>শুধু অভিনয়ের জন্য নয়, বক্তা হিসেবেও বেশ জনপ্রিয় ভারতীয় অভিনেতা আর মাধবন। জিতেছেন একাধিক ফিল্মফেয়ার পুরস্কার, তামিলনাড়ু স্টেট ফিল্ম অ্যাওয়ার্ড। থ্রি ইডিয়টস, রং দে বাসন্তি, গুরু, তনু ওয়েডস মনুর মতো ব্যবসাসফল ও প্রশংসিত সিনেমা আছে তাঁর ঝুলিতে। তবে অভিনয়জীবনের শুরুতে সাফল্যের দেখা তিনি পাননি। অনেক বাধা পেরোতে হয়েছে। শুধু খাদ্যাভ্যাস বদলে আর মাধবন পেয়েছেন সুস্থতা ও পেশাগত সাফল্য। ভারতের মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী, চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যসংক্রান্ত পেশাজীবীদের একটি সম্মেলনে নিজের অভিজ্ঞতা তিনি তুলে ধরেছেন এক বক্তৃতায়।
অভিনয়ে নাম লেখানোর সঙ্গে সঙ্গে খ্যাতি আমাকে পেয়ে বসেছিল। লোকে যখন ‘স্টার’ বলত, কী যে ভালো লাগত! কম বয়সে অপ্রত্যাশিত খ্যাতি পেয়ে গেলে অল্পতেই জীবনে আত্মতৃপ্তি চলে আসে। আমার বেলাতেও তাই হয়। শুরুর ৭-৮ বছরে যে ছবির প্রস্তাবই আসত, করে ফেলতাম। বছরে তিনটা করে সিনেমায় অভিনয় করতাম, যেগুলোর মধ্যে বেশির ভাগই ছিল বিস্বাদ আর একঘেয়ে গল্পের। ধীরে ধীরে আমার ওজন বাড়তে লাগল, অবচেতনভাবেই মানসিক ও শারীরিকভাবে অস্বাস্থ্যকর জীবন যাপন করতে শুরু করলাম।
৩০ সেকেন্ড পদ্ধতি
আমরা বর্তমান যুগে ‘৩০ সেকেন্ড পদ্ধতিতে’ বসবাস করছি। পারিপার্শ্বিক চাপের কারণে আমরা কখনোই কোনো কাজে নিজেকে পুরোপুরি সঁপে দিতে পারি না। প্রতিদিন ঘুম ভেঙে দাঁত মাজতে গিয়ে আমরা ভাবি, ‘এরপর কি নাশতা করব? নাকি নাশতা অফিসে গিয়ে করব?’ গোসল করতে গিয়ে ভাবি, ‘আজকে কোন পোশাক পরে বেরোব? কোন রাস্তায় গেলে যানজট কম হবে?’ এরপর যখন রাস্তায় গাড়ি নিয়ে বের হই, তখনো দেখা যায় ৩০ সেকেন্ডের জন্য অন্য কিছু নিয়ে ভাবছি। এর মানে হলো, আমরা কখনো যে মুহূর্তে যে কাজটা করছি, তাতে নিজেদের পুরো মনোযোগটা দিই না। যা করছি তা মন দিয়ে কখনোই করি না। আমাদের মধ্যে কতজন শেষ কবে গোসলের সময়টা উপভোগ করেছে? উপভোগ বলতে আমি বোঝাচ্ছি, শরীরের প্রতিটা অংশের দিকে আপনি শেষ কবে মন দিয়ে তাকিয়েছেন, পরিষ্কার করেছেন, উপলব্ধি করেছেন পুরো প্রক্রিয়াটি? আমি একটা সময় গিয়ে বুঝতে পারলাম, এই ‘৩০ সেকেন্ড পদ্ধতি’ জীবনে খুব নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। আমি দেখলাম, আমি ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে ভাবছি, শট শেষ করে কী করব। শট শেষ করে বিশ্রাম নিতে গিয়ে ভাবছি, শুটিংয়ের পর কী করব। এতে করে না আমি আমার কাজে পুরোপুরি মনোযোগ দিচ্ছিলাম, আর না বিশ্রামে।
সুস্থতার খোঁজ
