বাসন্তী রেমা
বাসন্তী রেমা

ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর বাসন্তী রেমা

কলাবাগান হারিয়েছেন, ঋণ শোধ দেবেন কি করে

মধুপুর গড়ের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর বাসন্তী রেমা। ঋণ করে জমিতে কলাগাছ লাগিয়েছিলেন। বন বিভাগের লোকজন তাঁর সে কলাবাগান কেটে ফেলেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে বাসন্তীর সে ছবি হয়তো অনেকের নজরেও পড়েছে। বন বিভাগের দাবি, এ জমি তাদের। বাসন্তীরা বংশপরম্পরায় এ জমি চাষ করেছেন। এভাবে কলাবাগান কাটায় বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে মধুপুরের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষ। সেই সঙ্গে মানসিক চাপের মধ্যে আছেন বাসন্তীর মতো অনেক নারী। কারণ, মধুপুর গড় এলাকার মাতৃতান্ত্রিক গারো সমাজে নারীরাই জমির মালিক। তাঁদের মধ্যে দেখা দিয়েছে উচ্ছেদ আতঙ্ক।

টাঙ্গাইলের মধুপুর গড় এলাকার ৪৫টি গ্রামে প্রায় ২০ হাজার ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষের বসবাস। এঁদের মধ্যে ১৬ হাজারের বেশি গারো। বনে বসবাস করা এসব মানুষের জমির কোনো কাগজপত্র নেই। বংশপরম্পরায় তাঁরা বনের ভেতরের জমিতে চাষাবাদ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। তাঁদের দাবি, বনের মধ্যে তাঁদের বসবাস। বনের জমির ওপর রয়েছে তাঁদের ঐতিহ্যগত অধিকার।

মধুপুর গড়ের পেগামারি গ্রামে বাসন্তী রেমার জন্ম। এ গ্রামেই তিনি বেড়ে উঠেছেন। ১৯৯২ সালে বিয়ের পর তাঁকে তাঁর মা কিছু জমি দেন। মায়ের কাছ থেকে পাওয়া জমি চাষ এবং দিনমজুরি করে বাসন্তীর দিন চলে। দুই ছেলেমেয়েকে লেখাপড়া করান। চার মাস আগে বাসন্তী ৪০ শতাংশ জমিতে ৫০০ সবরি কলার গাছ লাগিয়েছিলেন। ৬০ হাজার টাকা ঋণ করে এ বাগান করেন। এ ছাড়া তিন মাস পরিবারের কয়েকজন শ্রম দিয়েছেন বাগানে। আর কয়েক মাস পরই কলার ছড়ি বিক্রি করতে পারতেন। কিন্তু ১৪ সেপ্টেম্বর সকালে বন বিভাগের কর্মকর্তারা হাজির হন তাঁর বাগানে। ২০–২৫ জন বাগানের সব কলাগাছ কেটে ফেলেন। তাঁরা সেখানে সামাজিক বনায়নের আওতায় গাছ লাগানোর উদ্যোগ নেন। যখন কলাগাছ কাটা চলছিল, তখন বাসন্তী পাশের গ্রামে অন্যের বাগানে দিনমজুরির কাজ করছিলেন। খবর পেয়ে এসে দেখেন সব গাছ কেটে মাটিতে ফেলা হয়েছে। আশপাশের মানুষও চলে আসেন। তাঁরা বিক্ষোভ করেন। বিক্ষোভের মুখে বন কর্মকর্তারা সামাজিক বনায়নের গাছ না লাগিয়েই চলে যান। এরপর কয়েক দফায় স্থানীয় ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর লোকজন বিক্ষোভ–সমাবেশ করেন। ১৮ সেপ্টেম্বর সরেজমিন মধুপুর গড়ে বাসন্তী রেমার কলাবাগানে গিয়ে দেখা যায়, বাগানজুড়ে পড়ে আছে কলাগাছগুলো। খবর পেয়ে বাগানের পাশের বাড়ি থেকে বের হয়ে আসেন বাসন্তী রেমা। তিনি জানান, এ বাগানে তাঁর নানা-নানি চাষ করেছেন। নানি তাঁর মাকে জমিটি দেন। তাঁর মায়ের কাছ থেকে ২৭ বছর আগে তিনি পান। বাগানের উত্তর পাশেই তাঁর নানা-নানি ও বাবাকে সমাহিত করা হয়েছে। মায়ের কাছ থেকে পাওয়ার পর এ বাগানে তিনি বিভিন্ন সময় হলুদ, আদা, কচু চাষ করেছেন। এবার একটু বেশি লাভের আশায় ৬০ হাজার টাকা ঋণ করে কলা চাষ করেছিলেন। কিন্তু বন বিভাগের কর্মকর্তারা এ বাগান কেটে ফেলায় পথে বসার উপক্রম হয়েছে। এ কথাগুলো জানাতে জানাতেই কেঁদে উঠলেন বাসন্তী রেমা।

বাসন্তী রেমার কথাগুলো যখন শুনছিলাম, তখনই সেখানে আসেন পেগামারি গ্রামের দুই নারী খনিলা চাম্বুগং এবং আল্পনা ম্রং। তাঁরা জানান, কিছুদিন আগে আমলিতলা গ্রামে কয়েকজন ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষের জমির ফসল এভাবেই নষ্ট করেছেন বন বিভাগের লোকেরা। এরপর বাসন্তীর জমির কলাগাছ কাটা হলো। এখন গড়ে বসবাসরত গারো নারীরা খুবই দুশ্চিন্তায় আছেন।

বৃহত্তর ময়মনসিংহ আদিবাসী উন্নয়ন পরিষদের সভাপতি অজয় এ মৃ জানান, মধুপুরে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীদের গ্রামগুলো সংরক্ষিত বনাঞ্চল ঘোষণা করা হয়েছে। গারোদের বেশির ভাগ জমির মালিকানা নারীদের। তাই জমির ওপর কোনো আঘাত এলে নারীরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন।

এ প্রসঙ্গে কথা বলতে পাশেই বন বিভাগের দোখলা রেঞ্জ অফিসে যাই। সেখানে রেঞ্জ কর্মকর্তা আব্দুল আহাদ জানান, বাসন্তী রেমা যে জমি তাঁর বলে দাবি করছেন, আসলে এটা বন বিভাগের জমি। বাসন্তী শহীদ নামের এক ব্যক্তির কাছে জমিটি লিজ দিয়েছিলেন। বন বিভাগের জমি তাঁর লিজ দেওয়ার কোনো এখতিয়ার নেই। তাই কলাগাছ কেটে সেখানে বনায়ন করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বাসন্তী রেমার পক্ষের লোকজনের বাধার কারণে বনায়ন করা যায়নি।

তবে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর নারীদের সংগঠন আচিকমিচিক সোসাইটির সভাপতি মালতি নকরেক জানান, এ এলাকার গারোদের ঐতিহ্যগতভাবে ভূমির প্রতি অধিকার রয়েছে। বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে গারোদের উচ্ছেদের চেষ্টা করা হয়েছে।