প্রতিটি ঋতুতেই প্রকৃতি তার নিটোল সৌন্দর্য নিয়ে উপস্থিত হয়। শীতও ব্যত্যয় ঘটায় না। বরং হাড়হিম শীত আমাদের স্মৃতিকাতর করে; ফিরিয়ে নেয় শৈশব-কৈশোরের দিনগুলোতে। খেজুরের রস আর নলেন গুড়ের ম-ম গন্ধ নাসারন্ধ্রে ফিরে ফিরে আসে। আর তা হবে নাই-বা কেন, বাংলার শীতের সঙ্গে খেজুরের রস আর খেজুরের গুড় তো সমার্থক। তবে তা কেবল খাদ্যসংস্কৃতির ঐতিহ্য বা স্বাদেই নয়, বরং এর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে শারীরবৃত্তীয় সম্পর্কও; এসব সম্পর্কে আমরা সম্যক অবগতও হয়তো নই।
ইতিহাসের পাতায়
সদুক্তিকর্ণামৃত নামের সংস্কৃত কাব্যগ্রন্থের রচয়িতা শ্রীধরদাস। তিনি শ্রী বটুদাসের ছেলে। এই বটুদাস ছিলেন লক্ষ্মণ সেনের সামন্ত অধিপতিদের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী (মহাসামন্তচূড়ামণি)। সদুক্তিকর্ণামৃত গ্রন্থেই আছে বাংলার ঋতুর অনবদ্য বর্ণনা। নলেন গুড়ের বন্দনা আছে বলে উল্লেখ করেছেন ঐতিহাসিক নিহাররঞ্জন রায়, তাঁর গ্রন্থ বাঙ্গালীর ইতিহাস আদিপর্ব-এ। তিনি লিখেছেন, এই বঙ্গদেশে যে তিন রকমের রস থেকে গুড় তৈরি হয় তা হলো আখ, খেজুর ও তাল। তবে এর মধ্যে স্বাদে-গন্ধে খেজুরের রসই যে সেরার সেরা। এ ছাড়া খেজুরের উল্লেখ ধর্মপালের খালিমপুর-লিপিতে পেয়েছেন বলেও উল্লেখ করেছেন তিনি।
খেজুরের গুড়ের জন্য দক্ষিণবঙ্গের জেলাগুলোর প্রসিদ্ধি বেশি। তবে উত্তরবঙ্গেও মেলে ভালো গুড়। একসময় যশোরের গুড়ের বিশেষ সুনাম ছিল। এখনো অবশ্য সেটা আছে। ঐতিহাসিক সতীশ চন্দ্র মিত্রের যশোহর খুলনার ইতিহাস বইতে পাওয়া যায়, ১৯০০-১৯০১ সালে পূর্ববঙ্গে খেজুরের গুড় তৈরি হয়েছে ২১ লাখ ৮০ হাজার ৫৫০ মণ। এর মধ্যে শুধু যশোরেই তৈরি হয়েছে ১৭ লাখ ৯ হাজার ৯৬০ মণ গুড়। ১৮৬১ সালে মিস্টার নিউ হাউস চৌগাছার কপোতাক্ষ নদের পারে তাহেরপুরে প্রথম খেজুরের গুড় উৎপাদনের যান্ত্রিক কারখানা গড়ে তোলে। ওই কারখানার উৎপাদিত গুড় ইউরোপে রপ্তানি হয়েছে। পরবর্তী সময়ে যশোরের বিভিন্ন গ্রামে ১১৭টি কারখানা গড়ে ওঠে।
সাহিত্যের পরতে পরতে
যে কেউ জ্বাল দিলে গুড় হয় বটে, তবে সেই স্বাদ হয় না। গুড় তৈরির জন্য লাগে পাকা হাত। রস জ্বালের সঙ্গে ঘনত্বের ভারসাম্য রাখার প্রক্রিয়া (স্থানীয় ভাষায় বলে বীজ মারা) খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই বিচ্ছেদের পরেও দুই হাঁড়ি খেজুর রস নিয়ে মোতালেফ মিয়াঁর ছোটা লাগে আগের বউ মাজু খাতুনের কাছে। কারণ, নতুন বউ ফুলবানুর হাতে ওই জাদু নেই। ফুলবানুর পাক দেওয়া গুড় বাজারে বিকোয় না।