যখন বুঝতে পারলাম, আমি একটা অস্বাস্থ্যকর জীবন যাপন করছি, তখন ঠিক করলাম আমি সুস্বাস্থ্য পেতে চিকিৎসকের পরামর্শ নেব। তবে এর ফাঁকে আর সবার মতো আমিও ইন্টারনেট ঘেঁটে রীতিমতো স্বাস্থ্যকর ও অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপন সম্পর্ক গবেষণা করে ফেলি। পরে চিকিৎসকের কাছে গেলে তিনি আমার সমস্যাগুলো শুনে, পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে আমাকে বেশ কিছু ওষুধ দেন। ওটা ছিল সব সমস্যার দ্রুততর সমাধান। কিন্তু আদতে স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনের জন্য আমি ওষুধনির্ভর হতে চাইছিলাম না। খুঁজছিলাম আরও টেকসই কোনো উপায়।
আমার বাবা-দাদাকে দেখে জেনেছি, বর্তমান যুগের সবচেয়ে বড় অভিশাপ হলো সমাজ ও পরিবারের কাছে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাওয়া। ‘ও তো বুড়ো হয়ে গেছে। ও কী বুঝবে!’—এমন কথা শোনার ভয় সবারই থাকে, তাই প্রতিনিয়ত মানুষ সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রাসঙ্গিক থাকার জন্য যুদ্ধ করে। অনেকে প্রাসঙ্গিক থাকার যুদ্ধ করতে গিয়ে তাড়াহুড়া করে, একসময় ক্লান্ত হয়ে যায়। তখন সে তার বার্ধক্যে গিয়ে সেই সময়টা আর উপভোগ করতে পারে না, হাল ছেড়ে দেয়। আমি আমার মা-বাবাকে দেখেছি, আত্মীয়দের দেখেছি—বার্ধক্যে গিয়ে তাঁরা জীবনে নতুন কিছুর অপেক্ষা করে না। তাঁরা শুধু পরিণতির অপেক্ষায় থাকে। তাঁরা শারীরিকভাবে থাকে ঠিকই, কিন্তু মানসিকভাবে জীবনকে উপভোগ করা ছেড়ে দেয়। কিন্তু আমি এমনভাবে নিজের বার্ধক্যে বাঁচতে চাই না। তাই আমি জীবনের প্রতিটা পর্যায় উপভোগ করার টেকসই পথ খুঁজতে থাকলাম। পেলামও।
স্বাস্থ্যকর জীবনচর্চা
আমি অস্ট্রিয়ার একটি জায়গার খোঁজ পাই। সেটা ছিল প্রায় ১৫০ বছর পুরোনো একটা ওয়েলনেস ইনস্টিটিউট। অনেক পয়সা খরচ করে সেখানে যাই। যা শিখে আসি, তা অমূল্য।
জায়গাটা ভীষণ সুন্দর। লেকের পাশে। বিশাল বড়। কোনো এক রোববারে সেখানে গিয়ে কথা বললাম। ওরা জানাল, পরদিন থেকেই শুরু হবে আমরা স্বাস্থ্যকর জীবনচর্চা শুরুর প্রক্রিয়া। কথামতো, আমি পরদিন সকালে সেখানে গেলাম। পরিচিত হলাম সেখানকার চিকিৎসকের সঙ্গে। তিনি আমাকে বুঝিয়ে দিলেন, সুস্থ জীবনচর্চার এই ১০ থেকে ১৫ দিনের কর্মশালায় আমি কী কী করব। শুরুতেই তাঁদের কাছে জানতে চাইলাম, সকালের নাশতার কী ব্যবস্থা? তিনি আমাকে একটা প্লেট দেখিয়ে বললেন, ‘এটাই আপনার আগামী তিন দিনের খাবার।’ ওই প্লেটে ছিল একদম পাতলা, শুকনো চার টুকরো রুটি। আর এক বাটি তরল, হলুদরঙা সবজির রস। বললাম, ‘আমাকে আমার পাসপোর্ট ফেরত দিন, আমি দেশে ফিরে যাব। আমার দ্বারা এসব সম্ভব না।’ শুনে চিকিৎসক আমাকে থামিয়ে আশ্বস্ত করলেন। জানতে চাইলেন, আমি কী খেতে চাই। সন্দেহের চোখে তাঁর দিকে তাকিয়ে ভয়ে ভয়ে বললাম, ‘আমি কি ডিমের সাদা অংশ দিয়ে বানানো অমলেট খেতে পারি? সঙ্গে একটু ওটস।’ ডাক্তার আমাকে প্যানকেক নেওয়ারও পরামর্শ দিলেন। আমি বললাম, কেন নয়!
