যদি ভেবে থাকেন বিনোদনশিল্পের (এন্টারটেইনমেন্ট ইন্ডাস্ট্রি) মধ্যে খেলাধুলা, সিনেমা কিংবা গানের রাজত্ব সবচেয়ে বড়, ভুল করবেন। টাকাপয়সার বিবেচনায়ও গেমিং এখন বিশ্বের সবচেয়ে বড় বিনোদনশিল্প। এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেমাররাও আয় করছেন নানাভাবে। বাংলাদেশে গেমিংয়ের চর্চা খুব বেশি দিনের নয়। তবে আমাদের দেশেও অনেক তরুণ এখন পেশাদার গেমার হওয়ার কথা ভাবছেন। গেমিং থেকে আয়ের নানা খাত আছে। কয়েকটি সম্পর্কে আলোচনা করা যাক।
১. প্রাইজমানি
দেশে-বিদেশে প্রতিনিয়তই আয়োজিত হচ্ছে বিভিন্ন গেমিং প্রতিযোগিতা। অনলাইন-অফলাইন দুই ধরনের প্রতিযোগিতাতেই থাকে বড় অঙ্কের প্রাইজমানি। টুর্নামেন্টগুলোতে ভালো করে আয় করতে পারেন গেমাররা। গত বছরের শেষ দিকে স্টারটেকের পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) অনুষ্ঠিত হয়েছিল ‘ইন্ট্রা-বুয়েট ভ্যালোরেন্ট কাপ’। ৩০টি দলের অংশগ্রহণে আয়োজিত এই টুর্নামেন্টের প্রাইজপুল (পুরস্কারের মোট অঙ্ক) ছিল ৫৫ হাজার টাকা। টুর্নামেন্টের রানার্স আপ ‘টিম মুরগিব্লাস্টারস’ দলের সদস্য মিনহাজুর রহমান বলছিলেন, ‘আসলে প্রাইজপুলের ব্যাপারটা কমবেশি পুরোটাই স্পনসরের ওপর নির্ভরশীল। স্পনসররা যখন দেখেন একটা ইভেন্ট সফল হয়েছে, তখনই তাঁরা আরেকটু বেশি প্রাইজপুলের ইভেন্ট করার কথা ভাবেন। তবে সামগ্রিকভাবে চিন্তা করলে শুধু প্রতিযোগিতার প্রাইজমানির ওপর নির্ভর করে এ দেশে পেশাদার গেমার হওয়া খুব ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ বাইরের তুলনায় আমাদের দেশে প্রাইজমানির অঙ্কটা খুব ছোট। আর সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে খুব বেশি টুর্নামেন্টও হয় না।’ তবে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতাগুলোতে অংশ নিয়ে বড় অঙ্কের প্রাইজমানি জেতার সুযোগ তো থাকছেই।
২. স্পনসর বা পৃষ্ঠপোষক
প্রতিযোগিতাগুলোতে ভালো করলে জুটে যেতে পারে নিজস্ব স্পনসর বা পৃষ্ঠপোষক। নির্দিষ্ট সময়ের জন্য স্পনসরশিপের চুক্তিতে আবদ্ধ হয়ে অনেক গেমার ভালো অঙ্কের টাকা আয় করেন। ক্ষেত্রবিশেষে শুধু নির্দিষ্ট টুর্নামেন্ট বা প্রতিযোগিতার জন্যও স্পনসরশিপ পান অনেক গেমার।
৩. চাকরিজীবী গেমার
মাসিক বেতনের বিনিময়ে কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েও খেলেন অনেক গেমার। সেই প্রতিষ্ঠানের হয়ে বিভিন্ন টুর্নামেন্টে অংশ নেন তাঁরা।
৪. স্ট্রিমিং
ইউটিউব: জনপ্রিয় ভিডিও শেয়ারিং প্ল্যাটফর্ম ইউটিউবে গেম স্ট্রিমিংয়ের (খেলা ভিডিওতে সরাসরি সম্প্রচার) মাধ্যমে আয় করছেন অনেক গেমার। ইউটিউব চ্যানেলের মনিটাইজেশন অপশন চালু হওয়ার পর শুরু হয় আয়।
টুইচ: গেমারদের কাছে টুইচ ভীষণ জনপ্রিয়। টুইচ এমন একটি ওয়েবসাইট, শুধু গেম স্ট্রিমিংয়ের জন্যই যা তৈরি করা হয়েছে। এই ওয়েবসাইটে লাইভ গেমের ভিডিও দেখা যায়। এই প্ল্যাটফর্মে গেমের ভিডিও স্ট্রিম করেও আয় করছেন অনেকে।
