এশিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিলের হয়ে চীনে ক্রিকেট শেখাতে গিয়েছিলেন আমিনুল ইসলাম বুলবুল। ছেলেমেয়েদের ক্রিকেট শেখাতে গিয়ে নিজের নাম হয়ে গেছে আমিন সিয়েন সাং। চীনের ক্রিকেট ও তাঁর অভিজ্ঞতার নানা গল্প তিনি বলেছেন ‘অন্য আলো’কে।
খ্রিষ্টীয় সপ্তম শতকে সিল্ক রোড ধরে ১৭ বছরের স্থলযাত্রায় এক চৈনিক পরিব্রাজক এসেছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশে। মূলত বিখ্যাত নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে বৌদ্ধ দর্শন আত্মস্থ করতে। পরে অধুনা বাংলাদেশে এসেও পরিচিত হয়েছেন বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে। জুয়াং জ্যাং নামে এসেছিলেন, ফিরে যান হিউয়েন সাং নামে।
একবিংশ শতাব্দীতে চীন যখন সারা বিশ্বে রাজনীতি, অর্থনীতি, জ্ঞান-বিজ্ঞান, খেলাধুলায় এক পরাশক্তি; সে দেশে ক্রিকেট শেখাতে গেলেন একজন বাংলাদেশি। তাঁর নাম আমিনুল ইসলাম। আমিনুলের ডাকনাম বুলবুল। সংক্ষিপ্ত ও সহজে উচ্চারণযোগ্য হওয়ায় ডাকনামটা বেশি গ্রহণযোগ্য দেশে দেশে। কিন্তু চীনাদের কাছে ‘আমিনুল’, ‘ইসলাম’ ও ‘বুলবুল’ তিনটি নামই জটিল মনে হলো। চীনা মুলুকে তিনি পরিচিত হলেন আমিন সিয়েন সাং। জুয়ান জ্যাং নামটি সংস্কৃত ভাষার সৌজন্যে হয়েছিল হিউয়েন সাং। আমিনুলের সঙ্গে সিয়েন সাং জুড়ে গেছে চীনা রীতিতে। চীনা ভাষায় সিয়েন সাং অর্থ সাহেব। চীনের যেখানেই ক্রিকেট শেখাতে গেছেন আমিনুল, পরিচিত হয়েছেন আমিন সিয়েন সাং নামে।
হঠাৎ কেন চীনে ক্রিকেট বিস্তারের আগ্রহ জন্মাল আমিনুলের মনে? আসলে এটি জেগেছিল আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিল (আইসিসি) এবং এশিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিলের (এসিসি) মনে। ক্রিকেট এই উপমহাদেশে প্রায় ধর্মের পর্যায়ে উঠলেও সারা বিশ্বে তো তা নয়। হাতে গোনা কয়েকটি মাত্র দেশ ক্রিকেট খেলে, শীর্ষপর্যায়ে মাত্র ১০টি দেশ। খেলাটিকে বিশ্বজনীন রূপ দেওয়ার চিন্তা আইসিসির মাথায় আসে নব্বইয়ের দশকে। তাদের কাজে নেমে পড়াটা তারও পরে। বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশটিতে যদি ক্রিকেট না-ই ছড়িয়ে দেওয়া গেল, তাহলে কিসের বিশ্বজনীন খেলা? এসিসির সহায়তায় আইসিসির চীন প্রকল্প গ্রহণ ২০০৫ সালে।
আমিনুল হঠাৎ করেই যুক্ত হয়ে যান এই প্রকল্পে। ১৩টি টেস্ট খেলেছেন, সঙ্গে ৩৯টি এক দিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচ। বিশ্বকাপে বাংলাদেশের অভিষেকে (১৯৯৯) অধিনায়ক হিসেবে দলকে জিতিয়েছেন পাকিস্তানের বিপক্ষে। অভিষেক টেস্টেই সেঞ্চুরি করে নাম লিখিয়েছেন রেকর্ডবুকে। ৩৩ বছর বয়সে অবসর নেওয়ার পর বাংলাদেশের টেস্ট-পূর্ব যুগের এই নায়ক দেশকে কিছু ফিরিয়ে দিতেই যুক্ত হন কোচিংয়ে। কোচিংয়ে তাঁর দীক্ষা অস্ট্রেলিয়া থেকে। কোচিং ক্যারিয়ারের শুরু অফিস ক্রিকেট লিগে একমি ল্যাবরেটরিজ দলকে দিয়ে। পরে দায়িত্ব নেন আবাহনীর। আবাহনীকে টানা দুই মৌসুম চ্যাম্পিয়ন করে মনে মনে অপেক্ষা করছিলেন জাতীয় দলে কাজ করার সুযোগ পাওয়ার। এমন সময় (২০০৬ সালে) বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সাবেক সাধারণ সম্পাদক, এসিসির বর্তমান প্রধান নির্বাহী সৈয়দ আশরাফুল হক একদিন ঢাকায় এসে ধরলেন আমিনুলকে, ‘বুলবুল, যদি চীনা ভাষাটা শিখতে পারো, তাহলে তোমার জন্য ভালো একটা চাকরি অপেক্ষা করছে!’ দুইয়ে দুইয়ে চার হলো। আমিনুল নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিন মাসের একটা কোর্স করলেন চীনা ভাষার ওপর। এসিসিতে চাকরি পেলেন আমিনুল। ক্রিকেট উন্নয়ন কর্মকর্তা। ক্রিকেট শেখাতে হবে চীনে গিয়ে। চ্যালেঞ্জিং চাকরিটা নিয়ে আমিনুল শুরু করলেন এক রোমাঞ্চকর ভ্রমণ।
২০০৭ থেকে ২০১১ পর্যন্ত চীনে ঘোরাঘুরি থামিয়ে এখন এসিসির সদর দপ্তর কুয়ালালামপুরে বসেই প্রকল্পের তত্ত্বাবধান করেন। চীনে সরাসরি উন্নয়ন প্রশিক্ষকের দায়িত্ব সঁপে দিয়েছেন বাংলাদেশেরই আরেক টেস্ট ক্রিকেটার মঞ্জুরুল ইসলামের হাতে। চীনা অভিজ্ঞতার মূল্যায়নে বসে আমিনুলের এখন মনে হয় দুরূহ এক কাজ করেছেন। চাঁদে নিল আর্মস্ট্রংয়ের প্রথম পা ফেলা যেমন। এসিসির ক্রিকেট-সমাজে অনেকে আমিনুলকে নিল আর্মস্ট্রং বলেও ডাকে!
