কৈশোরের সেই জগৎ
হয়তো এখন আর সে চর্চাটা খুব বেশি নেই। খুদে বার্তা, মেসেজিং, মুঠোফোন কিংবা আধুনিক অন্যান্য গ্যাজেটনির্ভর আবেগ ভাগাভাগির এ যুগে কৈশোরের সে ‘নিষিদ্ধ’ জগৎ পাণ্ডুর মতোই বিবর্ণ হয়ে গেছে। সে নিষিদ্ধ জগতে চকলেট ছিল, দশ পয়সা দামের আইসক্রিম ছিল, ধমক ছিল, কানমলা ছিল, ভুভুজেলা নয়, ভেঁপু ছিল। কিন্তু সবকিছুই ছিল ফল্গুধারার মতো অন্তঃসলিলা, ভেতরে-ভেতরে।
কিশোর বেলার সেই ‘আন্ডারওয়ার্ল্ডের ডন’ ছিল কিশোরেরাই। যত বড় ডাকসাইটে বড় ভাই বা বোনই হোক না কেন, ‘বাবাকে দিয়ে দেব’ বলে হুংকার ছাড়ার ক্ষমতা ছিল বাড়ির কিশোর বা কিশোরীর। আর তার মোক্ষম অস্ত্র ছিল একখণ্ড কাগজ—যার নাম চিঠি। সে ‘নিষিদ্ধ’ জগতে ছিল সাদা কাগজে চিঠি লেখা দেখে ফেলবার দুর্দমনীয় আকাঙ্ক্ষা, নীল খামের ভেতরে ধুকপুকে রোমান্টিকতা পাচার করার দুঃসাহস। সে জগৎ ছিল নীল বা হলুদ খামের ভেতর গোলাপের পাপড়ি আটকে রেখে ‘না দিলে তোর বাবাকে বলে দেব’ বলে জোর করে টিফিনের টাকা ছিনতাইয়ের মতো ঘটনাবহুল। আর সবকিছুর মূলে ছিল সেই একখণ্ড কাগজ, রং তার যাই হোক।
বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সূত্রপাত
আমাদের জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সূচনাই হয় কাগজের হাত ধরে। গাদা গাদা বই, তা–ও ছাপা হয় কাগজে। হাতের লেখা ভালো নাকি খারাপ, সেটা প্রমাণের একমাত্র গ্রহণযোগ্য মাধ্যম কাগজ। কিশোর বয়সের পরেই বছরে তিনটি পরীক্ষা দেওয়ার যন্ত্রণাময় অধ্যায়ের সূচনা। সে যন্ত্রণার মূল কারণ কাগজ— পরীক্ষার খাতা যার নাম। পরীক্ষার খাতার সঙ্গে পিন দিয়ে আটকানো যে গাদাগাদা ‘লুজ শিট’, যার পরিমাণের ওপর নির্ভর করে নির্ণয় হতো ভালো ছাত্রের ক্যাটাগরি, তা–ও কিন্তু কাগজের তৈরি। সনদ আর প্রশংসাপত্র কাগজের তৈরি, টাকা কাগজের তৈরি।
এই হলো কাগজ, এই হলো তার ক্ষমতা। জন্ম থেকে মৃত্যু, বিত্ত থেকে বৃত্ত, উচ্ছেদ থেকে আবাসন, দৃশ্যমান কিংবা অদৃশ্যভাবে আমাদের জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা এক অমোঘ নিয়ামকের নাম কাগজ। সে জন্য বলা হয়, পেনিসিলিন, রকেট, কম্পিউটার, ইন্টারনেট ইত্যাদির আগে পৃথিবীকে একঝটকায় সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিল মানুষের যে উদ্ভাবন, তার নাম কাগজ। নইলে শত শত বছর ধরে প্রজন্মের পর প্রজন্ম যে জ্ঞান ধারাবাহিকভাবে আমাদের মাঝে ছড়িয়ে পড়েছে, তার অনেকখানিই রক্ষিত হতো না, হয়তো।
আবিষ্কারের গল্প
সব কাজের কাজি যে চীন দেশ, সেই দেশের হান সাম্রাজ্যের চাই লুন নামের এক ব্যক্তি ১০৫ সালে কাগজ আবিষ্কার করেন। সেই কাগজ এখনো রয়ে গেছে। যদিও এখন কাগজহীন পৃথিবীর কথা ভাবা হচ্ছে। এই কাগজ ও হীন জোড়া শব্দের মধ্যে জড়িয়ে আছে কাগজ তৈরির উপাদানের ইঙ্গিত। সে প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে বলে রাখি, চাই লুনেরও আগে তৈরি কাগজের কথা বলছেন গবেষকেরা। তাঁদের বক্তব্য, ‘পেপার’ শব্দটি প্যাপিরাস নামক উদ্ভিদ থেকে এসেছে। ব্যাবিলনিয়ান এবং তারপর মিসরীয়রা এই প্যাপিরাসে তৈরি পেপার ব্যবহার করতেন আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ৩ হাজার বছর আগে। এ ছাড়া গ্রিক এবং রোমানরাও প্যাপিরাসে তৈরি পেপার ব্যবহার করতেন। তবে যাই