তারপর তিনি আমাকে একটা বিশাল ডাইনিং রুমে নিয়ে গেলেন। লেকের দিকে মুখ করে বসানো কতগুলো ছোট ছোট টেবিল। সেখানে আসা প্রত্যেকের জন্য আলাদা টেবিলে তাঁদের পছন্দের নাশতা সাজানো। আমার টেবিলেও আমার পছন্দের অমলেট, ওটস আর প্যানকেক ছিল। তখন সকাল আটটা। আমাদের বলে দেওয়া হয়েছিল, এই কর্মশালায় কোনো ফোন, পত্রিকা, টেলিভিশন, ট্যাব—কিছু সঙ্গে রাখা যাবে না। ওরা যা বলে, আমাকে তা-ই শুনতে হবে, করতে হবে। আর এটাই নাকি আমার জীবনে বদল আনবে। সবাইকে বলা হয়েছিল, যে যার ইচ্ছেমতো যা খুশি তা–ই খেতে পারবে। শর্ত শুধু একটা। সেই যে চারটা শুকনো রুটি আর এক বাটি স্যুপ—ওটা সবার আগে খেতে হবে। তবে কর্মশালার প্রশিক্ষকেরা যে নিয়মে খেতে বলবেন ঠিক সেভাবে। তো কী সেই নিয়ম? তাঁরা বললেন, ‘আমাদের এখানে আমরা একটা নীতি মেনে চলি। সেটা হলো খাবার পান করো আর পানি চিবিয়ে খাও।’ এটার মানে হলো, এই যে চার টুকরো রুটি, এগুলোকে একটু একটু করে মুখে নিতে হবে। এরপর ভালো করে চিবুতে হবে, যতক্ষণ না পর্যন্ত খাবারটা মুখের ভেতর একদম তরল হয়ে যায়। যখন রুটি মুখের ভেতর পানির মতো তরল হয়ে যাবে, তখন গিলতে পারবেন। অন্যদিকে স্যুপ মুখে নিয়েই গিলে ফেলা যাবে না। কিছুক্ষণ ভেতরে রাখতে হবে। দাঁত দিয়ে চিবানোর চেষ্টা করতে হবে, মুখের ভেতরের প্রতিটি জায়গায় যেন তা পৌঁছে, সেদিক নজর দিতে হবে। আমি তো খুশি। ভেবেছিলাম, এটা তো কোনো ব্যাপারই না
১৪ মিনিট পর...
