শহীদ আলতাফ মাহমুদের ছায়াসঙ্গী ছিলেন তিনি। ষাটের দশকে তরুণ প্রতিভাবান যন্ত্রশিল্পী হিসেবে খ্যাতি পেয়েছিলেন সংগীতাঙ্গনে। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় ঢাকায় গেরিলাদের সহযোগিতা করার পাশাপাশি নিজেও অংশ নিয়েছেন কয়েকটি অভিযানে। পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে আটক হওয়ার পর ক্র্যাক প্লাটুনের অন্য অনেক সদস্যের মতো তাঁরও খোঁজ আর মেলেনি। সৈয়দ হাফিজুর রহমানকে নিয়েই এই প্রতিবেদন।
সৈয়দ হাফিজুর রহমানের কথা বলতে বলতেই ক্র্যাক প্লাটুন সদস্য লিনু বিল্লাহর মুখের অভিব্যক্তি বদলে গেল। যেন সদা তাড়িয়ে বেড়ানো কোনো ভীতি ভর করল তাঁর মধ্যে। চোখমুখে তা স্পষ্ট। লিনু বিল্লাহ বলতে থাকেন, ‘১৯৭১ সালের ৩০ আগস্ট রাতে আমরা ধরা পড়ি। এর পর পাকিস্তানি বাহিনী নাখালপাড়ায় পুরোনো এমপি হোস্টেলে নিয়ে যায়। সেখানে সবাইকে অমানবিক নির্যাতন করছিল। পাশের ঘর থেকে আর্তচিৎকার শোনা গেল—“আমাকে গুলি করো, মেরে ফেল।” কণ্ঠটা পরিচিত। কিন্তু নিশ্চিত হতে পারছিলাম না, কে তিনি। আচমকা দরজাটা একটু ফাঁকা হলে দেখি হাফিজ ভাই। তাঁর চোখ দুটো উপড়ে ফেলেছে পাকিস্তানি হায়েনারা।’
দুঃসহ সেই স্মৃতিচারণা করতে করতেই লিনু বিল্লাহর চোখ জোড়া ছলছল করে ওঠে। তখনো বলে যান, ‘হাফিজ ভাই ছিলেন সে সময়ের প্রতিভাবান যন্ত্রশিল্পী। সুন্দর গিটার বাজাতেন। শুধু গিটার বলছি কেন, প্রায় সব বাদ্যযন্ত্রই তাঁর হাতে প্রাণ পেত। সেই সময়টায় শহীদ আলতাফ মাহমুদের সব গানে সংগত করতেন।’
একজন অল্প পরিচিত শহীদ মুক্তিযোদ্ধা সম্পর্কে বলবেন, ফোনালাপে এটুকুই জানিয়েছিলেন লিনু বিল্লাহ। সেই শহীদ যোদ্ধার কাহিনি শুনতেই গত ২৪ নভেম্বর গিয়েছিলাম মুক্তিযোদ্ধা ও ক্র্যাক প্লাটুনের সদস্য লিনু বিল্লাহর বাড়িতে। রাজধানীর নয়াপল্টনের বাড়িতে বসেই শুনছিলাম হাফিজুর রহমানের গল্প।
১৯৭১ সালে ২৫ মার্চ কালরাতে ঢাকাতেই ছিলেন শহীদ হাফিজ। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নির্মম হত্যাযজ্ঞ ভীষণভাবে স্পর্শ করেছিল তাঁকে। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে পাকিস্তানি বাহিনী যশোরে তাঁদের বাড়ি পুড়িয়ে দেয়, হত্যা করে হাফিজুর রহমানের বাবাকে। হত্যার খবর হাফিজের মনোজগৎকে আরও বেশি ওলট–পালট করে দেয়। সংকল্পবদ্ধ করে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে।
তখন তাঁর অস্ত্র বলতে গিটার-সেতার-তবলা। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের গানের জন্য হানাদার বাহিনী আর দোসর রাজাকার-আলবদরদের চোখ এড়িয়ে আলতাফ মাহমুদের সঙ্গে গাড়ি নিয়ে শহর ঘুরে ঘুরে গাইয়েদের জোগাড় করে আনতেন। গানের রেকর্ডিং আর মহড়া হতো একই দিনে। কোনো দিন বেঙ্গল স্টুডিওতে, কখনো–বা ফিল্ম ডেভেলপমেন্ট করপোরেশনের (এফডিসি) স্টুডিওতে। তা পাঠিয়ে দেওয়া হতো সীমান্তের ওপারে। আলতাফ মাহমুদের বাড়িতে যাতায়াত ছিল শহুরে গেরিলাদের। যাঁদের অনেকেই ছিলেন হাফিজের পূর্বপরিচিত। কেউ কেউ তাঁকে ডাকতেন, ‘হাফিজ ভাই’। একসময় নিজেও যুক্ত হন গেরিলাদের সঙ্গে।