হোক, ব্যাপারটাকে সরল করে বলা যায়, হয়তো পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্নভাবে পেপার বা কাগজ তৈরির প্রক্রিয়া সচল ছিল স্থানীয়ভাবে। এ বিষয়টি জনপ্রিয় হয় চাই লুনের উদ্ভাবিত কাগজের তৈরির প্রক্রিয়ার হাত ধরে। তারপর এটি ছড়িয়ে পড়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে। চীন দেশ থেকে এটি ৬১০ সালের দিকে কোরিয়া ও জাপানে ছড়িয়ে পড়ে। আরবের বণিকেরা চীন দেশে কাগজ তৈরি করা শেখে অষ্টম শতকে। তারপর কাগজ তৈরির করণকৌশল ছড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন দেশে।
কেন কাগজের প্রয়োজন হয়েছিল? মূলত সিল্কের খরচ বাঁচাতে। চাই লুনের কাগজ তৈরির আগে চীনারা লেখালিখি করত একধরনের রেশমের কাপড় এবং বিশেষভাবে তৈরি বাঁশের বাতার ওপর। রেশমের কাপড় বরাবরই ছিল দামি জিনিস আর বাঁশ শক্ত। এ কারণে একটা বিকল্প ব্যবস্থা তৈরির প্রয়োজন হয়েছিল চীনাদের। সেই প্রয়োজন সামনে রেখেই একসময় তৈরি হয় কাগজ। অনেক পরে, আনুমানিক ১৩ শতকে ইউরোপে কাগজ তৈরি শুরু হয়। তারপর তাদের হাতেই কাগজ তৈরির যান্ত্রিক পদ্ধতির বিকাশ হয়।
কাগজ তৈরির মূল উপাদান তন্তুজাতীয় বস্তু। এটি হতে পারে উদ্ভিদ কিংবা অন্য কিছু। কাগজ তৈরির সেলুলোজের প্রাথমিক উৎস কাঠ। বিশেষ করে আঁশযুক্ত উদ্ভিদ। বাঁশ, মালবেরি বা তুঁতগাছ ও প্যাপিরাস উদ্ভিদ থেকে বিশেষভাবে মণ্ড তৈরি করে যান্ত্রিক উপায়ে চাপ প্রয়োগ করে তারপর তৈরি করা হয় কাগজ। বর্তমানকালের স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রে কাগজ তৈরি শুরু হওয়ার আগে হাতেই বানানো হতো এটি। এখনো যে হাতে কাগজ তৈরি হয় না, তা নয়। তবে তা খুবই সীমিত। আমরা সচরাচর যে কাগজ ব্যবহার করি, সেগুলো কারখানায় তৈরি বলে টনের পর টন কাগজ দেখতে একই রকম। কিন্তু হাতে বানানো কাগজের প্রতিটি শিট আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্যের। এই হাতে বানানো কাগজের দামও বেশি।
হাতে বানানো কাগজের সূত্রে একটি তথ্য উল্লেখ করে রাখি। আমাদের দেশে বিভিন্ন জায়গায় ‘কাগজি’ পাড়া নামে কিছু গ্রামের নাম পাওয়া যায়। কাগজ তৈরি এবং এর ব্যবসা যারা করত, তারা পরিচিত ছিল কাগজি নামে। এই কাগজিরা যেসব গ্রামে বসবাস করত, সে গ্রামগুলোর নাম ছিল কাগজি পাড়া। এর প্রমাণ পাওয়া যায় ষোড়শ শতকের বাংলায় কবি মুকুন্দ রামের লেখা থেকে। তিনি বলেছেন, ‘কাগজ কাটিয়া নাম ধরিল কাগতী।’ এই কাগতীরাই আসলে কাগজী বা কাগজি—কাগজ তৈরি এবং বিক্রিই ছিল তাদের পেশা। তবে সব কাগজি পাড়াতেই যে কাগজ তৈরি হতো, তা বলা যায় না। কাগজিলেবুর নাম থেকেও অনেক গ্রামের নাম কাগজি পাড়া হয়েছে।
ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে বাংলাদেশে
প্রাচীন ভারতের মানুষ লিখত কীসের ওপর? সে এক ব্যাপারই ছিল বটে। দুই ধরনের লেখার জিনিস পাওয়া যায় মোটের ওপর। পাথর, ধাতু এবং শক্ত খোলস এগুলো হলো লেখার ‘হার্ড ম্যাটেরিয়াল’। ইতিহাসের বই পড়লেই পাওয়া যায়, বিভিন্ন রাজা কোথাও তাম্রফলকে কিছু লিখে গেছেন নয় তো পাথরে কিছু লিখে গেছেন। পুরো পৃথিবীতেই লেখার জন্য আরও ব্যবহৃত হতো কাঠের বোর্ড—যেগুলোকে পাতি বলা হতো, ধুলি, ভূর্জপত্র, তালপাতা, চামড়া, সুতির কাপড়, যাকে বলা হতো