মজার মজার নাশতা করব ভেবে শুরুতে এক টুকরা রুটি মুখে নিয়ে চিবুতে শুরু করলাম। মুখে নিতেই দারুণ এক স্বাদ পেলাম। ১৪ মিনিট চিবানোর পর দেখলাম, আমি কিছুতেই সেটা শেষ করতে পারছি না। ওই এক টুকরো রুটি মুখে নিয়ে চিবুতে গিয়েই পেট ভরে গেছে। কর্মশালায় অংশ নেওয়া আমরা সবাই একে অপরের মুখের দিকে তাকাচ্ছিলাম আর হাসছিলাম। তখন প্রশিক্ষক ও চিকিৎসকেরা আমাদের পুরো বিষয়টি বুঝিয়ে বললেন। জানালেন, আমাদের মস্তিষ্ক ১৪ থেকে ১৫ মিনিটের বেশি চিবুতে পারে না। আমরা যতই ক্ষুধার্ত থাকি না কেন, খাবারের মেনুতে যা কিছুই থাকুক না কেন, পরিমাণ যেটাই হোক—কোনো খাবারই ১৪/১৫ মিনিটের বেশি সময় ধরে আমরা চিবুতে পারব না। ১৪ মিনিট ধরে চিবুতে থাকলে আমাদের মগজ শরীরকে সংকেত পাঠাবে যে আমাদের খাবার হয়ে গেছে, এবার থামো। ব্যাপারটা আমার কাছে দারুণ লাগল। এরপর শুরু হলো এ ধরনের একের পর এক ক্লাস। যেখান থেকে আমরা বুঝতে পারলাম, মগজ আর শরীরের সম্পর্ক আমাদের জীবনকে কীভাবে প্রভাবিত করে।
খাদ্যাভ্যাসেই আসবে সাফল্য
আমাদের শরীর আর মগজ আমাদের ধারণার চেয়েও অনেক বেশি কার্যক্ষম। আমাদের মস্তিষ্ক জানে, আমরা যা খাচ্ছি সেসব খাবারের কোনোটাই মৌলিক নয়। সবই কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন, মিনারেলের মতো একাধিক উপাদানের সমষ্টি। আমাদের মস্তিষ্ক চাইলেই সেই খাবার থেকে শরীরের জন্য উপযুক্ত উপাদানটি গ্রহণ করতে পারে। এর থেকে আমি শিখেছি, আমরা ঠিক তেমনভাবেই বেড়ে উঠি, যা আমরা খাই, যা গ্রহণ করি। আমাদের আবেগ, সাফল্য, সুখ, শান্তি, বিষাদ—সবই আমাদের খাবারের সঙ্গে সম্পৃক্ত। আমরা কীভাবে খাচ্ছি, কত সময় নিয়ে খাচ্ছি, কী খাচ্ছি—এসবের ওপর নির্ভর করে আমাদের পেশাগত সাফল্যও। আমি যতই এসব জানতে শুরু করলাম, ততই অবাক হচ্ছিলাম। যদি আমার জনপ্রিয়তা, আমার সাফল্য খাবারের ওপরই নির্ভরশীল, তাহলে তো আমি আজীবন ওই খাবারই খাব; যেটা খেলে আমার অভিনয় ভালো হবে, সিনেমা হিট হবে। পরে ধীরে ধীরে আমাকে বোঝানো হয়, শুধু খাবারের উপাদান নয়। খাদ্য গ্রহণের পুরো প্রক্রিয়ার ওপর নির্ভর করে আমাদের সুস্থতা, আমাদের সাফল্য। আমাদের জীবন এতটাই দুশ্চিন্তা ও ব্যস্ততায় ঠাসা, খাবারের সময়ও ফোন কিংবা পারিবারিক আলোচনার মধ্যে থাকি। যেখানে খাবারের সময় পুরো মনোযোগ একদিকে দিতে হয়। শরীর ও মস্তিষ্ককে এক হয়ে কাজ করার সুযোগ দিতে হয়। কারণ, চীনা শাস্ত্র বলে, পাকস্থলী হচ্ছে দেহের দ্বিতীয় মস্তিষ্ক। পৃথিবীর সব বড় বড় মনীষী—আলেক্সান্ডার থেকে মহাত্মা গান্ধী—খাবার সবার জীবনেই সচেতন ও অবচেতনভাবে গুরুত্ব রেখেছে।
অনুষ্ঠানের ভিডিও থেকে অনুবাদ আদর রহমান