পাঠক হয়তো ভাবছেন মোতালেফ মিয়াঁ আর মাজু খাতুনেরা কোথা থেকে এল। ঠিকই, খেজুর রস আর গুড় তৈরি নিয়ে অপূর্ব এক জীবননিষ্ঠ গল্প লিখেছেন নরেন্দ্রনাথ মিত্র। গল্পের নামও ‘রস’। খেজুরগাছে খাঁজ কাটার বিদ্যা, রস পাড়ার বিদ্যা থেকে রস জ্বাল দিয়ে গুড় তৈরির মুনশিয়ানার সঙ্গে জীবনের উতর-চাপানের যে সম্পর্ক, তা নিখুঁতভাবেই ধরেছেন নরেন্দ্রনাথ মিত্র।
বংশপরম্পরার এক অনবদ্য শিল্প গাছ কাটা, রস সংগ্রহ ও গুড় তৈরি। ভাবলে অবাক লাগে মরুভূমিতে বেশুমার খেজুরগাছ থাকলেও সেখানকার মানুষের অসাধ্য এই শিল্প। সেখানে ফলই মুখ্য। অথচ আমাদের এই তল্লাটে ফল নয়, রসই মূল। বাঙালির জীবনে পরতে পরতে জড়িয়ে রয়েছে খেজুরের রস আর গুড়।
গুড় নিয়ে লিখতে গেলে সুকুমার রায়ের ‘ভালরে ভাল’ ছড়ার উল্লেখ না করলে অন্যায় হবে। অদ্ভুত সুন্দর এই ছড়াটির শেষ চারটে লাইন শুনলে মন্দ হয় না: শিমুল তুলো ধুন্তে ভাল,/ ঠাণ্ডা জলে নাইতে ভাল,/ কিন্তু সবার চাইতে ভাল-/ পাউরুটি আর ঝোলা গুড় ।
পাউরুটি দিয়ে গুড় খাওয়ার চল সম্পর্কে হালের প্রজন্ম জানেই না। রুটি, বিশেষত, পরোটা দিয়ে ঝোলা গুড় আর পাটালির স্বাদও কিন্তু অনন্য। অবশ্য যে যা-ই বলুক, দুধ আর ভাতের সঙ্গে ঝোলা গুড়ই হোক বা পাটালির মিশ্রিত স্বাদ এককথায় অপূর্ব।
খেজুরের গুড়ের স্বাস্থ্যগুণ
খেজুরের গুড় শীতে কেন খেতে হবে? কারণ, গুড় উচ্চ ক্যালরিযুক্ত। শরীরের জন্য শীতে এর প্রয়োজন রয়েছে। কারণ, গুড় শরীরে তাপমাত্রা উৎপাদন করে এবং সেটা ধরে রাখতে সহায়তা করে। অথচ এর ক্যালরির পরিমাণ চিনির চেয়ে কম। এই গুড়ই আবার অ্যান্টি-ফ্যাট। এ ছাড়া এতে পুষ্টি উপাদানের পাশাপাশি আছে আয়রন, ফসফরাস, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, পটাশিয়াম, কপার, জিঙ্ক, ভিটামিন বি এবং সি।
ভালো গুড় জ্বর-জারি, সর্দি-কাশি প্রতিরোধ করে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। শ্বাসনালি, খাদ্যনালি, পাকস্থলী, অন্ত্র ও ফুসফুসে অবাঞ্ছিত রোগের আক্রমণ প্রতিহত করে। রক্তনালি প্রসারিত করে রক্তের প্রবাহ স্বাভাবিক করার পাশাপাশি হিমোগ্লোবিনের মাত্রাকেও নিয়ন্ত্রণে রাখে।
ইন্টারনেট ঘেঁটে এও জানা গেল খাবার পর প্রতিদিন যদি একটু করে গুড় খাওয়া যায়, তাহলে হজম ভালো হয়। গুড় আমাদের হজমে সাহায্যকারী এনজাইমের শক্তিকে বাড়িয়ে দেয়। এখানে বলে রাখা, ভালো সাদা চিনির চেয়ে গুড়ের ক্যালরি কম। ফলে অনায়াসেই গুড় হতে পারে চিনির বিকল্প।
মধুবৃক্ষের মধুরস
শীত এলে বাঙালির মন মধুরস আর তা থেকে তৈরি গুড় নামক অমৃতে মজবে না, তা কি হয়। আর এই রস মেলে মধুবৃক্ষ থেকে। আসলে খেজুরগাছকে মধুবৃক্ষ বলা হয়। বাংলাদেশে একসময় সবচেয়ে বেশি খেজুরগাছ ছিল যশোরে। কেবল সেখানেই নয়, কমেছে সর্বত্র। অবাক করা বিষয় হলো, সবচেয়ে অযত্নে-অবহেলায় বাড়ে খেজুরগাছ। অথচ বিজ্ঞানভিত্তিক উপায়ে চাষ করলে যথেষ্ট সুফল পাওয়া সম্ভব।
গাছ ঝোড়া ও রস সংগ্রহ
হেমন্ত এলে হিমেল হাওয়া বইতে শুরু করলে শুরু হয় খেজুরগাছ কাটা। একে বলা হয় গাছ ঝোড়া। অর্থাৎ এক বছরের মরা, আধামরা পাতা কেটে ময়লা পরিষ্কার করে পরিপাটি করে তোলা। তারপর কয়েক দিন বিরাম দিয়ে গাছ চাঁছা হয়। এক বছর যেদিকে চাঁছা হয়, পরের বছর হয় ঠিক উল্টো দিকে। চাঁছার শেষ পর্যায়ে এসে নলি বসিয়ে রেখে আসা হয়। তারপর রস আসতে শুরু করলে ভালো করে আরও একবার চেঁছে নলির মুখে মাটির ভাঁড় বেঁধে দেওয়া হয়। তার আগে ভাঁড় ভালো করে ধুয়ে রোদে শুকিয়ে খড়ের আগুনে সেঁকে জীবাণুমুক্ত করে নেওয়া হয়।
এ প্রসঙ্গে প্রণিধানযোগ্য আব্দুল জব্বারের ‘বাংলার চালচিত্র’-এর চমৎকার বর্ণনা: খেজুর গাছের পাতা ঝরানো হয়ে গেলে চাঁদি চেঁছে পাটিচাঁছ দিয়ে নলী পুঁতে দিয়ে আসতে হয়। তারপর প্রথম যেদিন চাঁছলে ঘাট গড়িয়ে নলী বেয়ে রস পড়ে ফোঁটা ফোঁটা করে, সেদিন ভাঁড় বাঁধেতে হয়। বুড়ী গাছে রস কম হয়, রসের রঙ হয় সোনালী। সেই রস হল বেশি স্বাদের আর বেশি মিষ্টি। কাঁচা রস খাওয়ার সাধ হলে চাষীরা সন্ধ্যার পর অথবা সকালে সেই রসই খায়। চারা গাছে অথবা খুব তেজী গাছের রস বেশি হয়। জলীয় অংশ তাতে বেশি থাকে। প্রথম দিনের যে রস হয় তাকে ‘নলেন’ রস বলে। পরের দিনের রসের নাম ‘দো-কাটের রস’ বা ‘ঝারা’। তৃতীয় দিনে আর কাটা হবে না।
শীত যত বাড়ে, সমান্তরালে বাড়ে রস। তৃতীয় দিনের রস হলো গিয়ে নিমঝরা। চতুর্থ দিনের রস হলো ওলা। টানা চার দিন রস পাড়ার পর আবার তিন দিন জিরেন (বিশ্রাম) দিতে হয়। এরপর আবার গাছা চাঁছা হয়। ময়লা পরিষ্কার করা হয়। ময়লা পরিষ্কার করতে ব্যবহার করা হয় খেজুরের বড় কাঁটা। তারপর ভাঁড় বাঁধা হয়। বিশ্রামের পর প্রথম রসকে জিরেন-কাটের রস বলে।
এই কাজ যাঁরা করেন তাঁরা স্থানভেদে গাছি বা শিউলি নামে পরিচিত। গাছ কাটতে যাওয়ার আগে তাঁদের প্রস্তুতিও দেখার মতো। জলবায়ু পরিবর্তনের কারসাজিতে শীত পেছাচ্ছে। ফলে রসসংগ্রহের প্রক্রিয়াও বিলম্বিত হচ্ছে। তবে এই রস সন্ধ্যায় বা সকালে খাওয়ার মজাই আলাদা। অথচ বর্তমানে নিপাহ ভাইরাস সংক্রমণের ভয়ে এখন অনেকেই কাঁচা রস খেতে ভয় পান।
নলেনবৃত্তান্ত
নতুন রস থেকে তৈরি গুড়ই নলেন গুড়। নলেন মানে নতুন। নলেন শব্দটি নাকি সংস্কৃত। অন্যমতে এটা দ্রাবিড়ীয় শব্দ; ‘ণরকু’ থেকে এসে থাকবে। কারণ, এর অর্থ ছেদন করা। আবার ব্রজবুলি শব্দ ‘নওল’ বা নতুন থেকেও নলেন শব্দটির উদ্ভব বলে মনে করা হয়। এই নলেন গুড়ের আরও একটা নাম আছে—লালি গুড়। দ্বিতীয় ও তৃতীয় দিনের রস থেকেও গুড় হয়। তৃতীয় দিনের রস কিছুটা গেঁজিয়ে ওঠে বলে এই রসের গুড় ততটা উপাদেয় নয়; বরং একে বলা হয় চিটে গুড়। সাধারণত গরুকে খাওয়ানো হয়।
