বনের মধ্যে দুরন্ত বেগে ছুটে চলছে রথ, তাতে বসে হরিণ শিকারে বের হয়েছেন রাজা দুষ্মন্ত। বনের ভেতর ছুটতে গিয়ে তিনি হাজির হন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে! পাশেই দেখা যায় মহর্ষি বিশ্বামিত্র ও অপ্সরী মেনকার কন্যা শকুন্তলা। কালিদাসের চরিত্ররাও কি তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে এখন? সময়টা তখন ঘড়ির কাঁটায় বিকেল সাড়ে ৫টা পেরিয়ে গেছে। সূর্যটাও ব্যস্ত ঢাকা শহরের ওপর থেকে বিদায় নেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। পড়ন্ত বিকেলের ক্লান্তি চারদিকে। এমনই এক পরিবেশে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণের এক কোণে শোনা যায় ঢোল আর ঢাকের শব্দ। কৌতূহল জাগে। শব্দের উৎসের খোঁজে আমরা ধীরে ধীরে পা বাড়াই। কাছে যেতেই শোনা যায় হরিণের ডাক আর রাজ-দরবারের হইহুল্লোড়।
‘কালিদাসের লেখা বিখ্যাত সংস্কৃত নাটক অভিজ্ঞান শকুন্তলম, সেই নাটকের মহড়া চলছে,’ আমাদের কৌতূহল নিবৃত্ত করলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিষয়ক বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীদের একজন হুমায়ূন আহমেদ। ২৩ ও ২৪ জুলাই নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি সিনে অ্যান্ড ড্রামা ক্লাব আয়োজন করছে শকুন্তলা নাটকের মঞ্চায়ন। নাটকটির নির্দেশনা দিচ্ছেন তেজগাঁও সরকারি কলেজের নাট্যকলা বিভাগের শিক্ষক আতিকুল ইসলাম। যে নাটক পড়ে উচ্চমাধ্যমিকের গণ্ডি পেরিয়েছেন শিক্ষার্থীরা, তা নিয়ে ক্যাম্পাসে দেখা যায় তুমুল আগ্রহ। নাটকের জন্য টিকিট বিক্রির বুথের সামনে শিক্ষার্থীরা ভিড় করছেন কয়েক দিন ধরেই। হুমায়েরা আর হামিম বলেন, ‘আমাদের ক্যাম্পাসের বন্ধুদের নাটক। না দেখলে কি হয়? তাই আগেই টিকিট কেটে রাখছি।’
নর্থ সাউথের শিক্ষার্থীরা ছাড়াও, যে কেউ চাইলে ফেসবুক ইভেন্ট পেইজ (facebook. com/nsucdc/) থেকে টিকিট বুকিং করতে পারবেন নাটকটি দেখার জন্য। সংগঠনের প্রেসিডেন্ট দেবাংশু চক্রবর্তী, জেনারেল সেক্রেটারি দেবদ্যুতি আইচ আর ক্লাবের বাকি সদস্যরা ভীষণ রোমাঞ্চিত এই আয়োজন নিয়ে। একদিকে যেমন মহড়া, অন্য দিকে চলছে দর্শক, মঞ্চ ও শব্দ ব্যবস্থাপনার আয়োজন। সবই করছেন শিক্ষার্থীরা। ক্লাস-পরীক্ষা আর ল্যাবের চাপ সামলেই চলছে নাটকের প্রস্তুতি। ক্লাবের উপদেষ্টা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টুডেন্ট অ্যাফেয়ার্সের পরিচালক পারিসা সাকুর বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমরা শিক্ষার্থীদের সৃজনশীল কাজে আগ্রহী করে তোলার জন্য উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছি। মঞ্চনাটকটি নিয়ে ছেলেমেয়েরা ভীষণ আগ্রহী। দারুণ কিছু মঞ্চে দেখার জন্য আমরাও অপেক্ষায় আছি।’
নাটকটি মঞ্চায়িত হবে নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির মিলনায়তনে। অভিনয়শিল্পীরা সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনে অ্যান্ড ড্রামা ক্লাবের সদস্য। বিশ্ববিদ্যালয়ে নাটক বা সিনেমার কোনো বিভাগ না থাকলেও বিবিএ, প্রকৌশলের মতো বিষয়ে পড়ুয়া শিক্ষার্থীরাই গড়ে তুলেছেন ক্লাবটি। সকাল আর দুপুরে ক্লাস করে আবার মহড়ায় সময় দিচ্ছেন তাঁরা। ঘুমের ঘোরেও তাঁদের মনে উঁকি দিয়ে যাচ্ছে নাটকের সংলাপ!
সারা দিন ক্লাস, ল্যাব, অ্যাসাইনমেন্ট, কুইজ চলে। দিনের শেষে সবাই হাজির হন মহড়া কক্ষে। ভাববেন না, সারা দিনের ধকলে তাঁরা ক্লান্ত হয়ে যান। মহড়ার মঞ্চে পা রাখলেই ক্লান্তি দূর হয়ে যায় কোথায়! উচ্চকণ্ঠে একেকজনের সংলাপ আওড়ানো শুনলে মনে হয়, দিনের তো সবে শুরু! কাশফি, মারুফ, রিদি, ইতুরা তাঁদের চরিত্রগুলো ঠিকঠাক রপ্ত করে নিচ্ছেন। আবার ফার্মাসি বিভাগের নীরা ও তুলি ব্যবহারিক ক্লাস থেকে সোজা চলে এসেছেন মহড়া কক্ষে। এঁরাই একেকজন হয়ে যাচ্ছেন শকুন্তলা আর রাজা দুষ্মন্ত। সবার অপেক্ষা ২৩ ও ২৪ জুলাইয়ের জন্য। এখন আর বিশ্রামের সময় নেই। আর তো মাত্র কয়েকটা দিন। অন্ধকার মিলনায়তন থেকে যখন তুমুল করতালির শব্দ শোনা যাবে, বোধ হয় তখনই এই তরুণদের কষ্ট সার্থক হবে।