পুরান ঢাকার কাচ্চি কিংবা ইউটিউবের লাখো ভিউ—যে টানেই হোক না কেন, গত কয়েক বছরে বাংলাদেশে বেড়াতে এসেছেন বেশ কজন নামী ফুড ব্লগার। দেশের আনাচকানাচ ঘুরে তাঁরা চেখে দেখেছেন বাঙালি খাবারের স্বাদ। এসব খাবার সম্পর্কে কী ছিল তাঁদের রায়?
ভদ্রলোকের নাম ট্রেভর জেমস। চাইলে ‘ঝান্ডুদা’ বলেও ডাকতে পারেন। সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘রসগোল্লা’ গল্পের সেই ঝান্ডুদার মতোই জেমসের জীবন কাটে হোটেলে হোটেলে। কানাডীয় বংশোদ্ভূত এই ফুড ব্লগার নানা দেশ ঘুরে মূলত স্ট্রিট ফুড চেখে দেখেন। ইউটিউবে তাঁর চ্যানেলের নাম ‘দ্য ফুড রেঞ্জার’। সাবস্ক্রাইবারের সংখ্যা প্রায় ৫৫ লাখ। নিজেকে বর্ণনা করতে গিয়ে ইউটিউব চ্যানেলের ডেসক্রিপশনে নিজের সম্পর্কে জেমস যা লিখেছেন, তার সারমর্ম হলো ‘আমি বাঁচার জন্য খাই না, খাওয়ার জন্য বাঁচি।’
এ দেশের সংস্কৃতি বোঝার জন্য জেমস যে শুধু সাদা পাঞ্জাবি গায়ে জড়িয়েছেন, তা–ই নয়। দু-একটা বাংলা শব্দও শিখেছেন তিনি। যেমন ‘এটা কী?’ ‘একটা দাও।’ বিভিন্ন রেস্তোরাঁ ঘুরে ঘুরে তিনি বলছিলেন, ‘কুব বালো মামা, কুব বালো!’
ট্রেভর জেমস বাংলাদেশে এসেছিলেন ২০১৯ সালে। ঢাকা আর চট্টগ্রাম ঘুরে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার কাঁচকলার ভর্তা থেকে শুরু করে চাটগাঁর মেজবানি মাংসও চেখে দেখেছেন। দিয়েছেন নম্বর। তা মোট ১০ নম্বরের মধ্যে কোন খাবার কত পেল? কয়েকটি নমুনা দেখা যাক—
কাঁচকলার ভর্তা : ৯
মামা হালিম : ৯.২
স্টার কাবাবের খাসির কলিজা : ৫.৮
মুস্তাকিমের চাপ : ৮
নীলা মার্কেটের কোরাল ফ্রাই : ৯.৫
জেমসের কাছে কোন খাবার কতটা ভালো লাগল, বুঝতে অবশ্য নম্বরের দিকে তাকানোর প্রয়োজন পড়ে না। যেকোনো খাবার মুখে দিয়ে তিনি যেভাবে চোখ বুজে ‘উমম’ বলেন, এই ‘উমম’–এর দৈর্ঘ্য থেকে খাবারের স্বাদ অনুমান করে নেওয়া যায়।
নীলক্ষেতের ভেলপুরি মুখে পুরে জেমস যেমন বললেন, ‘উমম’। নম্বর? ৭.৮।
আর চট্টগ্রামে কালাভুনা খেয়ে তাঁর অভিব্যক্তি, ‘উমমমম!’ নম্বর? ১০!
এ দেশের সংস্কৃতি বোঝার জন্য জেমস যে শুধু সাদা পাঞ্জাবি গায়ে জড়িয়েছেন, তা–ই নয়। দু-একটা বাংলা শব্দও শিখেছেন তিনি। যেমন ‘এটা কী?’ ‘একটা দাও।’ বিভিন্ন রেস্তোরাঁ ঘুরে ঘুরে তিনি বলছিলেন, ‘কুব বালো মামা, কুব বালো!’
