কিশোরীদের বানানো প্যাড ব্যবহার করছে অন্যরাও

ঝুমা, মণি, সোনিয়া, শোভাসহ সুবিধাবঞ্চিত প্রায় ১০ জন কিশোরী গোল হয়ে বসে স্যানিটারি প্যাড বানাচ্ছে। গজ, তুলা, কাপড় দিয়ে স্যানিটারি প্যাড বানানোর সময় নিজেরা গল্প করছে। প্যাডগুলো কিশোরীরা নিজেরা ব্যবহার করে। একই সঙ্গে অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি বানানো প্যাড কিনেও নিচ্ছে। ফরমাশ অনুযায়ী কিশোরীরা তা বানিয়ে দিচ্ছে। এই পরিশ্রমের জন্য বিক্রি হওয়া স্যানিটারি প্যাডের আয় থেকে নির্দিষ্ট একটি অংশ পাচ্ছে, যা তারা ব্যাংকে জমায় এবং নিজেদের ইচ্ছা অনুযায়ী খরচ করে।

রাজধানীর পুরান ঢাকায় চানখাঁরপুলের কাছে নতুন মাজেদ সর্দার সড়কে বেসরকারি সংগঠন অপরাজেয় বাংলাদেশ পরিচালিত ড্রপ ইন সেন্টার বা শেল্টার হোমে এ চিত্র দেখা যায়। তবে শুধু এ কেন্দ্র নয়, সারা দেশে সংগঠন পরিচালিত এ ধরনের কেন্দ্রে যেখানে কিশোরীরা আছে, সব জায়গায় তারা নিজেরাই স্যানিটারি প্যাড বানাচ্ছে।

চানখাঁরপুলের কাছে শেল্টার হোমটি পরিচালিত হচ্ছে জাতিসংঘ শিশুবিষয়ক তহবিলের (ইউনিসেফ) সহায়তায়। কিশোরীরা পড়াশোনাসহ নিজেদের কাজ শেষ করে স্যানিটারি প্যাড বানায় বলে জানায়। তারা জানে, মাসিকের সময় পরিষ্কার–পরিচ্ছন্ন থাকতে হয়। স্যানিটারি প্যাড ব্যবহার করলে নির্দিষ্ট সময় পরপর তা পাল্টাতে হয়। ব্যবহার করা প্যাড নির্দিষ্ট জায়গায় ফেলতে হয়।

শোভা এ কেন্দ্রে এসেছে প্রায় সাড়ে সাত বছর আগে। তার আরেক বোনও এ কেন্দ্রে ছিল। বিয়ে হওয়ার পর বোন চলে গেছে। শোভা বর্তমানে কলেজে পড়ছে। বাংলাদেশ টেলিভিশনে ইউনিসেফের সহায়তায় অনুষ্ঠিত অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করছে। জানাল, বিভিন্ন কাজের পাশাপাশি সে প্যাড বানায়। বানানো প্যাডগুলো প্যাকেট করে রেখে দেওয়া হয়।

অপরাজেয় বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ওয়াহিদা বানু প্রথম জানান, কিশোরীরা বড়, মাঝারি, ছোটসহ বিভিন্ন আকৃতির প্যাড বানায়। আশ্রয়কেন্দ্রের কিশোরীরা বিনা মূল্যে প্যাড ব্যবহার করে। আর বাইরে প্যাকেট বিক্রি করা হয় সর্বোচ্চ ৪৫ টাকায়। তবে এটি বাণিজ্যিকভাবে বা বড় পরিসরে করা হচ্ছে না। ভবিষ্যতে এই কিশোরীরা বড় হলে তাদের পুনর্বাসনের কার্যক্রম হিসেবে সামাজিক ব্যবসা উদ্যোগের অংশ হিসেবে প্যাড বানানোর পরিকল্পনা আছে। আর আশ্রয়কেন্দ্রে নতুন কিশোরী এলেই তার মাসিক সম্পর্কে খোঁজ নেওয়া হয়। তাকে প্যাড বানানোর প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।

ওয়াহিদা বানু জানান, অপরাজেয় বাংলাদেশ বলতে গেলে ১৯৯৮ সাল থেকেই প্যাড বানাচ্ছে। প্রথমে কিশোরীদের জন্য আশ্রয়কেন্দ্রে যাঁরা কর্মরত থাকতেন, তাঁরা বানিয়ে দিতেন। এখন আর তার প্রয়োজন হয় না। প্রশিক্ষিত কর্মীরা শুধু প্যাড বানানোর প্রশিক্ষণ দেন।

এ পর্যন্ত ভারত, চীনসহ বিভিন্ন দেশ থেকে স্যানিটারি প্যাড তৈরিতে মেশিন দেওয়াসহ বিভিন্নভাবে সহায়তা করতে চেয়েছে বলে উল্লেখ করে ওয়াহিদা বানু বলেন, তবে সেসব কোম্পানির পক্ষ থেকে তাদের কাপড়, জনবল ব্যবহার করাসহ নানা শর্ত দেওয়া হয়, যা মানা সম্ভব না।

চানখাঁরপুলের কাছে নতুন মাজেদ সর্দার সড়কে ড্রপ ইন সেন্টারের কিশোরীরা বানাচ্ছে স্যানিটারি প্যাড। ছবি: সাবরিনা ইয়াসমীন

ওয়াহিদা বানু বলেন, ‘আমি সব সময় স্বপ্ন দেখেছি, আমার মেয়েরা স্বল্প খরচে দেশীয় জিনিস ব্যবহার করেই স্যানিটারি প্যাড বানাবে। এই প্যাড স্বল্প আয়ের যে–কেউ যাতে ব্যবহার করতে পারে, তা সব সময় প্রাধান্য দিয়েছি। আর এখানে যে মেয়েটি প্যাড বানানোর প্রশিক্ষণ নিচ্ছে, সে যেখানেই যাচ্ছে, সেখানেই তা প্রচার করছে। মাসিক নিয়ে অন্যদের সচেতন করছে। আশ্রয়কেন্দ্র থেকে চলে গেলেও সে প্যাড বানিয়ে তা বিক্রিও করতে পারছে। দক্ষ জনবল তৈরি হয়েছে দেশে।’

ওয়াহিদা বানু জানান, কিশোরীদের বানানো প্যাডগুলো ব্যবহার নিরাপদ বলেই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা মতামত দিয়েছেন বিভিন্ন সময়।

প্যাড বানানো ও তা বিক্রির পর আসলেই নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা পাচ্ছে কি না, তা জানতে চাইলে শোভা হেসে জানায়, সে তার টাকা পাচ্ছে এবং তা আশ্রয়কেন্দ্রের শিশু উন্নয়ন ব্যাংকে রাখছে। এর বাইরেও তার ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট আছে, প্রমাণ হিসেবে সে তার চেক বই এনে দেখাল।