কার্পাসিকা পাতা। এগুলোর বেশ পরে এসেছে কাগজ। লেখার উপাদান হিসেবে কাগজের নাম ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষ ১১ শতকের আগে খুব একটা শোনেনি। এ উপমহাদেশে প্রথম কাগজের কারখানা তৈরি হয় সুলতান জয়নুল আবেদিন বা শাহি খানের হাতে, কাশ্মীরে। সময়টা পনেরো শতকের শুরুর দিকে। এ ঘটনাটি জড়িয়ে আছে মধ্য এশিয়ার সমরখন্দের সঙ্গে। সেটা অন্য গল্প। এরপর খুব দ্রুতই লেখার মাধ্যম হিসেবে কাগজের সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। অল্প কিছুদিনের মধ্যে পাঞ্জাবের সিয়ালকোট, অযোধ্যার জাফরাবাদ, পাটনার বিহার শরিফ, গয়া, বাংলার হুগলি ও মুর্শিদাবাদ, গুজরাটের আহমেদাবাদ ও খাম্বাট এবং দক্ষিণ ভারতের মাইসোর ও আওরঙ্গবাদে গড়ে ওঠে মধ্যযুগের ভারতের কাগজ তৈরির কেন্দ্রগুলো।
ঐতিহাসিক তথ্যসূত্রগুলো জানাচ্ছে, মোগল আমলে এই উপমহাদেশে হাতে তৈরি কাগজের ব্যাপক বিস্তার ঘটে। সে সময় তৈরি হতে থাকে আফসানি, বাহাদুরখানি, মাধাগরি ইত্যাদি নামের কাগজ। এসব কাগজের বেশির ভাগ ব্যবহার হতো মূলত তখনকার সরকারি কাজে। রাজরাজড়াদের ব্যাপার তো, তাই কখন কখন এসব কাগজ তৈরির সময় ব্যবহার করা হতো সোনার মতো মূল্যবান ধাতু। যেমন, আফসানি কাগজ তৈরির সময় ব্যবহার করা হতো সোনার গুঁড়া এবং সোনার সরু পাত!
আমাদের এ অঞ্চলে তুলট কাগজের খ্যাতি ছিল। শণ, তুলা, তিসির তন্তু, ছেঁড়া কাপড় ইত্যাদি দিয়ে তুলট কাগজ তৈরি করা হতো। এগুলো আকারে বড় করে তৈরি করে প্রয়োজনীয় পরিমাপে কেটে নেওয়া হতো। এখন আর তুলট কাগজের প্রচলন নেই।
কাগজ তৈরির কেন্দ্রগুলোর দুটি যেহেতু বাংলার হুগলি ও মুর্শিদাবাদে ছিল, তাই সেখান থেকে কাগজ তৈরির প্রক্রিয়া ছড়িয়ে পড়া খুবই স্বাভাবিক। পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে কাগজ তৈরির কারখানা বসানো হয়। এগুলোর কোনো কোনোটি বন্ধও হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। দেশে কর্ণফুলী পেপার মিল, খুলনা নিউজপ্রিন্ট মিল এবং পাবনায় নর্থ বেঙ্গল পেপার মিল বা পাকশী পেপার মিল স্থাপন করা হয় সরকারি উদ্যোগে। এ ছাড়া সিলেটেও একটি পেপার মিল রয়েছে। কর্ণফুলী, খুলনা বা নর্থ বেঙ্গল পেপার মিলে সাধারণত ব্যবহৃত হয় বাঁশ, সুন্দরবনের গেওয়া কাঠ ও আখের ছোবড়া। সিলেটে প্রতিষ্ঠিত মণ্ড মিলে ব্যবহৃত হয় ঘাস। তবে সিলেটের মণ্ড মিলটিও বাঁশ ও শক্ত কাঠ ব্যবহার করছে। বর্তমানে দেশে বেসরকারি পর্যায়ে ৫৫টি কাগজ কল রয়েছে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো বসুন্ধরা পেপার মিল, সোনালি পেপার মিল, হাশেম পেপার ও পাল্প মিল, হোসেন পেপার মিল, পার্ল পেপার অ্যান্ড বোর্ড মিলস, সাদেক পেপার মিল ইত্যাদি। এসব আধুনিক কাগজ তৈরির কারখানায় প্রধানত আমদানি করা রাসায়নিক মণ্ড ব্যবহার করে উন্নত মানের কাগজ তৈরি করা হয়। আবার এখানে পুরোনো কাগজকে পুনরায় মণ্ডে রূপান্তর করে কাগজ তৈরির ব্যবস্থাও রয়েছে। লেখার কাগজ, ছাপার কাগজ, নিউজপ্রিন্ট এবং প্যাকেজিং জাতীয় কাগজ মূলত এই চার ধরনের কাগজ উৎপন্ন হয় বাংলাদেশে।
সহায়তা:
১. ললিত তিওয়ারি, হিস্ট্রি অব পেপার টেকনোলজি ইন ইন্ডিয়া। ইনফিনিটি ফাউন্ডেশন ডটকম।
২. তৃষ্ণা বসাক, আমার বই-দগ্ধ জীবন।
৩. বাংলাপিডিয়া, উইকি বুকস।