কোয়ারেন্টিন শব্দটি সাম্প্রতিক সময়ে বেশি উচ্চারিত হলেও সেই কত আগে ‘টিনটিন’–এ ক্যাপ্টেন হ্যাডক পুলিশ জনসনকে বলছেন, জাহাজকে তো কোয়ারেন্টিন করা হলো না। ছোঁয়াচে রোগ থেকে আলাদা করা বুঝিয়েছিলেন হ্যাডক। কমিকটি সম্ভবত ছিল সূর্যদেবের বন্দী।
তবে করোনার শুরুতে পুরো একটি জাহাজ কোয়ারেন্টিন করা হলো। গত ৫ ফেব্রুয়ারি প্রমোদতরি ডায়মন্ড প্রিন্সেস কোয়ারেন্টিন করা হলো। ৩ হাজার ৬০০ জন যাত্রী নিয়ে চলছিল সেই তরি, এর মধ্যে ৭০০ জনের করোনা পজিটিভ।
এখন অনেকেই কোয়ারেন্টিনে বেঁধেছেন ঘর। দুশ্চিন্তার মেঘ কাটছে না, কবে এ কাল শেষ হবে। ফেসবুকে পোস্ট, জুম সভা, বিশেষজ্ঞ পরামর্শ, গণমাধ্যমে নানা খবর, আলোচনা এখন বিষয়টি বেশ সরল করে আনছে।
চিকিৎসকেরা দিনের পর দিন ঘরে ফিরছেন না, ডিউটির পর কোয়ারেন্টিনের পর স্বল্প দিনের জন্য ঘরে ফেরা। নার্স, টেকনোলজিস্ট, স্বাস্থ্যকর্মী অন্যদের একই অবস্থা। তাঁদের সবার জন্য সরকার আবাসন দিল হোটেলে আহারসহ। কিছুদিন পর অন্য ব্যবস্থা, সরকারি নিবাসে থাকা, নয়তো ভাতা নিয়ে নিজ ব্যবস্থায় থাকা–খাওয়া।
আর যাঁরা আমরা বাড়ি থেকে বেরুতে পারছি না তাঁদের চেয়ে অনেক বেশি চাপ তাঁদের, কষ্টও বেশি। রোজগেরে কর্তাগিন্নিদের অবস্থা এ রকমই। তবে ডাক্তার আর সম্মুখসারির করোনাযোদ্ধাদের দুর্দশা চরমে।
আমরা ঘরবন্দীরা আর কত ছাদঘর করে, বোকা বাক্স দেখে দেখে সময় কাটাব? বন্দিত্ব বিষয়টা আমরা এখন বুঝেছি। সন্ধ্যা, হেমন্তের গান আর কত শোনা যায়!
কেবল তা নয়। লকডাউনের পাল্লায় গড়া জীবন। অন্তরীণ হওয়া। স্ব অন্তরীণ। নিঃসঙ্গ বাস। গৃহবন্দী দশার কত রকমফের।
অবশ্য এখন নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করা হচ্ছে। ব্যস্ত, উচ্চপদস্থ অনেক লোক যেমন গেরস্থালি কাজে ঢুকছেন। ঘর মোছা, কাপড় ধোয়া, বাসন ধোয়া, এমনকি মাঝেমধ্যে রান্নাবান্নাও করছেন। বাড়ির গিন্নির কাজ যে বেশ শ্রমের, এখন তা বোঝা যাচ্ছে।
এই ঘোর অলস বাসে হাতের কাছে মুঠোফোন, ট্যাব, ল্যাপটপ, কম্পিউটার ভরসা। ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ। মনের ভাব মাঝেমধ্যে বন্ধুদের জানানো। বাজারে যাচ্ছে ঘরের তরুণ ছেলে। বেশির ভাগ সময় ডিপার্টমেন্ট স্টোর। লাইনে নির্ধারিত দূরত্বে দাঁড়িয়ে থেকে সওদা করা।
সব খুলে গেল। স্কুল বাদে সব। মানুষ সব বেরিয়েছে, বাজারে ভিড়। নেই কোনো স্বাস্থ্যবিধি মানা।
শুধু অনেকে ক্ষৌরী করছেন ঘরে। পারলারে আর সেলুনে লোক কম। ফাঁকা। দাড়ি–গোঁফ আর বাবরি চুল নিয়ে ওয়ার্ক ফ্রম হোম চলছিল। এখন প্রায় সব অফিস খুলল।
করোনা পরিস্থিতি, স্বাস্থ্যবিধি—এসব নিয়ে জুম মিটিং বেশ হচ্ছে। অনলাইন গ্রুপ আছে ম্যালা।
ডাক্তারদের এসব করতে পারা কঠিন। হাসপাতালে যেতে হয়। পিপিই (ব্যক্তিগত সুরক্ষাসামগ্রী) পরে আট ঘণ্টা ডিউটি। নভোচারীদের মতো দেখতে লাগছে, রহস্যগল্পের আধিভৌতিক চরিত্রের মতো।
জানালা দিয়ে ঘরবন্দীরা শহর দেখে। আগের চেয়ে সচল–সরব। বাইরে যেতে মানা বয়স্কদের। তবে গাছের সবুজ আর ফুলের শোভা দেখে মন কিছুটা ভরে।
দূষণমুক্ত শহর কি আবার আগের মতো হবে?যানজট আবার হবে আগের মতো? হয়তো গেছে।
সামনের যে গাছ, তার পাতাগুলো খুব সবুজ লাগল। শালিক–চড়ুই নাচছে ডালে ডালে। এখন ছবি তোলা সোজা। মোবাইল দিয়ে তোলা যায়। এখন আবার অনেকের গান শোনার শখ চেপে বসেছে।
তবু ভালো, নষ্ট ভাইরাসটি কুড়ি বছর আগে আসেনি। তাহলে মোবাইল ফোন এমন সবার হাতে থাকত না, ঘরবন্দী সময় হতো দুঃসহ। ঘুম হতো না প্রিয়জন–স্বজনদের খবর না পেয়ে। সে সময়ের চাকতি ঘোরানোর কাল ল্যান্ড ফোন দিয়ে আর কত!
