কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ লিখেছিলেন ‘...মনে আমার বয়স হয় না/ সংসারী মন পোক্ত হয় না’—তবে ৬৮ বছর বয়সী প্রকৌশলী মোহাম্মদ আবদুল মান্নান সাহেবের মন পোক্ত সংসারী হলেও তাঁর মনের বয়স বাড়ছে না! ওদিকে তাঁর কনিষ্ঠতম পুত্র ২৭ বছরের তাহিনুল মান্নানের মনের বয়স বাড়লেও সংসার শুরু করার বিষয়েই তাঁর প্রবল অনীহা!
এই পিতা-পুত্রই গল্পের প্রধান চরিত্র। সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ পার্শ্বচরিত্র অবশ্য আছে। গল্পটা আসলে এক ছত্রেই বলা সম্ভব—পিতা বীর মুক্তিযোদ্ধা মান্নান (৬৮) ও তাঁর ছেলে দুর্ধর্ষ ভিডিও গেমার তাহিনুল (২৭)—এই বাপ-বেটা একত্রে ২০১৬ সালে ঢাকার সাউথইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে একসঙ্গেই ক্লাস শুরু করে দিলেন। এমবিএ শেষে ২১ মার্চ ২০১৭-তে সমাবর্তন অনুষ্ঠানে, যেখানে সব ছাত্রছাত্রীই গাউন গায়ে আর সঙ্গে ‘সাদা পোশাকের’ অভিভাবক; সেখানে এই বাবা-ছেলে দুজনই কালো গাউন গায়ে চড়িয়ে অডিটরিয়ামে উপস্থিত। পার্শ্বচরিত্র মান্নান সাহেবের বড় পুত্র তানিম আল মিনারুল মান্নান এবং পুত্রবধূ নোযায়রা সুলতানা, তাঁরাও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করলেন একই সময়ে, তবে ভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে। অন্য পার্শ্বচরিত্র হলেন মান্নান সাহেবের স্ত্রী বেগম তাহমিনা মান্নান—এই লেখায় তাঁকেই প্রধান চরিত্র হিসেবে ধরা উচিত, একই সঙ্গে চার ছাত্রছাত্রীর খবরাখবর রাখা কি মুখের কথা? তার ভেতর একজন যদি আবার হন স্বামী, যিনি কিনা আবার ছোট ছেলের ‘ক্লাসমেট’, তাহলে বাচ্চারা ঠিকমতো পড়াশোনা না করলে নালিশটা তিনি কাকে করবেন, বলুন? মা ও স্ত্রী চরিত্রে এমন একজন নারী না থাকলে এই গল্পটার তো জন্মই হতো না!
মূল গল্প এটুকুই। এখানেই ‘সমাপ্ত’ বলা যেতে পারে; কিন্তু এই গল্পের ভেতরে আরও কত গল্পের মাখামাখি, তার কিছুটা না বললে অবিচারই করা হবে।
কিডনির জটিল রোগে আক্রান্ত এবং দেশের বাইরে গিয়ে (বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আগে) একটি কিডনি প্রতিস্থাপন (ট্রান্সপ্ল্যান্ট) করা মোহাম্মদ আবদুল মান্নান সে অবস্থাতেই তাহিনকে নিয়ে ক্লাস চালিয়ে গেছেন দুর্দান্ত মনোবলের জোরেই। কতটা দুর্দান্ত? এর মধ্যে কয়েকবার দীর্ঘ সময় হাসপাতালে কাটাতে হয়েছে, তবু একটা সেমিস্টারও বাদ যায়নি! বিষয় জেনে বিছানাতেই ইউটিউব ঘেঁটে দেখে নিয়েছেন লেকচার। সব বিষয়েই নম্বরে ছিলেন সেরাদের মধ্যে।
এমন কষ্টকর রোগে ভুগেও নিয়মিত ক্লাস আর রাত জেগে পড়াশোনা করার কারণে শরীর বিদ্রোহ করে বসল। হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) কাটল মাসখানেক। হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েই তাহিনকে নিয়ে ছুটলেন ক্লাসে। কিছুদিনের মধ্যেই আবার সরাসরি আইসিইউ! ধরা পড়ল প্যানক্রিয়াসে সিস্ট, যেটার অস্ত্রোপচার খুবই জটিল। কিন্তু একটা পরীক্ষা সামনে। অস্ত্রোপচারের তারিখ পিছিয়ে আইসিইউ থেকে গিয়েই পরীক্ষা দিলেন! মাত্র মাস তিনেকের মাথায় আবার আইসিইউ এবং প্রস্টেট সার্জারি! এবারও হাসপাতাল থেকে বেরিয়েই পিতা-পুত্রের ক্যাম্পাসে গমন!