হাজারি থেকে অর্গানিক গুড়
মানিকগঞ্জের ঝিটকার ইতিহাস-প্রসিদ্ধ হাজারি গুড়ের কথা আমরা অনেকেই জানি। বংশপরম্পরায় টিকে রয়েছে খেজুরের গুড় তৈরির অনবদ্য এই শিল্প। কেবল গাছ কাটার জন্য বর্তমানে একজনকে তিন মাসে ৭৬ হাজার টাকা দেওয়া হচ্ছে বলে জানা গেছে। আর এই গুড়ের দাম প্রতি কেজি ১৮০০ টাকা। তবে ভালো মানের গুড় বর্তমানে ৫০০ টাকা কেজিতে পাওয়া যাচ্ছে।
ভেজাল ও নির্ভেজাল
গুড়ে বালি বাগধারার সঙ্গে আমরা পরিচিত। এখন রূঢ় বাস্তব। কারণ, গুড়ে দেদার মেশানো হচ্ছে ভেজাল। কিছুদিন আগেও এক ভাঁড় রসে ইচ্ছামতো চিনি মিশিয়ে পাটালি তৈরি করা হতো পরিমাণে বেশি করার জন্য। বর্তমানে চিনির জায়গা নিয়েছে হাইড্রোজ। অবশ্য এখন আর খেজুরের গুড় তৈরি করতে খেজুরের রস লাগে না। বরং নানা রাসায়নিক পদার্থ দিয়ে তৈরি বস্তুতে নলেন গুড়ের এসেন্স মিশিয়ে তৈরি হয়ে যাচ্ছে ‘খাঁটি’ নলেন গুড়!
তবে সুখের বিষয় হলো, একদিকে যেমন চলছে ভেজালের কারসাজি, অন্যদিকে ততটাই বাড়ছে মানুষের সচেতনতা। একইভাবে অনেকের ভালো জিনিস সরবরাহের ইচ্ছাও।
হাট থেকে ই-কমার্স
আগে গুড় হাটে বা বাজারে গিয়ে কিনতে হতো। সেই প্রথা একেবারে উঠে যায়নি, বরং বাঁশের ঝুড়িতে নতুন ওঠা ধানের বিচালি দিয়ে তার ওপর অতীব যত্নে পাটালি বা গুড়ের ভাঁড় সাজিয়ে নতুন গামছা দিয়ে ঢেকে বাঁশের ভাঁড়া বা বাঁকের দুপাশে রশি দিয়ে সুন্দর করে ঝুলিয়ে হাটে আনা হতো। সেই গুড় আস্তে আস্তে স্থান করে নিল সুপারশপে। আর প্রযুক্তির শনৈঃশনৈঃ উন্নতিতে সেটাই মিলছে এখন অনলাইনে।
অন্যদিকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে খেজুরের গুড় টিউবে ভরে বিক্রির উদ্যোগ শুরু হয় ২০১৫ সালে। বিশ্ববাজার ধরার লক্ষ্যেই এই প্রয়াস।
জীবনের জলছবি
রস সংগ্রহ থেকে গুড় তৈরি তো স্রেফ এক প্রক্রিয়া নয়, বরং জীবনেরই জলছবি। সম্পূর্ণ প্রক্রিয়ায় পুরো পরিবার সম্পৃক্ত থাকলেও অন্ন সংস্থান হয় এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একাধিক পেশার মানুষের। এতে প্রতীয়মান ধৈর্য, যত্ন, পারিপাট্য, পরিমিতিবোধ, সময়জ্ঞান, টানাপোড়েন আর নান্দনিকতা। স্পষ্ট হয়, ব্যক্তিজীবন যেমন, তেমনি পারিবারিক আর সমাজজীবনও। তাই তো সমে এসে ভবা পাগলাকে স্মরণ না করে উপায় কী?
‘হাঁড়ি বাঁধো মন’ গানে ভবাই তো বলেছেন: খেঁজুর গাছে হাঁড়ি বাঁধো মন/ ও গাছে জোয়ার আসিলে/ও গাছ কাটো কুশলে/কোনার দড়ি ছিঁড়ে যেন পড়োনা তলে।