কাছে গেলে বাবা বলত, ‘আপনি কে?’

আজ জুন মাসের তৃতীয় রোববার, বাবা দিবস। বিশেষ এই দিন উপলক্ষে পাঠকের কাছে লেখা আহ্বান করেছিল গোদরেজ প্রটেক্ট ম্যাজিক হ্যান্ডওয়াশ ও প্রথম আলো অনলাইন। ‘বাবা, তোমাকে বলা হয়নি’ শিরোনামে বিপুলসংখ্যক পাঠক লিখেছেন তাঁদের মনের কথা। নির্বাচিত লেখাগুলোর একটি প্রকাশিত হলো এখানে।

বাবার সঙ্গে লেখক

মনের কথা কাউকে না বলতেই আমি ভালোবাসি। এই না বলা যে একদিন আমার ঘুম কেড়ে নেবে, জানতাম না। বাবাকে কত কথা বলা হয়নি আমার। জীবনকে উপভোগের সব মন্ত্র ছিল তোমার জানা। ভীষণ হাসিখুশি, প্রাণবন্ত, মিশুক একজন মানুষ ছিলে তুমি। তবু বাবা তো, কোথায় যেন একটা ভয়, সংকোচ, দ্বিধা। মনে হতো ভালো তো বাসিই; মুখে আবার বলতে হয় নাকি! তাই কখনো বলা হয়নি; তুমিই আমার স্বস্তির জায়গা, তুমিই ছিলে আমার বটগাছ।

সংসারের কোনো ব্যাপারে তোমার মুখভার কোনো দিন দেখিনি। সেই যেদিন দামি ফোনটা হারিয়ে বাসায় ফিরলে; আমি বললাম, তোমার মোবাইল কই? হাসিভরা মুখে বললে আছে কোথাও। খেতে ভীষণ ভালোবাসতে। ডায়াবেটিসের জন্য মিষ্টি খাওয়ার নিষেধাজ্ঞাটা মানলে না কোনো দিনই। মাকে লুকিয়ে ফ্রিজ থেকে মিষ্টি খাওয়ার সময় ধরা পড়লে সে কী হাসি তোমার! সব ভালোই চলছিল। হঠাৎ কীভাবে যেন আকাশের রংটা কেমন বদলে গেল।

২০২০ সালের জুন মাসে হঠাৎ তোমার শরীরটা ভীষণ খারাপ হয়ে পড়ল। ডাক্তার জানালেন, কিডনি দুটো আর ধকল সামলাতে পারছে না। আমি তখন করোনা পজিটিভ, ঘরবন্দী দিন কাটে আমার। প্রথম যেদিন ডায়ালাইসিস হলো, তখনো করোনা নেগেটিভ হইনি। ভিডিও কলে দেখলাম ডায়ালাইসিস রুম থেকে বের হলে। খুব আত্মবিশ্বাসীভাবে বললে, ‘চিন্তা নেই রে। তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যাব।’

সপ্তাহে দুটো করে ডায়ালাইসিস চলছিল। প্রতি সপ্তাহে ভাবতাম, এবার বুঝি দুটো থেকে কমে একটা হবে। একসময় আর লাগবে না। কিন্তু ডায়ালাইসিস কমল না, আমাদের যুদ্ধও চলতে থাকল। এর মধ্যেই এল তোমার জন্মদিন—জুলাইয়ের ৫ তারিখ। আমার খুব মনে হতো, আমার জন্মদিন হয়; বাড়ির আর সবার হয়, তোমার তো হয় না। তাই জন্মদিন পালনের সিদ্ধান্ত নিলাম। বাসার সবাই খুব লুকোচুরি করে সব গোছালাম। প্রথম যখন দেখলে তোমার জন্য এত বেলুন, মোমবাতি, এত আয়োজন করেছি; খুশিতে কেঁদে ফেললে। জীবনের সবচেয়ে আনন্দের মুহূর্তগুলোর একটি সেদিনের নামে আমার মনে তোলা রইল।

এরপর তোমার করোনা ধরা পড়ল। তোমাকে বলিনি, পাছে মনোবলটা হারিয়ে ফেলো। আমার সেই দাপুটে বাবাটা ছোট্ট বাবা হয়ে গেল। অকারণে হাসতে, অকারণে কাঁদতে। আমাকে ঠিকমতো চিনতে পারতে না। কাছে গেলে বলতে, ‘আপনি কে?’ রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে তোমার গায়ে পাউডার দিয়ে, স্প্রে করে, ঠোঁটে লিপজেল দিয়ে, ক্রিম হাত-পায়ে মাখিয়ে দিতাম। কত খুশি হতে তুমি। এত অসুখও তোমার হাসিটুকু কেড়ে নিতে পারেনি কোনো দিন।

একেবারেই মাংস খেতে চাইতে না। অথচ শরীরে প্রোটিন দরকার। বাধ্য হয়ে ডিম খাওয়াতাম। তা-ও খেতে চাইতে না। বলতে, আমার ভালো লাগে না এসব খেতে। যখন গিয়ে পাশে দাঁড়াতাম, ভয়ে ভয়ে খেয়ে নিতে। ভাবতে আমি বুঝি রেগে যাব। কষ্ট হতো খুব, তবু আনন্দ পেতাম এই ভেবে যে বাবা বলে ডাকতে তো পারছি।

শরীর বেশি খারাপ হওয়াতে তোমাকে হাসপাতালে ভর্তি করালাম। ঠিক করলাম সুস্থ হওয়া পর্যন্ত সেখানে রাখব। অন্যান্য দিন ডায়ালাইসিসের সময় তোমাকে খাইয়ে দিই, কত গল্প করি। এদিন ভর্তি করিয়ে মনে ভীষণ আশা নিয়ে অপেক্ষা করছিলাম, একদম সুস্থ হলে তোমাকে নিয়ে বাসায় ফিরব।

সে স্বপ্ন আর পূরণ হলো না। তোমায় নিয়ে ফিরলাম সেদিন বিকেলেই। তবে তুমি আর কথা বললে না। যাওয়ার আগে দুবার আমার নাম ধরে ডাকলে, ‘জয়ীতা, জয়ীতা’। এরপরই আমার জীবনের সব আনন্দ, আমার পুজো, আমার উচ্ছ্বাস, আমার জন্মদিন, আমার সবকিছু অর্থহীন হয়ে গেল। তোমার উচ্চারিত শেষ শব্দ—‘জয়ীতা’, এই আমার পরম পাওয়া হয়ে রইল। হারিয়ে গেল তোমায় না বলা কত কথা, কত অনুভূতি। শুধু পড়ে রইলাম আমি, তোমার জয়ীতা।