ফেসবুক: ফেসবুকেও গেম স্ট্রিমিংয়ের মাধ্যমে আয়ের সুযোগ আছে। ভিডিওতে আসা বিজ্ঞাপন থেকে যেমন আয় হয়, তেমনি রয়েছে ভক্ত কিংবা অনুসারীদের থেকে অনুদান পাওয়ার সুযোগ। অন্যান্য দেশে ইউটিউব এবং টুইচ স্ট্রিমিং বেশি জনপ্রিয় হলেও এ দেশে ফেসবুক স্ট্রিমিংই এগিয়ে আছে বলে মনে করেন গেমার ও ফেসবুক স্ট্রিমার শিহাব ইমতিয়াজ। গত সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ ও মালদ্বীপের গেমারদের নিয়ে অনুষ্ঠিত ‘স্কাইইস্পোর্টস চ্যাম্পিয়নশিপ ৩.০’–এর বিজয়ী দলের এই সদস্য বলেন, ‘মূলত করোনাকালের বিধিনিষেধের সময় থেকে এ দেশে ফেসবুকে গেম স্ট্রিমিংয়ের প্রসার হয়েছে। আমিও ২০২০ সালের দিকেই স্ট্রিমিং শুরু করি। এ দেশের গেমার কিংবা অডিয়েন্স যা-ই বলেন, দুই পক্ষই ফেসবুকে তুলনামূলকভাবে বেশি সক্রিয়। এ ছাড়া ফেসবুক স্ট্রিমিং থেকে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার সুযোগ তো আছেই।’
৫. মান নিশ্চিতকরণ পরীক্ষা
একটি গেম বানানোর পর নানাভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। গেমের মধ্যে কোনো বাগ বা ত্রুটি থাকতে পারে। এই ত্রুটি শনাক্ত করতে সহায়তা করতে পারেন একজন পেশাদার গেমার। একে বলা হয় ‘কোয়ালিটি অ্যাসুরেন্স টেস্টিং’ (মান নিশ্চিতকরণ পরীক্ষা)। গেম নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো পারিশ্রমিকের বিনিময়ে পেশাদার গেমারদের নিয়োগ করে। গেমাররা নির্মাণাধীন গেমের সমস্যা বা ত্রুটি ধরিয়ে দেন। সেগুলো আমলে নিয়ে নির্মাতা প্রতিষ্ঠান নতুন করে কাজে নামে।
শ্রাউড
শ্রাউডের আসল নাম মাইকেল। ‘কাউন্টার স্ট্রাইক-গ্লোবাল অফেন্সিভ’ গেমার হিসেবে নিজের ক্যারিয়ার গড়লেও ২০১৮ সালে অবসর নিয়ে এখন পুরোদস্তুর স্ট্রিমার এই কানাডীয় তরুণ। গেমারদের স্ট্রিমিং সাইট টুইচে তাঁর ফলোয়ারের সংখ্যা ৯৫ লাখ। আর ইউটিউবে সাবস্ক্রাইবারের সংখ্যা ৬৫ লাখ। বাংলাদেশে তৈরি গেম ‘জিরো আওয়ার’ সম্প্রতি টুইচে স্ট্রিম করেছেন তিনি। শুধু টুইচে স্ট্রিমিং করেই তাঁর মাসিক আয় প্রায় ৫০ হাজার মার্কিন ডলার (৪৩ লাখ টাকার বেশি)!
টেনজ
টেনজের আসল নাম টাইসন। তিনিও কানাডার বাসিন্দা। ‘সেন্টিনেলস’ নামে একটি মার্কিন ই-স্পোর্টস প্রতিষ্ঠানের হয়ে খেলেন তিনি। এই প্রতিষ্ঠান থেকে মাসে যা বেতন পান, টাকার অঙ্কে সেটি দুই কোটির বেশি। এ বছর জিতেছেন ‘ভিসিটি ২০২১: নর্থ আমেরিকা স্টেজ থ্রি চ্যালেঞ্জার্স প্লে-অফস’ শিরোনামের অনলাইন টুর্নামেন্ট। এ ছাড়া ঝুলিতে রয়েছে আরও অনেক প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হওয়ার রেকর্ড। টুইচে তাঁর অনুসারীর সংখ্যা ১৭ লাখ। ইউটিউবে সাবস্ক্রাইবার ১০ লাখ ছুঁয়েছে।
ইটজ টিমি
আসল নাম টিমি এন। মার্কিন এই গেমারের বয়স মাত্র ২১ হলেও স্ট্রিমিংয়ের জগতে তিনি বেশ জনপ্রিয়। মূলত এপেক্স লেজেন্ডস নামের গেমটিই তিনি খেলেন। স্রেফ ভিডিও স্ট্রিমিং করেই পেশাদার এই গেমারের মাসিক আয় প্রায় সাড়ে তিন লাখ টাকা। টুইচে তাঁর ফলোয়ার ১১ লাখ।