জেমসের উচ্চারণ জটিলতায় কাচ্চি বিরিয়ানি হয়ে গেল ক্যাচি বিরিয়ানি। খাবারটা যে তাঁর কাছে আক্ষরিক অর্থেই Catchy (আকর্ষণীয়) মনে হয়েছে, বোঝা যায় নম্বরে। পুরান ঢাকার গ্র্যান্ড নবাবের কাচ্চি বিরিয়ানিকে জেমস দিয়েছেন ৯.৩।
চট্টগ্রামের রাস্তায় ট্রেভর জেমসকে ঘিরে একরকম ভিড় জমে গিয়েছিল। লোকজনকে আকৃষ্ট করতে ক্যামেরা তো ছিলই। তা ছাড়া সাদা পাঞ্জাবি পরা একজন বিদেশি রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে ঝালমুড়ি খাচ্ছেন, এমন দৃশ্য বোধ হয় সচরাচর দেখা যায় না। অতি আগ্রহী একজন সম্ভবত মজা করার জন্যই জেমসের হাতে একটা কাঁচা মরিচ তুলে দেন। কিন্তু নানা দেশ ঘুরে বহু খাবার চেখে দেখা জেমসও তো এত সহজে পিছু হটার পাত্র নন। ঝালমুড়ির সঙ্গে কচকচ করে কাঁচা মরিচ খেতে গিয়ে চোখ ছলছল হয়ে গেলেও তিনি বললেন, ‘বাংলাদেশ ইজ অ্যামেজিং!’
টি–শার্টে লেখা ‘আই ট্রাভেল ফর ফুড’ (আমি খাবারের জন্য ঘুরে বেড়াই) বটে। খাবারের জন্যই বাংলাদেশে বেড়াতে এসেছিলেন মার্ক উইয়েনস। যুক্তরাষ্ট্রে তাঁর জন্ম। তবে এই ফুড ব্লগার থাকেন থাইল্যান্ডে। নিজের নামেই তাঁর ইউটিউব চ্যানেল। সাবস্ক্রাইবারের সংখ্যা প্রায় ৯ লাখ। স্ত্রী য়িংকে সঙ্গে নিয়ে তিনি ঘুরে বেড়ান নানা দেশে।
বাংলাদেশে তাঁর ‘গাইড’ ছিলেন ‘পেটুক কাপল’ (রিদিমা খান ও রাসিফ শফিক) দম্পতি। নিজেরা বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে খাওয়াদাওয়া করেন, রান্না করেন, ভিডিও তৈরি করেন, এসবের মধ্য দিয়ে পেটুক কাপলও দেশে বেশ জনপ্রিয়।
এই বাংলাদেশি দম্পতির আমন্ত্রণে তাঁদের বাসায় এক বেলা ভূরিভোজ করেছেন মার্ক উইয়েনস। মাছ, ভর্তা, মাংস, ডাল—কী ছিল না মেনুতে! খেয়ে মার্কের পেট আর মন দুটোই যে ভরেছে, সেটা তাঁর অভিব্যক্তিই বলে দেয়। পাবদা মাছের ঝোলে ভাত মাখিয়ে, মুখে দিয়ে মুগ্ধতায় মার্কের চোখ বুজে আসছিল। আবার গরুর মাংস একটুখানি ভেঙে মুখে দিয়ে তিনি বলছিলেন, ‘ওহ্! এটা এতই নরম যে খাওয়ার জন্য দাঁতের প্রয়োজন হয় না।’
গরুর মাংসের তরকারি থেকে শুরু করে রাস্তার পাশে ভেলপুরি, ঢাকাই রেস্তোরাঁর কাচ্চি বিরিয়ানি, পুরান ঢাকার কাবাব, প্রতিটি খাবারই মার্ককে মুগ্ধ করেছে। পেটুক কাপলের সঙ্গে কুষ্টিয়ায় গিয়ে স্থানীয় ঘরোয়া রান্নাও খেয়েছেন পেট পুরে। বাংলাদেশের খাবার সম্পর্কে মার্কের মত, ‘তোমাদের সব রেসিপিতেই কাঁচা মরিচ আর পেঁয়াজ থাকে।’
পাহাড়ি খাবারের স্বাদ নিতে মার্ক গিয়েছিলেন মিরপুরের হেবাং রেস্তোরাঁয়। চিংড়িভর্তা, বাঁশের ভেতর রান্না করা মুরগি, শুঁটকি, আরও নানা কিছু খেয়ে তাঁর মুখে যে অভিব্যক্তি ফুটল, দেখে ভরা পেটেও আপনার ক্ষুধা লেগে যাবে নিশ্চিত!
