ডালিয়া রহমান দুই বছর আগে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ভালো চাকরিটি ছেড়ে দিলেন। বললেন, ‘আর সামলাতে পারছিলাম না। কিন্তু চাকরি ছেড়েও লাভ হলো না। সবাই ভাবছে, এখন আমার হাতে অফুরন্ত সময়। কিন্তু সংসার যে একটা ২৪ ঘণ্টার বিরতিহীন চাকরি, সেটাই সমাজ বোঝে না।’
চাকরি ছেড়ে ডালিয়াকে শুনতে হচ্ছে তিনি কিছু করেন না। ডালিয়ার মতে, এটা এক ধরনের মানসিক নির্যাতন। বললেন, ‘আমার কাজগুলো কেউ ভাগ করে নিক। পরিবারের কাজ, তাই কাজের জন্য আর্থিক মূল্য চাইছি না, তবে স্বীকৃতিটা চাই। কাজের অংশীদারত্ব চাই।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে রাজধানীর এক একজন গৃহিণী জানালেন, স্বামী আর শ্বশুরবাড়ির লোকজন প্রায়ই তিনি কিছু করেন না বলে কথা শোনাতেন। তারপর তিনি তাঁর স্বামীকে সারা দিনের কাজের ফিরিস্তি দিলেন। সকালের নাশতা বানানো, কাপড় ধোয়া, সন্তানকে স্কুলে নিয়ে যাওয়া, বৃদ্ধ শ্বশুরের সেবা করা, সন্তানকে পড়ানোসহ সব কাজই তিনি করছেন। এই কাজগুলোই যদি গৃহকর্মী, গৃহশিক্ষক অথবা নার্সকে দিয়ে করানো হতো, তাহলে কত টাকা দিতে হতো? স্বামী কিছুটা থমকে গিয়েছিলেন। এই গৃহিণীর মতে, ‘ চাওয়া শুধু আমার কাজটাকে অন্যরা সম্মান করুক। ’
এই গৃহিণীর মুখে কিছুটা হাসির রেখা দেখা দেয়। জানালেন, স্বামী এখন তাঁকে ঘরের কাজে কিছুটা সহায়তা করেন।
বিভিন্ন গবেষণায় গৃহে নারীর সেবামূলক কাজে ব্যয়িত সময়ের নানান হিসাব এখন প্রকাশ্য। তবে নারীর এই কাজের অর্থনৈতিক বা সামাজিক স্বীকৃতি নেই।
গবেষক, অর্থনীতিবিদ এবং নারীনেত্রীরা মনে করছেন, জিডিপির (মোট দেশজ উৎপাদন) বাইরে একটি ‘স্যাটেলাইট অ্যাকাউন্ট’ করে নারীর গৃহস্থালির সেবামূলক কাজের হিসাব করার সময় এসেছে। এতে ঘরে ও বাইরে কাজের চাপ সামলানোর পরও নারীকে যে ধরনের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন সহ্য করতে হয়, তা কমবে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতে, সামাজিক সচেতনতা তৈরি করে পুরুষের অংশগ্রহণ বাড়ানোও জরুরি।
চলতি বছরের মে মাসে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রকাশিত এক প্রতিবেদন বলছে, দেশে নারীরা পুরুষের তুলনায় সাড়ে তিন গুণ বেশি মজুরিবিহীন কাজ করেন। নারী দিনে প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা মজুরিবিহীন কাজ করেন আর পুরুষ করেন গড়ে এক ঘণ্টা। বিবিএসের সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপও বলছে, ২০১৭ সালের শেষে সারা দেশে ৭২ লাখ নারী-পুরুষ মজুরিবিহীন কাজ করতেন। এর মধ্যে নারীর সংখ্যা ৫৪ লাখ। আর ১৮ লাখ পুরুষ এমন কাজ করেন।
নারীর গৃহস্থালির সেবামূলক কাজকে জিডিপির অন্তর্ভুক্ত করার কথা বলা হচ্ছে অনেক দিন থেকেই। তবে কোন পদ্ধতিতে জিডিপিতে অন্তর্ভুক্ত করা হবে, তা নিয়ে মতভেদ আছে। অর্থনীতিবিদ ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বললেন, কিছু কিছু দেশ নারীর গৃহস্থালির কাজকে মূল জিডিপির বাইরে আলাদা হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করছে। এ হিসাব রাখার জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সামাজিক সচেতনতা। এ ছাড়া গৃহস্থালির কাজগুলোকে কীভাবে সহজ করা যায়, তা নিয়েও ভাবা উচিত।
মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের জেন্ডার উপদেষ্টা বনশ্রী মিত্র নিয়োগী বললেন, গৃহস্থালির সেবামূলক কাজের অর্থনৈতিক ও সামাজিক স্বীকৃতি দিতে হবে। সংসার সামলেও একজন নারী যাতে নিজের পছন্দ অনুযায়ী চাকরি বা ব্যবসা করতে পারেন, তার সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। সরকারকে নারীর কাজের জন্য নানান সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে হবে।
বনশ্রী মিত্র নিয়োগী জানালেন, জিডিপির পাশাপাশি ‘স্যাটেলাইট সিস্টেম অব অ্যাকাউন্ট’ চালু করতে হবে। যে কাজের অর্থনৈতিক বিনিময় মূল্য আছে, তা এই অ্যাকাউন্টে যায়। একজন মানুষ দৈনন্দিন সময়ের কতটুকু সময় কোন কাজে ব্যয় করছেন, তার হিসাব এখানে করা হয়। কৃষিকাজে চাল উৎপাদনের ২৩টি ধাপের ১৭টি কাজ করছেন নারী। তবে নারীর এই কাজও জিডিপিতে হিসাবের বাইরে থেকে যাচ্ছে। কাজগুলোকে গৃহস্থালির কাজ বলে আখ্যায়িত করার ফলেই এ সমস্যা হচ্ছে।
গত বছরের নভেম্বরে একশন এইড বাংলাদেশ ও জাতীয় নারী নির্যাতন প্রতিরোধ ফোরামের এক যৌথ গবেষণা বলছে, শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতনের শিকার যে নারীরা আইনের আশ্রয় নেন, তাঁদের ৬৬ শতাংশই পারিবারিক সহিংসতার শিকার।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সীমা মোসলেম কাজের অভিজ্ঞতায় বললেন, পারিবারিক সহিংসতার মাত্রা দিন দিন বাড়ছে। স্ত্রী কর্মজীবী বা গৃহিণী যা-ই হোন, ঘরের কাজে একটু গাফিলতি বা স্বামীকে কোনো কিছুর জন্য একটু অপেক্ষা করতে হলেই স্ত্রীর প্রতি সহিংস আচরণ করেন। নারীর গৃহস্থালির কাজের স্বীকৃতি হয়তো এ ক্ষেত্রে কিছুটা পরিবর্তন আনতে পারে। আর এ জন্য নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে।