্যায়ে আসতে পারতাম না।’ এসএসসিতে ভালো ফলের পর যেন বর্ষার বিপদ বেড়ে গেল। কীভাবে কলেজের খরচ জোগাবেন, সেই চিন্তায় যখন বর্ষা দিশাহারা, তখন প্রথম আলোর পাতায় তাঁকে নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হলো।
বর্ষা রানী ব্র্যাক ব্যাংক-প্রথম আলো ট্রাস্ট অদম্য মেধাবী শিক্ষাবৃত্তির জন্য মনোনীত হলেন। সামনে এগিয়ে যাওয়ার পথটা যেন একটু মসৃণ হলো। বর্ষা বলেন, ‘২০১০ সালে ঢাকায় অদম্য মেধাবী সংবর্ধনায় এসে যখন অন্য অদম্যদের গল্প শুনলাম, তাঁদের গল্প আমাকে অনুপ্রাণিত করল। আমার কাছে মনে হলো, আমার তো কেবল পারিবারিক এবং আর্থিক প্রতিকূলতা। আমি তো শারীরিকভাবে সুস্থ, আমি কেন এগিয়ে যেতে পারব না। আমি এগিয়ে যাওয়ার সাহস পেলাম। সব মিলিয়ে আমার ভাবনার জগৎ, আমার দেখার চোখ সবকিছু পাল্টে গেল সেই অনুষ্ঠানে। নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করলাম। আমার কেবল মনে হচ্ছিল আমাকে আবার ভালো ফলাফল করতে হবে।’
নিজের প্রতিজ্ঞা রেখেছিলেন বর্ষা। বর্ষা রানী ২০১২ সালে উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়েও জিপিএ–৫ পেয়েছিলেন। সেবারের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে জানিয়েছিলেন, ‘আমি একজন আদর্শ শিক্ষক হতে চাই। আমি ছোটবেলায় আমার শিক্ষকদের কাছ থেকে যে ভালোবাসা পেয়েছি, আমি চাই আমি যা অর্জন করেছি, তার সর্বোচ্চ যেন আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিতে পারি।’ বর্ষা স্নাতক সম্পন্ন করেন রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। তিনি তারাগঞ্জের যে গ্রামে জন্মেছিলেন, সে গ্রামের কেউ তখন উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত পড়াশোনা করেননি। এমন একটি গ্রামের মেয়ে বর্ষা এখন লালমনিরহাট সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক।
বর্ষা বলেন, ‘আমি আমার পাড়া, আমার স্কুল, কলেজ এমনকি আমার গ্রামের প্রথম সরকারি চাকরিজীবী। আমাকে দেখেই আমার পরিবার ও আশপাশের মানুষেরা জেনেছেন, মেয়ে হয়েও এতটা পড়াশোনা করা যায়, প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক হওয়া যায়। এরপর আমি যখন মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষক হলাম, এখন সবাই বুঝলেন, নিজের চেষ্টা থাকলে, অনেক দূর যাওয়া যায়। আমি এখনো পড়াশোনা করছি, যেহেতু আমাকে আমাদের গ্রামের ছেলেমেয়েরা অনুসরণ করে, আমার পক্ষে যত দূর যাওয়া সম্ভব আমি করে যাব। আমি অন্যদের মধ্যে
স্বপ্ন দেখার ইচ্ছাটা তৈরি করতে চাই, বোঝাতে চাই, স্বপ্ন দেখলেই মনের আকাশটা বড় হয়ে ধরা দেয়।’