গায়ে বুলেটপ্রুফ লেগগার্ড, অন্যদিকে পেটের ভেতর ছোট্ট প্রাণের অস্তিত্ব। সহকর্মীরা মার খাচ্ছেন। নিজের ও সন্তানের নিরাপত্তা। ওই মুহূর্তে পেশাদারত্বটাকেই বড় মনে হলো। অল্প কয়েকজন ফোর্স নিয়ে সামনে এগোলাম। আগুন, গ্যাসের মধ্য দিয়ে আন্দোলনকারীদের মধ্যখানে গিয়ে শান্ত করানোর চেষ্টা করছিলাম। কে যেন একটা ইট ছুড়ে দেন আমাদের দিকে। সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের মধ্য থেকে কয়েকজন দৌড়ে আমাকে ঘিরে ধরেন। বোধ হয় বুঝতে পারেন আমার অবস্থা। মুহূর্তে শান্ত হয় পরিবেশ। জয় মানবতার, জয় মাতৃত্বের।
এই ঘটনাটি চলতি বছরের এপ্রিল-মে মাসের কথা। খুলনায় তখন পাটকলশ্রমিকদের বকেয়া মজুরি নিয়ে অসন্তোষে হাজার হাজার শ্রমিক রাস্তায়। আমি তখন পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। আমার সকাল ছয়টা থেকে ডিউটি। রমজান মাস। ইফতারের আগ পর্যন্ত রাস্তা বন্ধ করে অনশন। অন্যদিকে ভোরে ভোরে ‘মর্নিং সিকনেস’ কাটিয়ে রাস্তায় বেরোলে কেমন যেন ফিট হয়ে যেতাম। পর্যাপ্ত ডেপ্লয়মেন্ট ছিল, তারপরও বিষয়টি সংবেদনশীল হওয়ায় আমরা রাস্তায়ই থাকতাম। সহকর্মীরা বসতে বললেও অন্যদের রোদে, গরমে দাঁড় করিয়ে নিজে এসি রুমে বসতে কেমন যেন লাগত। আমি বসতাম অনশনস্থলসংলগ্ন পুলিশ বক্সে। একদিন পুলিশ আক্রান্ত হলো। উত্তেজিত ব্যক্তিদের ছোড়া ইটের আঘাতে একজন ইন্সপেক্টরসহ কয়েকজন আহত হলেন। একপর্যায়ে পুলিশ বক্স আক্রান্ত হলে জুনিয়রদের অনেকের নিষেধ অমান্য করে সামনে এগোলাম।
মাতৃত্ব কী বোঝার আগেই আমার প্রথম সন্তান সাম্যর আগমন। একদিকে সন্তান, সংসার, অন্যদিকে পড়ালেখা। তারপর কর্মজীবনে ঢুকে গেলাম। বিসিএসের জন্য পড়াশোনা। প্রথমে শিক্ষকতা দিয়ে হাতেখড়ি, পরে উপজেলা শিক্ষা অফিসার। পরে ৩০তম বিসিএস পুলিশ ক্যাডারে সহকারী পুলিশ সুপার হিসেবে ২০১২ সালে যোগদান করি।
ছোট্ট সাম্যকে রেখে সারদায় দীর্ঘ এক বছরের প্রশিক্ষণ শেষ করি। শুরু হয় পুলিশের কঠিন কর্মজীবন। পরিবারের বিশেষ করে স্বামীর সহযোগিতায় সব চ্যালেঞ্জ পার করছি। সেই ছোট্ট সাম্য এখন ১৪ বছরের কিশোর। অনেকেই কর্মজীবনে প্রবেশের পর সন্তান গ্রহণে দ্বিধান্বিত থাকেন। বিশেষ করে সেসব ক্ষেত্রে যেখানে প্রতিনিয়ত নিজেকে প্রমাণ করে টিকে থাকতে হয়। পুলিশের মতো চ্যালেঞ্জিং পেশায় তো কথাই নেই।
দ্বিতীয় সন্তান ধৃতি মহাশ্বেতা সৌমিলির সূচনা এই বছরের শুরুতে। আমি তখন সরকারি ট্রেনিংয়ে ইতালিতে। ইউরোপের কয়েকটা দেশ ঘোরার সুযোগ হয়েছে। কথা হয়েছে অনেক কর্মজীবী মায়েদের সঙ্গে। তাঁরা মাতৃত্বকে বোঝা মনে করেন না। আমি সাহস পেলাম। গত আগস্টে জন্ম হলো আমার কন্যার। মাত্র দুই মাস বয়স ওর । মাতৃত্বকালীন ছুটির সময়টুকু পুরোটাই ওর। তবে আর কিছুদিনের মধ্যেই কাজে যোগদান করব।
ছুটিতে আসার আগে দিন শেষে ঘরে ফিরে ছেলের পড়াশোনা দেখতাম, ওর স্কুলের বন্ধুদের গল্প শুনতাম। সময় দিতে না পারলেও ছেলের জগতের পুরোটাই আমাকে ঘিরে।
প্রতিনিয়ত কাজ করছি অপরাধ ও অপরাধীদের নিয়ে। কাজ করতে হয় মানুষের মনস্তত্ত্ব নিয়ে। নিজের মানসিক সুস্থতাও নিশ্চিত করা জরুরি।
দেশে মায়েদের শারীরিক, মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি গুরুত্ব কম দেওয়া হয় বলেই অধিকাংশই মাতৃত্বকে বোঝা মনে করেন। তবে ধীরে হলেও পরিবর্তন আসছে। মাতৃত্বকালের শুরু থেকেই সহকর্মীদের সহযোগিতা পেয়েছি। শারীরিক পরিবর্তনগুলোকে সহজভাবে মানিয়ে নিয়ে চেষ্টা করেছি কাজ করতে। মাতৃত্বের কারণে অযথা অজুহাত দেখাইনি। তাই মাতৃত্বকে পেশার পরিপন্থী মনে হয়নি। সরকারের নারীবান্ধব উদ্যোগের ফলে মাতৃত্বকালীন ছুটি ছয় মাস পাচ্ছি। কঠিন পেশার রুক্ষ খোলস ছেড়ে বেরিয়ে মাতৃত্বের কোমল সোঁদা গন্ধে সিক্ত হওয়ার পথ ছিল যথেষ্ট বন্ধুর ও পিচ্ছিল। একটু অসাবধানে পতন অবধারিত, সেটা পেশা ও মাতৃত্ব দুটোর জন্যই প্রযোজ্য।
সোনালী সেন
অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার (উত্তর), খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশ।