রাজধানীর প্রাণকেন্দ্র ফার্মগেট বাসস্ট্যান্ডের তুমুল হট্টগোল ফেলে কিছুদূর এগোলে হাতের বাঁ দিকে লালরঙা কয়েকটি ভবন। চারদিকে সবুজ গাছগাছালিতে ঘেরা। পাখির চোখে দেখলে অনেকটা বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার মতো দেখায়। আর পাশ দিয়ে গেলে প্রবেশমুখে লেখা দেখা যাবে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল (বিএআরসি)।
এই পথ দিয়ে যাঁরা নিয়মিত যাতায়াতের সময় ভবনগুলোকে দেখেন তাঁদের অনেকের মনেই প্রশ্ন উঠতে পারে, শহরের ব্যস্ত সড়কের পাশে নিঝুম পরিবেশের কার্যালয়টি কিসের? কী হয় এখানে? এটি যে সংস্থার কার্যালয়, সেখান থেকে দেশের কৃষি গবেষণার ১২টি প্রতিষ্ঠানের কাজ সমন্বয় করা হয়। আর দেশের মানুষের প্রধান খাদ্য চাল, আলু, সবজি, মাছ–মাংস ও ডিমে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে এই প্রতিষ্ঠানগুলো। ১২ প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞানীরা এ পর্যন্ত সাত শতাধিক ফসলের জাত উদ্ভাবন করেছেন। কৃষিকাজ সহজ করতে ১ হাজার ৩০০টি প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছেন তাঁরা। এসব কারণে চলতি বছর স্বাধীনতা পদক পেয়েছে বিএআরসি।
সরকারি কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর গবেষণাকাজে দিকনির্দেশনা দেওয়া ছাড়া আরও কাজ করে বিএআরসি। সরকারের কৃষিবিষয়ক নীতি ও পরিকল্পনা তৈরি থেকে শুরু করে কোন ফসলে কী পরিমাণে সার দিতে হবে, তার নির্দেশিকা তৈরি করেন এখানকার গবেষকেরা। কোন মাটিতে কী ধরনের ফসলের চাষ কখন করতে হবে তা–ও গবেষণার মাধ্যমে জানিয়ে দেন তাঁরা। কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর কাজের মূল্যায়ন, তদারকি আর প্রসারেও ভূমিকা রাখে সংস্থাটি।
বাংলাদেশ নামের স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্মের পর ১৯৭৩ সালে বিএআরসি গঠিত হয়। যুদ্ধবিধ্বস্ত এই দেশে তখন কৃষিই ছিল সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক খাত। দেশের প্রধান রপ্তানিপণ্য ছিল তখন পাট আর চা। দেশের কৃষি গবেষণার জন্য বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান আগে থেকেই কাজ করছিল। কিন্তু এসব প্রতিষ্ঠানের কাজের মধ্যে সমন্বয়ের জন্য কোনো আলাদা কর্তৃপক্ষ ছিল না।
ফার্মগেটের যে স্থানটিতে সংস্থাটির কার্যালয়, তখন সেখানে একটি পাঁচ তারকা হোটেল করার প্রস্তাব ছিল। দেশের কৃষি গবেষণার অন্যতম পথিকৃৎ কাজী বদরুদ্দোজা তখন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে সরাসরি দেখা করেন। তিনি বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন বাংলাদেশকে গড়ে তুলতে হলে কৃষিকে সবার আগে গুরুত্ব দিতে হবে। দেশের সব কৃষিবিষয়ক সংস্থা নিজেদের মতো করে কাজ করছে। কিন্তু তাদের কাজের মধ্যে সমন্বয় নেই। তাই কৃষিবিষয়ক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রধান কার্যালয় ফার্মগেটে নিয়ে আসতে হবে। আর সব কটি সংস্থার মধ্যে সমন্বয় করার জন্য বিএআরসি গড়ে তুলতে হবে।
কাজী বদরুদ্দোজার ওই প্রস্তাবে রাজি হয়ে বঙ্গবন্ধু বিএআরসি স্থাপনের অনুমতি দিলেন। সেখানে দেশের কৃষি গবেষণা খাতের অগ্রসর গবেষকদের নিয়োগ দিলেন। একে একে সেখান থেকে দেশের কৃষি খাতের ভবিষ্যৎ পথচলার পরিকল্পনা, নীতি আর প্রস্তাবগুলো তৈরি হতে থাকল। এখানকার জনবলকাঠামো শুধু দেশের মধ্যে নয়, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যথেষ্ট স্বীকৃতি পেয়েছে। এখানকার গবেষকদের ৪০ শতাংশ পিএইচডি ডিগ্রিধারী। এ পর্যন্ত দেশের প্রায় ৬২ হাজার কৃষিবিজ্ঞানী ও গবেষককে এখান থেকে উচ্চতর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের পরেই বাংলাদেশের কৃষি গবেষণা কাউন্সিল নিজ দেশের খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে এবং কৃষির উন্নতিতে সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকা রাখছে বলে জাতিসংঘ থেকে স্বীকৃতিও পাওয়া গেছে।
বিএআরসি থেকে ধান, পাট, আলু, গম, কেনাফ, আখ ও মেস্তার নতুন জাত অনুমোদন দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রধান কারিগরি সহায়তা দেওয়া হয়। বিএআরসির চেয়ারম্যান শেখ মোহাম্মদ বখতিয়ারের নেতৃত্বে গত মাসে ১০০ কৃষি প্রযুক্তি মানচিত্র প্রকাশ করা হয়েছে। দেশের ভবিষ্যৎ কৃষি–উদ্যোক্তা গড়ে তুলতে ওই বইটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে মনে করা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক বাজারের জন্য উপযোগী জৈব কৃষি নির্দেশিকা তৈরি করে তা মাঠপর্যায়ে ছড়িয়ে দিতে সংস্থাটি এখন কাজ করছে। এখান থেকে দেশের কৃষি প্রতিবেশ মানচিত্র তৈরি করা হয়েছিল। অর্থাৎ দেশের কোন ভৌগোলিক এলাকায় কোন ধরনের ফসলের চাষ করতে হবে। কোন এলাকার প্রতিবেশ, মাটি, পানি ও আর্থসামাজিক অবস্থায় কোন ধরনের ফসল চাষ করা উচিত, তা–ও এখন তারা তৈরি করছে।
১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পরের বছর দেশে চাল, গম, সবজি মিলিয়ে দেড় কোটি টন খাদ্য উৎপাদিত হতো। ২০২০ সালে দেশের প্রধান খাদ্যগুলোর মোট উৎপাদন ৫ কোটি টন ছাড়িয়েছে। তবে খাদ্য উৎপাদন বাড়লেও খাদ্যের মান নিয়ে দেশে উদ্বেগ আছে।
২০১২ সালে দেশে ফল, মাছ ও অন্যান্য খাদ্যে ফরমালিনের ব্যবহার নিয়ে আতঙ্ক তৈরি হয়। বিএআরসির পুষ্টি বিভাগের প্রধান মনিরুল ইসলামের নেতৃত্বে দেশের পাঁচটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান মিলে সব ধরনের খাদ্যপণ্যের মান পরীক্ষায় একটি জরিপ করা হয়। সেখানে দেখা যায়, বেশির ভাগ খাদ্যে ফরমালিনের উপস্থিতি নেই। তবে প্রক্রিয়াজাত খাদ্যে কৃত্রিম রং, চিনিসহ নানা উপাদান ব্যবহার করা হচ্ছে, যা মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর।
দেশের কৃষি খাতকে আন্তর্জাতিক বাজারের উপযোগী করে গড়ে তুলতে বিএআরসি এখন ২০৩০ ও ২০৪১ সালের জন্য মহাপরিকল্পনা তৈরি করছে। কৃষকদের অক্লান্ত পরিশ্রম, উদ্যোক্তা–ব্যবসায়ীদের উপকরণ সরবরাহ ও বিজ্ঞানীদের নিত্যনতুন আবিষ্কার মিলেমিশে দেশের কৃষি খাতকে সামনে আরও এগিয়ে নিয়ে যাবে। আর তাই প্রতিষ্ঠানটির অবদানের স্বীকৃতি দেওয়া হলো স্বাধীনতা পদকের মধ্য দিয়ে।