মার্কিন নাগরিক উইল সনবাকনারকে (সনি নামে পরিচিত) ফুড ব্লগার না বলে ‘কনটেন্ট নির্মাতা’ বলা ভালো। একদল ক্রু নিয়ে যেভাবে তিনি নানা দেশ ঘুরে নানা রকম খাবারের ভিডিও করেন, ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতি তুলে ধরেন, তাতে তাঁর এই মহাযজ্ঞকে স্রেফ ‘ফুড ব্লগ’–এর গণ্ডিতে ফেলা যায় না। বরং তাঁর একেকটা ভিডিওকে একেকটা ‘সুস্বাদু’ তথ্যচিত্র বলতে পারেন।
চ্যানেলের নাম ‘বেস্ট এভার ফুড রিভিউ শো’। সত্যি সত্যি বেস্ট এভার (সর্বকালের সেরা) কি না, সেই নিশ্চয়তা দিতে পারছি না। তবে জানিয়ে রাখি, সনির চ্যানেলে সাবস্ক্রাইবারের সংখ্যা প্রায় ৮৭ লাখ।
বাংলাদেশে তিনি এসেছিলেন বছর দুয়েক আগে। সেবার জনপ্রিয় বাংলাদেশি ফুড ব্লগার রাফসান (রাফসান দ্য ছোট ভাই) সনিকে সঙ্গ দিয়েছেন। দুজনের আড্ডাটা বেশ ভালোই জমেছে। পুরান ঢাকার হাজীর বিরিয়ানি থেকে শুরু করে বাকরখানি কিংবা রাস্তার পাশের বটভাজাও তাঁরা চেখে দেখেছেন।
পরিমিত রসবোধের কারণে সনিকে অন্যান্য ফুড ব্লগারের চেয়ে একটু আলাদা বলাই যায়। বিউটির লাচ্ছি কতটা পুরোনো, সেটা বোঝাতে গিয়ে তিনি যেমন বলছিলেন, ‘এই লাচ্ছি যখন থেকে বানানো হয়, তখন এমনকি টেলিভিশনও আবিষ্কৃত হয়নি।’
বিউটির লাচ্ছি খেতে খেতে বাংলাদেশের ‘বিউটি’টাও খুঁজেছেন তিনি। ধারাভাষ্যে সনি বলেছেন, ‘এই প্রচণ্ড ব্যস্ত শহরে যখন তুমি তোমার চেনা টুল বা সিটে বসবে, যেখানে আগেও হয়তো ১০০ বার বসেছ; তারপর যখন পছন্দের খাবারে জুতসই কামড়টা দেবে, কয়েক সেকেন্ডের জন্য মনে হবে, চারপাশ স্থির হয়ে গেছে। রিকশার বেল থেমে গেছে। মনে হবে, পৃথিবীতে সব সুন্দর।’
রাফসানের সঙ্গে ঘুরে ঘুরে সনি নানা কিছু খেয়েছেন। মাছভর্তা থেকে কতবেলভর্তা, তেলাপিয়া ফ্রাই থেকে মেজবানি মাংস। বটভাজা খেতে গিয়ে তাঁকে একটু ইতস্তত মনে হলো। তাওয়ার সামনে দাঁড়িয়েই কাশতে কাশতে বলছিলেন, ‘ইটস সো স্পাইসি’ (এটা এত্তো ঝাল)। এ সময় চন্দ্রবিন্দু ব্যান্ডের ‘পাগলা খাবি কি ঝাঁজেই মরে যাবি’ গানটা আবহ হিসেবে ব্যবহার করাই যেত!
কীভাবে ভালো ফুড ব্লগার হতে হয়, এ বিষয়ে রাফসানকে কিছু টিপসও দিয়েছেন সনি। প্রথমত, খাবারের বর্ণনা করা জানতে হবে। দ্বিতীয়ত, উপস্থাপনায় বেশ একটা উদ্যম থাকতে হবে। তৃতীয়ত, খাবারের দারুণ সব শট নিতে হবে। কমপক্ষে নয়টা। শুনে রাফসান অবাক হয়ে বলছিলেন, ‘একটা খাবারের নয়টা শট নেব!’
‘খাবারের না। খাবারের একেকটা উপাদানের’—সনির জবাব।