টিভি দেখা চলছে। মাঝেমধ্যে ছাদে উঠে পায়চারি। ফ্ল্যাট বাড়ির বাসিন্দা হলে অন্য ফ্ল্যাটের দু–চারজনের দেখা মেলে। একটু চেঁচিয়ে হাত ভঙ্গি করে কুশল বিনিময়।
ঘরে বাচ্চাদের স্কুল বন্ধ। ওরা অনলাইন ক্লাস করছে।
ঘরে হয়তো কারও করোনা পজিটিভ, তার জন্য আলাদা ঘর, আলাদা বাসন, আলাদা তোয়ালে। যাঁরা পারছেন, তাঁরা দিচ্ছেন আলাদা স্নানঘর। খাবার তৈরি হলে মোবাইলে মিসড কল। তিনি দরজা ফাঁক করে হাত বাড়িয়ে দরজার সামনে রাখা খাবার টেনে নিলেন।
কলেজের স্কুলের শিক্ষক বাসা থেকে অনলাইন ক্লাস নিচ্ছেন। পাওয়ার পয়েন্ট স্লাইড বানানো চলছে।
হঠাৎ দেখলেন জানালা দিয়ে সামনের কৃষ্ণচূড়াগাছের ডালে একটি টিয়া পাখি বসে আছে। ফ্ল্যাশব্যাক। গুলিস্তানের ফুটপাত। সেই লোকটি টিয়া নিয়ে বসে আছে। টিয়ার এক পায়ে সরু চেন। সামনে মুখ বন্ধ এনভেলপ। টিয়া হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ একটি খাম ঠোঁট দিয়ে তুলল। কী লেখা আছে ভেতরের স্লিপ কাগজে? করোনা আর নাই? এমন ভাগ্য হবে!
আজকাল ভাতঘুম হয় না। অফিসে যখন কর্মব্যস্ত নটা-পাঁচটা, তখন লাঞ্চ আওয়ারে গিন্নির দেওয়া টিফিন ক্যারিয়ার খুলে ডাল ভাত, বেগুন ভাজা, পাবদা মাছের ঝোল খেয়ে সামান্য না গড়ালে চলত না। চেয়ারের ওপরেই ঘুম।
আজকাল ওয়াকম্যান নেই। গান শোনার অন্য রকম ব্যবস্থা।
ঘরে অনেকে লুডু খেলেন, ক্যারম খেলেন। কেউ টিভি অ্যাডের ফাঁকে দড়িলাফ দেন। কেউ করেন জগিং।
সময় অনেক হাতে। ঘরের জঞ্জাল ঘাঁটতে গিয়ে বেরুল পুরোনো শখের চিহ্ন। স্ট্যাম্প কালেকশন। কারও কয়েন কালেকশন। পুরোনো বই। ক্যাসিও ঘড়ি। মোবাইলের পুরোনো ভার্সন। বাগা ডু লি। শৈশব–কৈশোর ফিরে এল।
ঘুম আসে না। ঘুম এলেও শেষ রাতে ঘুম ভাঙে নানা স্বপ্ন দেখে।
অদ্ভুত সব স্বপ্ন।
অদৃশ্য করোনাভাইরাস দেখা দেয়। খুদে দানব। আর মানুষ লড়াই করে। শ্বেতকণিকা, বি সেল, টি সেল অ্যান্টিবডি সব এক হয়ে এই কণ্টকাকীর্ণ গোলককে ঘিরে ধরেছে, আঘাতে আঘাতে শেষ করল একে। মানুষের জয় হলো। ভোরের আলো ঢুকছে ঘরের জানালার ফাঁক দিয়ে। স্বপ্ন হবে কি সত্যি?