বাবার সহযোগী সম্পর্কে এসব কথাই ফেসবুকে নিজের প্রোফাইলে লিখেছেন শহীদ আলতাফ মাহমুদের মেয়ে শাওন মাহমুদ।
বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ দলিলপত্রের নবম খণ্ডে শহীদ হাফিজ সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায়। ক্র্যাক প্লাটুনের সদস্যদের বয়ানেই উঠে এসেছে তাঁর ভূমিকার কথা। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনী বিশ্ববাসীকে বার্তা দিতে চেয়েছিল, দেশে স্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করছে। তাদের এই দাবি চূর্ণ করার উদ্দেশ্যেই ঢাকা শহরে গেরিলা অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত হয়। মুক্তিযুদ্ধের ২ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার খালেদ মোশাররফের ভাষায় অভিযানগুলোর নাম ছিল ‘সিটি টেররাইজিং অপারেশনস’। এমন কয়েকটি অভিযানে সরাসরি অংশ নেন হাফিজুর রহমান।
আবদুস সামাদ বীর প্রতীক এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘মুক্তিবাহিনীর সুদীপ্ত অস্তিত্ব ঘোষণার জন্য আমরা মোহাম্মদপুরের অবাঙালি অধ্যুষিত এলাকা থেকেই প্রথম যাত্রা শুরু করি। বিশ্বস্ত বাহন আমার টয়োটা করোলা। দলে হাফিজ ভাই, উলফত, গাজী, বাপী ও আমি। আগস্টের দিকে ঘটনা।’
তাঁদের প্রথম অভিযান ছিল আসাদ গেটে (সে সময়ের আইয়ুব গেট)। পেট্রল নেওয়ার ছলে নিজেদের গাড়ি থামান পেট্রলপাম্পে। মাইন পুঁতে রাখেন সেখানে। আর তাতেই মিরপুরের দিক থেকে আসা পাকিস্তানি বাহিনীর একটি কনভয়ে বিস্ফোরণ ঘটে।
সে হামলার পরই তাঁরা চলে যান এখনকার দোয়েল চত্বরের কাছে। সেখানে মাইনের শিকার হয় অবাঙালি যাত্রীবাহী ডবল ডেকার বাস। পরদিন নর্থ-সাউথ রোড, গ্যানিজ ও ভোগ ফ্যাশন বিপণিকেন্দ্র অপারেশন, গ্রিন রোডের মোড়ে পেট্রলপাম্প অপারেশনসহ ঢাকায় বেশ কয়েকটি স্থানে হামলা করে দলটি। তাদের সঙ্গে যুক্ত হন ক্র্যাক প্লাটুনের অন্য সদস্যরাও। এর মধ্যে গ্রিন রোডের অভিযানে মাইন পাতার কাজটি করেন হাফিজুর রহমান। সায়েন্স ল্যাবরেটরির রাস্তায় শহীদ হাফিজের বসানো এম-কে ১৬ মাইনের তোড়ে সেদিন খানসেনাদের একটি সামরিক যান উড়ে গিয়েছিল।
এমন আরও কয়েকটি দুঃসাহসিক অভিযানের সঙ্গে উচ্চারিত হয় হাফিজুর রহমানের নাম। তার একটি রামপুরার উলন বিদ্যুৎ সরবরাহ উপকেন্দ্র অভিযান। বীর প্রতীক গোলাম দস্তগীর গাজীর নেতৃত্বে আরও কয়েকজনের সঙ্গে সে অভিযানে অংশ নেন সৈয়দ হাফিজুর রহমান। বীর প্রতীক হাবিবুল আলমের লেখা ব্রেভ অব হার্ট বইয়ে তার বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে।