এমন খেতাবটা তাঁকে খুব মানিয়েও যাচ্ছে। কারণ, চীন একটা রক্ষণশীল দেশ। বিশেষত কোনো প্রযুক্তি বা ধারণা গ্রহণ করার ক্ষেত্রে একটু বেশিই রক্ষণশীল। ও দেশে কোনো ধারণা নিয়ে গেলেই মানুষ প্রথমে প্রশ্ন করবে, এটা আমরা কেন নেব? অ্যাথলেটিকস, সাঁতার, টেবিল টেনিস, বাস্কেটবল, ফুটবল আর বেসবলের দেশে ক্রিকেট ঔপনিবেশিক খেলা। আমিনুলকে সেই ধারণাটা প্রথমে ভাঙাতে হয়েছে। বলতে হয়েছে, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী ভারতকে টক্কর দিতে হলে এই খেলাটাও শেখা জরুরি। এর পরই চীনাদের মনে ধরেছে এই খেলা। কিন্তু বাস্তবতা ছিল আরও কঠিন। চীন সরকার অলিম্পিকের খেলা নিয়ে যতটা আগ্রহী, ক্রিকেটে ততটাই অনাগ্রহী। তাদের মাথায় ঘোরে সোনার মেডেল। যে খেলার সোনা চীনকে দেবে অলিম্পিক শ্রেষ্ঠত্ব, সেই খেলাই তাদের দরকার। ক্রিকেট অলিম্পিকের খেলা নয়। আইসিসি, এসিসি বা আমিনুলকে তাই অনেক কষ্ট করে বোঝাতে হয়েছে ক্রিকেটের গুরুত্ব। বেইজিং দিয়ে শুরু করে পরে পথ টানতে হয়েছে প্রত্যন্ত গ্রামে। আমিনুলকে শুধু কলা-বিস্কুট খেয়ে কাটাতে হয়েছে দিনের পর দিন। ক্রিকেট খেলাটা বুঝিয়েছেন স্কুলে স্কুলে গিয়ে। শিখিয়েছেন মাঠে নেমে। তারপর প্রতিভা অনুসন্ধান। ১০০ জন ছেলেমেয়েকে বাছাই করে তাদের প্রশিক্ষিত করে নামতে হয়েছে মাঠের খেলায়। আমিনুলের তৃপ্তি এখানেই যে চীনে এখন ক্রিকেট জ্ঞানসম্পন্ন জনসংখ্যা ২৯ হাজার, ২২টি প্রদেশ আর পাঁচটি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলসংবলিত বিশাল দেশটিতে নিয়মিত ক্রিকেটারের সংখ্যা ৭৫০। সেখানে ক্রিকেট আগ্রহ ঊর্ধ্বমুখী। ক্রিকেট ম্যানুয়াল বেরিয়েছে চীনা ভাষায়। চীনা ভাষায় ক্রিকেটের মৌলিক জ্ঞানের বইটি লিখেছেন ‘চীনের অক্সফোর্ড’ শিং হুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োমেকানিকসের অধ্যাপক ড. লিউ। না, অনুবাদ করেননি। ক্রিকেট খেলা শিখেছেন, আম্পায়ারিং ও প্রশিক্ষণ কোর্স করেছেন; তারপরই লিখেছেন বানছো জিয়াও চেং নামের বইটি। বান মানে ব্যাট, ছো অর্থ বল। অর্থাৎ ব্যাট-বলের খেলা। চীনে ক্রিকেটকে বলা হয় বানছো।
আমিনুলের উপলব্ধি, ক্রিকেটের পৃথিবীকে বদলে দেবে চীন। নতুন পৃথিবীটা হবে সংক্ষিপ্ততর বানছোর। যার মধ্যে থাকবে বাণিজ্য, বিজ্ঞান বা বায়োমেকানিকস। আর চীনারা নতুন যা ধরে, নিজেদের শ্রেষ্ঠত্বের আলপনা তাতে না এঁকে ছাড়ে না।