কির্সতং অভিযানের অদ্ভুত মায়াময় এক ছবি দেখেছিলাম ফেসবুকে। এই ছবিই উৎসাহ জুগিয়েছিল সেখানে পা ফেলার। সহকর্মী ভিডিও এডিটর সাকিব নিলয়েরও পাহাড়ে ঘোরার শখ। তাকে আগেই বলে রেখেছিলাম, এবার পাহাড়ে যাব একসঙ্গে। তাই পরিকল্পনাও এগোল দুজন মিলে। পরে কির্সতংয়ের চূড়ায় ওঠার সে পরিকল্পনার সঙ্গে যুক্ত হলো চারুকলার ছাত্রী সামিরা কামিল।
কির্সতং নিয়ে অল্পবিস্তর তথ্যও জানা গেল। এই পাহাড়ের অবস্থান বান্দরবানের চিম্বুক রেঞ্জে। কির্সতং নামটি এসেছে মূলত ‘কিরসা’ এবং ‘তং’ শব্দ থেকে। ‘কিরসা’ হচ্ছে একধরনের ছোট পাখি। মারমা ভাষায় ‘তং’ অর্থ পাহাড়। কির্সতং—যে পাহাড়ে ছোট ছোট পাখি উড়ে বেড়ায়। এই ছোট পাখি উড়ে বেড়ানো পাহাড়ের উচ্চতা প্রায় ২ হাজার ৯৫০ মিটার।
সব ঠিকঠাক। রাত ১০টায় বাস। বাস ছাড়বে ঢাকার কল্যাণপুর থেকে। সে রাতে আমি, নিলয় কাউন্টারে যথাসময়ে হাজির। কিন্তু সামিরা কামিলের কোনো খোঁজ নেই। এদিকে বাসের কাউন্টার থেকে বারবার এসে তাগাদা দিচ্ছিল। সে তাগাদা একসময় চিৎকার পর্যন্ত পৌঁছাল। ১৫ মিনিট পেরিয়ে যাওয়ার পর বাসের লোকজন জানিয়ে দিল, ‘সময় ও স্রোতের মতো বাসও কারও জন্য অপেক্ষা করে না।’ মহা বিপত্তি! এরও ৫ মিনিট পর কামিল ফোনে জানাল, সে কল্যাণপুরে। নিলয় গেল কামিলকে আনতে। নিলয় ১০ মিনিট পর বিধ্বস্ত বদনে এসে জানাল, কামিল আসলে শ্যামলীতে দাঁড়িয়ে আছে! এরপর আমাদের দুজনের দিকে বাসচালক রীতিমতো সুপার ভিলেনের মতো কটমট করে তাকিয়ে গাড়ি চালানো শুরু করলেন। মনে মনে পুরো বাসের যাত্রীরা যে আমাদের গোষ্ঠী উদ্ধার করেছে, তা আপাতত না ভাবাই শ্রেয়।
পরদিন ভোরে কক্সবাজারের চকরিয়া বাসস্ট্যান্ডে নামলাম। সেখানে নাশতা সেরে চান্দের গাড়ির ছাদের ওপরে উঠে বান্দরবানের আলীকদম উপজেলার দিকে রওনা হয়ে গেলাম। পাহাড়ের বুক চিরে এলোমেলো রাস্তা আর মাথার ওপরে মেঘের আনাগোনা দেখতে দেখতে কখন যে আলীকদম পৌঁছে গেলাম, বুঝতেই পারিনি।
টানা কয়েক দিন স্থানীয় পাহাড়িদের বাসায় থাকতে হবে। তাঁদের খাবারের সঙ্গে যেহেতু আমাদের অভ্যস্ততা নেই, তা ছাড়া গহিন পাহাড়ে হাঁটতে হবে তিন দিনের মতো, তাই তিনজনের খাবার আর বেশ কিছু প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে নিলাম। এরপর বাইকে আলীকদম–থানচি রাস্তা ধরে যেতে হলো আরও ১৭ কিলোমিটার। আমার দেখা বাংলাদেশের সবচেয়ে সুন্দর রাস্তা হচ্ছে এটি। কী নেই রাস্তার চারপাশে? দুই পাশ জুড়ে নানা উচ্চতার পাহাড়, দূরে পাহাড়ের গা দিয়ে বেয়ে পড়া নাম না জানা ছোট ছোট ঝরনা, ভয় ধরানো উঁচু-নিচু বাঁক। কী ভয়ানক সৌন্দর্য সেসবে!