শহীদ হাফিজের গল্প বলতে বলতেই সেদিন পাকিস্তানি সেনাদের হাত থেকে কীভাবে বেঁচে ফিরেছিলেন সে কথাও শোনান লিনু বিল্লাহ। আলাপের এক ফাঁকে দেন শহীদ হাফিজুর রহমানের বোনের খোঁজ।
সেই সূত্র ধরেই রাজধানীর মিরপুরের মধ্য পাইকপাড়া এলাকায় হাফিজুর রহমানের ছোট বোন সৈয়দা আনোয়ারা খাতুনের বাসায় যাওয়া। তাঁর সেেজা ভাইয়ের খোঁজ করতে কেউ আসছেন জেনে আপ্লুত হয়ে ওঠেন। পরম যত্নে আগলে রাখা শহীদ হাফিজের ছবিগুলো সামনে মেলে ধরে ফিরে যান তাঁর ছোটবেলায়। ভাইয়ের স্মৃতি বলতে এই ছবিগুলোই তাঁর সম্বল। তাঁর কাছে শুনি শহীদ হাফিজের জীবনগল্প।
১৯৩৮ সালের ২৮ নভেম্বর খুলনা শহরে নানার বাড়িতে হাফিজুর রহমানের জন্ম। বেড়ে ওঠা যশোরের পোস্ট অফিসপাড়ায় নিজেদের বাড়িতে। বাবা সৈয়দ আবদুর রহমান ও মা মোস্তারিয়া খাতুনের ১১ ছেলেমেয়ের মধ্যে তৃতীয় হাফিজুর রহমান। যশোর জিলা স্কুল এবং এম এম কলেজে পড়াশোনা করেছেন। শুরুতে সেতার বাজাতেন। এরপর তবলা, হারমোনিয়াম, বেহালা, গিটার, বাঁশি—সবকিছুর ওপরই তাঁর দখল ছিল ঈর্ষণীয়।
কলেজের গণ্ডি পেরোনোর পর গান–বাজনাকেই জীবনের ব্রত হিসেবে নেন। তখন যশোর-খুলনা অঞ্চলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করে বেড়াতেন। একসময় খুলনায় ললিতকলা নামে গানের স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। সেখান থেকে ১৯৬২ সালে চলে যান তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের করাচিতে। সেখানে সাহচর্য পান প্রখ্যাত সংগীত পরিচালক দেবু ভট্টাচার্যের। করাচিতেই পরিচয় আলতাফ মাহমুদের সঙ্গে। শহীদ আলতাফ মাহমুদের অনুরোধে ঢাকায় ফিরে আসেন ১৯৬৭ সালের দিকে। গড়ে তোলেন ঊর্মী প্রোডাকশন। রেডিও, টিভি, চলচ্চিত্রসহ সংগীত আয়োজনে হাফিজুর রহমানের উপস্থিতি থাকত।
ভাই হাফিজুর রহমান সম্পর্কে বলে যান সৈয়দা আনোয়ারা খাতুন, ‘এত প্রতিভাবান হয়েও করাচিতে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের শিকার হয়েছিলেন। পাকিস্তানিদের প্রতি তাঁর বিদ্বেষটা তখনই জন্মে।’ বাঙালির সম্মিলিত সেই বিদ্বেষের পরিণতিতে জন্ম হয় স্বাধীন বাংলাদেশের। কিন্তু স্বাধীন দেশে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি মেলেনি শহীদ হাফিজের। শহীদ হাফিজুর রহমানের ভাইবোনদের মধ্যে সৈয়দা আনোয়ারা খাতুন ও বেলজিয়ামপ্রবাসী ছোট ভাই সৈয়দ মোসাদ্দেকুর রহমান বেঁচে আছেন। স্বজনেরা চান শহীদের স্বীকৃতি। আনোয়ারা খাতুন বলেন, ‘আমাদের তো পাওয়ার কিছু নেই। তাঁর স্ত্রী-সন্তানও নেই, যারা সুবিধা নিতে চাইবে। আমরা রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতিটুকু চাই নতুন প্রজন্মের কাছে তাঁর বীরত্বগাথা শোনানোর জন্য।’