বীর মুক্তিযোদ্ধা মান্নান, ১৯৭১ সালে মাত্র ২২ বছর বয়সে ময়মনসিংহের ভালুকায় প্রথম সংগঠক হিসেবে থানা থেকে তিনটি ৩০৩ রাইফেল দখল করে মুক্তিযুদ্ধে আগ্রহীদের প্রশিক্ষণ দিতে অবসরপ্রাপ্ত সুবেদার মেজর আফসারকে রাজি করান। উচ্চমাধ্যমিকে পড়ার সময়ই আনন্দ মোহন কলেজ ছাত্র সংসদের সদস্য ছিলেন তিনি। তারপর সরাসরি সম্মুখসমর। বীরত্বের কারণে এখনো ভালুকায় অনেকেই তাঁকে চোখে না দেখলও ‘দুর্ধর্ষ মুক্তিযোদ্ধা মান্নান’কে চেনেন নামে ও গল্পে।
তাঁর এমবিএও যেন ‘অস্ত্র জমা দিছি, ট্রেনিং জমা দেই নাই’-এর মতোই। জেদ ধরে চিকিৎসক, পরিবার, বিশ্ববিদ্যালয়—সব উপেক্ষা করে তাঁর কথা একটাই—‘এত কষ্ট করে পড়াশোনা করলাম, পরীক্ষা দিয়েই তারপর অপারেশন থিয়েটারে ঢুকব, যদি আল্লাহ তাআলা হায়াত না রাখেন, তবে ডিগ্রিটা ছাড়া মরেও তো শান্তি পাব না!’
অবশেষে ডিগ্রি নিয়েই এই বাবার শরীর ও মন এখন ভালোই আছে। তাঁর সহপাঠীও ভিডিও গেম খেলার ফাঁকে একটি টেক্সটাইল ফার্মের এইচআর ও কমপ্লায়েন্স কর্মকর্তা। তাহিনুল মান্নানকে সাধুবাদ, যে প্রজন্মের ছেলেরা পরিবারকে সময়ই দেয় না আবার অভিভাবকেরও সময় নেই সন্তানের জন্য, সেই যুগে বাবার সঙ্গে এমবিএ ডিগ্রি কোর্স শুরু করা এবং একত্রে ক্লাস করতে নিশ্চয়ই অনেকেরই কুঁচকে ওঠা ভ্রুর শিকার হয়েছেন, কিন্তু তাঁকে বিব্রত বা সামান্য অস্বস্তিতে ফেলতে পারেনি কিছুই।
প্রকৌশলী মো. আবদুল মান্নান রাজশাহী ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে ১৯৭৪ সালে পুরকৌশলে প্রথম স্থান অর্জন করেন। পাশাপাশি ছিলেন তৎকালীন ছাত্রলীগের নির্বাচিত সহসভাপতি। এরপর সরকারি চাকরি। নিজের পরিবার ও আত্মীয়দেরও ভার নিয়ে বেশি উপার্জনের উদ্দেশে বিদেশ যান। দারুণ সফলতার সঙ্গে শীর্ষ পরামর্শক হিসেবে কাজ করেন নানা প্রকল্পে। সৌদি আরবের মক্কায় পাহাড়ের মধ্য দিয়ে তৈরি সুড়ঙ্গপথগুলোর ডিজাইনার দলে তিনি ছিলেন একজন বিশেষজ্ঞ সদস্য। তানজানিয়ায় দলনেতা হিসেবে কাজ করার সময় কিডনিজনিত অসুস্থতার মাত্রা বেড়ে গেলে অবসর নিতে বাধ্য হন তিনি।
বড় ছেলে তানিম আল মিনারুল মান্নান বাংলাদেশ, সিঙ্গাপুর ও অস্ট্রেলিয়ার নানা আন্তর্জাতিক সংস্থায় উচ্চপদে কাজ করেছেন। পরিবার চালনায় অংশীদার হয়েছেন ভালোভাবেই। কাজপাগল আবদুল মান্নানের প্রচুর কাজের হাতছানি থাকলেও অসুস্থতার জন্যই আটকে ছিলেন। কিছু একটা করতে হবে, তাই ছোট ছেলে তাহিনের উৎসাহে ভর্তি হলেন এমবিএতে। পুত্রবধূ নোযায়রা সুলতানাও দিলেন উৎসাহ। ওদিকে স্ত্রী তাহমিনা সংসার পরিচালনার ভার একা নিয়ে পড়াশোনায় ব্যস্ত সবার মাথার ওপর ছায়া হয়ে রইলেন।
এবার আসলেই গল্প শেষ। আর এই সত্য কাহিনিকে বারবার ‘গল্প’ বলার কারণ একটাই—এই একলা চলোর যুগে একটি পরিবারের ভেতর এমন অদ্ভুত সুন্দর পারস্পরিক সহযোগিতার উদাহরণ তো বাস্তব নয়, গল্পের মতোই!