সেদিন ১৭ কিলোমিটার নামে এক জায়গায় গিয়ে পূর্বপরিচিত রাংকিতের বাসায় গিয়ে ব্যাগ রেখে গাইড নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম পাশের ঝরনা দেখতে। এর মধ্যে শুরু হয়েছে অঝোর ধারায় বৃষ্টি। ঝরনা দেখতে যেতে হলে একটি ঝিরিপথ আর তিনটি মাঝারি মাপের পাহাড় পাড়ি দিতে হবে। বৃষ্টির কারণে পাহাড়ি পথ এত পিচ্ছিল হয়ে পড়েছে যে আমাদের হাঁটতে রীতিমতো যুদ্ধ করতে হচ্ছে। কোনোভাবেই পা আটকিয়ে রাখা যাচ্ছিল না। অনেক কষ্টে পাহাড়ে নেমে যখন ঝিরিপথের কাছে পৌঁছালাম, আমাদের চক্ষু তো চড়কগাছ! একি, ঝিরিপথ তো রীতিমতো ভরা বর্ষায় স্রোতস্বিনী নদী হয়ে বয়েছে। আমি আর কামিল সাঁতার পারলেও নিলয় সাঁতারের ‘স’–ও পারে না। আমার কাছে হ্যামক ছিল, শেষে বুদ্ধি করা হলো নিলয়ের কোমরে হ্যামকের দড়ি বেঁধে তাকে পার করিয়ে নেব। এরপর কয়েকটা পাহাড়–জঙ্গল পার হয়ে যখন সামনে শেষ ঝিরিপথটা পড়ল, তা দেখে তিনজনেরই আত্মারাম খাঁচাছাড়া অবস্থা। পাহাড়ি ঢলের কারণে পুরো ঝিরিপথ তখন যেন পদ্মার আকার ধারণ করেছে। শেষমেশ সেদিন ঝরনা না দেখেই ফিরতে হয়েছিল।
সেদিন রাতে রাংকিতের বাসায় থেকে পরদিন সকালে রওনা দিলাম আমাদের লক্ষ্যে। তবে কির্সতং যেতে আপাতত গন্তব্য পাহাড়ি গ্রাম খেমচং পাড়ায়। এই পাড়ায় রাতটা কাটিয়ে পরদিন সকালে কির্সতংয়ের চূড়ায় উঠব। গাইড ঠিকঠাক বলতেও পারছিলেন না আসলে কতক্ষণ হাঁটতে হবে। সকাল ১০টায় হাঁটা শুরু করে খেমচং পাড়ায় পৌঁছাতে সেদিন প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেল। আমাদের ধারণা হলো, গাইড ঠিকঠাক রাস্তা চিনতেন না। তাই যখনই তাঁকে জিজ্ঞেস করছিলাম কতখানি হাঁটতে হবে, তিনি সব সময় বলছিলেন, ‘আর বিশ মিনিট’। যখন খেমচং পাড়ার দেখা পেলাম, তখন আমাদের গাইড খুশিতে রীতিমতো গান শুরু করে দিলেন। ততক্ষণে ক্ষুধায় আর জোঁকের কামড়ে আমাদের শরীরের অবস্থা যায় যায়।
পরদিন আর এই গাইড নিয়ে কির্সতং যাওয়ার সাহস করলাম না। কে জানে, শেষে ওকেই আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে এগিয়ে যেত হয় কি না! খেমচং পাড়া থেকে নতুন গাইড নিলাম। নাম তাঁর ডন। সকাল সকাল যাত্রা শুরু হলো। উঠতে হবে ২ হাজার ৯৫০ মিটার, পথে হাজার হাজার জোঁক, মাছি যেন ওত পেতে আছে। কির্সতং পাহাড়কে ঘিরে রয়েছে একটি বন। এই বনে বসবাস হরেক প্রজাতির বিলুপ্তপ্রায় পশু–পাখি ও প্রাণীর। বনের গাছগুলোকে দেখেই বোঝা যায়, এটি হাজারখানেক বছরের পুরোনো। আমরা হেঁটে চলছি সেই হাজার বছরের পুরোনো জঙ্গলের মধ্য দিয়ে। কিছুক্ষণ পরপর থেমে পায়ে শরীরে লেগে থাকা জোঁক হাত দিয়ে টেনে টেনে ছাড়াচ্ছি। এর মধ্যে শুরু হলো বৃষ্টি। বৃষ্টি শুরু হওয়ার পরই যে পুরে পরিবেশটা বদলে গেল। সাধারণ একটা পাহাড়ি জঙ্গল থেকে সেটা নিমেষেই হয়ে গেল মায়াময়, অসম্ভব সুন্দর স্বর্গ টুকরো। এই দৃশ্য দেখার জন্যই টানা দুদিন হেঁটেছি। ততক্ষণে আমাদের শরীরে অসংখ্য জোঁক, মাছি, মৌমাছি নিজেদের চিহ্ন রেখে চলেছে। বৃষ্টির কারণে পাহাড়ের মাটি হয়ে গেছে ভয়ানক পিচ্ছিল। পা ফেলছি এক জায়গায়, পা পিছলে যাচ্ছে আরেক জায়গায়। মাঝেমধ্যে এমন সব খাড়া অংশ পড়ল, তা পাড়ি দিতে হলো সতর্ক হয়। একটু এদিক-ওদিকে পা দিলেই সোজা পাহাড়ের নিচে। কিন্তু সেগুলো থোড়াই কেয়ার করে চলছি আমরা। যদি পথেই এত মায়া রেখে থাকে কির্সতং, তাহলে ওপরে কী মায়া আর সৌন্দর্যটাই না জমিয়ে রেখেছে।
বেলা ১১টায় আমরা কির্সতং চূড়ায় পা দিলাম। তখন শুধু চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা করছিল, ‘তুমি অনেক সুন্দর, প্রিয় বাংলাদেশ। কী সৌন্দর্যটাই না লুকিয়ে রেখেছ তোমার ভাঁজে ভাঁজে। সার্থক তোমার কোলে জন্ম নিয়ে প্রিয় মা।’
যেভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে প্রথমে কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলায় যেতে হবে। সেখান থেকে চাঁদের গাড়িতে আলীকদম। ভাড়া নেবে ৭০ টাকা। আলীকদমে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ক্যাম্প থেকে অনুমতি নিতে হবে। এরপর পানবাজার থেকে মোটরবাইক নিয়ে চলে যেতে হবে ১৭ কিলোমিটার এলাকায়। এখানে এক দিন থাকতে হবে। অলস সময় না কাটিয়ে আশপাশের ছোট ছোট ঝরনা দেখা যেতে পারেন। পরদিন সকালে উঠেই পায়ে হেঁটে পথ ধরুন ‘খেমচং’ পাড়ার। খেমচং পাড়া কির্সতং পাহাড়ের নিচের একটি পাড়া। এই খেমচংয়ে রাতটুকু কাটিয়ে ভোর নাগাদ কির্সতং অভিযান শুরু করুন।আরও কিছু কথা—পাহাড়ি যাত্রায় অবশ্যই সঙ্গে একজন স্থানীয় গাইড নেবেন। প্রায় পুরো রাস্তায় ট্রেক অর্থাৎ পাহাড়ে হেঁটে হেঁটে যেতে হবে, সেই মানসিক প্রস্তুতি যেন থাকে। পাহাড়ে কিংবা ঝরনায় বিস্কুটের প্যাকেট, পানির বোতল ইত্যাদি ফেলবেন না।