করোনাকালে পরিবারের সদস্যদের সুস্থতা নিয়ে চিন্তা, কাজের চাপসহ বিভিন্ন কারণে বিষণ্নতার বলয়ে ঘুরপাক খাচ্ছেন নারীরা।
করোনাকাল সবার দুয়ারে একই রকম বা ভিন্ন রকম দুর্ভোগের বার্তা নিয়ে কড়া নেড়ে যাচ্ছে। কম-বেশি সবার ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক মন্দার শিকার হওয়ার আঁচ দিয়ে যাচ্ছে। এতে একেকজনের একেক রকম প্রতিক্রিয়া। তবে হতাশা-বিষণ্নতার বলয়ে সবচেয়ে বেশি ঘুরপাক খাচ্ছেন নারীরা।
মনস্তত্ত্ববিদদের মতে, করোনাকালের বিষণ্নতায় নারীদের আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা অনেক বেশি ঘটছে। পরিবার, সন্তান, স্বজন বা পরিচিতজনদের নিয়ে উৎকণ্ঠা-উদ্বেগ থেকে নারীরা বিষণ্নতায় ভুগছেন। চারপাশের পরিস্থিতি নারীদের মধ্যে এক ধরনের নিরাপত্তাহীনতা ও অনিশ্চয়তার বোধ তৈরি করেছে।
১২০ বছরের পুরোনো নেদারল্যান্ডসভিত্তিক বনেদি প্রকাশনা সংস্থা এলসেভিয়ারের অনলাইন সাময়িকী ‘হেলিয়ন’-এ মে মাসে বাংলাদেশে কোভিড-১৯ মহামারি, আর্থসামাজিক সংকট ও মানুষের দুশ্চিন্তা নিয়ে এক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন ও বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক এবং বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের একজন প্রতিনিধির তৈরি গবেষণা প্রতিবেদনটি বলছে, করোনাভাইরাসের বিস্তারে বাংলাদেশে আর্থসামাজিক সংকটের পাশাপাশি মানসিক উদ্বেগও দেখা গেছে। কোনো মৌলিক চাহিদা পূরণের ব্যবস্থা না করেই লকডাউন কার্যকর করার কারণেই এটা হয়েছে। স্বাস্থ্যব্যবস্থার দুর্বলতা এই উদ্বেগ আরও বাড়িয়েছে। চিকিৎসক, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ব্যাংক কর্মকর্তা, সরকারি কর্মকর্তা, তরুণ-তরুণীসহ ১ হাজার ৬৬ জন এ গবেষণার জরিপে অংশ নেন। এতে নারী অংশগ্রহণকারী ছিল ৩ দশমিক ২ শতাংশ। গবেষণার তথ্যের বিষয়টি প্রথম আলোকে নিশ্চিত করেছেন এতে যুক্ত বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আবু রেজা মো. তৌফিকুল ইসলাম।
মনস্তত্ত্ববিদ ও জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মোহিত কামাল জানান, এই সময়ে বিষণ্নতায় ভুগছেন এমন অনেক নারীকে তিনি শুরুতে ফোনে এবং এখন চেম্বারে ও হাসপাতালে পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন। তিনি বলেন, পরিবার ঘিরে নারীদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা সব সময় বেশি কাজ করে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে নারী-পুরুষ কর্মী ছাঁটাই হচ্ছে। অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের চিন্তায় বিষাদে আক্রান্ত হচ্ছেন পরিবারের নারী সদস্যরা। অনেকে ঋণ শোধ করতে পারছেন না। সন্তানদের লেখাপড়ার ব্যাঘাত ঘটছে, টিকার সময় পার হচ্ছে—এ নিয়ে মায়েরা শঙ্কায় রয়েছেন। এ থেকেও তাঁরা বিষণ্নতায় ভুগছেন। অনেকের স্বামী, সন্তান, ভাইবোন স্বাস্থ্যকর্মী, পুলিশ, সাংবাদিক বা ফ্রন্ট লাইনার। তাঁদের স্বাস্থ্যঝুঁকির চিন্তাতেও নারীরা বিষাদে আক্রান্ত হচ্ছেন।
‘আমি একটু ঘুমাতে চাই’
দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ দেখা দেওয়ার শুরু থেকেই এ-সংক্রান্ত সংবাদ সংগ্রহের দায়িত্বে থাকা একটি অনলাইনের নারী সংবাদকর্মী বললেন, ‘এক রাতে একাধিক মৃত্যুর খবর লিখে মৃত ব্যক্তিদের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলেছি। তাঁদের কান্না-শোক সহ্য করার ক্ষমতা আমার ছিল না।’
এই নারী সাংবাদিক বললেন, ‘শুরুর দিকে হাসপাতালগুলোতে অব্যবস্থাপনা ছিল। এমনও হয়েছে, ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে ৭৫ বছরের কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত একজন রোগী এসেছেন, পুরো ঢাকা ঘুরে তিনি কোথাও ভর্তি হতে পারেননি। অ্যাম্বুলেন্সে করে ফেরত যাওয়ার সময় অ্যাম্বুলেন্সেই মারা গেছেন। স্বাস্থ্যবিট করার কারণে মৃত্যু, রক্ত, অব্যবস্থাপনা দেখার অভিজ্ঞতা আছে আমার। কিন্তু কোভিডে সব পাল্টে গেছে। মে মাসের দিকে এসব ঘটনা ব্যক্তি আমার ওপর প্রভাব ফেলতে শুরু করে। আমি ঘুমাতে পারি না, খেতে পারি না। সারা রাত বারান্দায় বসে থাকতাম। এমনও হয়েছে, পরিচিত চিকিৎসককে ফোন দিয়ে চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বলছি, আমি একটু ঘুমাতে চাই।’ চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী ওষুধ খেতে হচ্ছে এ সংবাদকর্মীকে।
আর একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত এক নারী বললেন, তাঁর সহকর্মী কয়েকজন করোনকালে ছাঁটাইয়ের শিকার হয়েছেন। অফিসে ঢুকে ওই ফাঁকা চেয়ারগুলো দেখলে তিনি চোখের পানি ধরে রাখতে পারেন না। কখন তাঁর পালা আসে, সেটা নিয়েও দুশ্চিন্তায় ভোগেন।
রাজধানীর এক মা জানালেন, তাঁর বড় সন্তান একটি বেসরকারি ব্যাংকে চাকরি করেন। করোনাকালে আয় কমে যাওয়ায় ব্যাংকটিতে ব্যয় কমানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তাঁর সারাক্ষণই ভয় লাগে, তাঁর সন্তানের চাকরি নিয়ে সংকট তৈরি হয় কি না। দুশ্চিন্তায় তিনি ঘুমাতে পারেন না, খেতে পারেন না।
আরেক নারী জানালেন, পরিবারের পাঁচ সদস্যের মধ্যে তাঁর স্বামী শুধু চাকরির প্রয়োজনে বাইরে যান। পাঁচ মাস ধরে বাসার অতিরিক্ত কাজ করতে করতে তিনি হাঁপিয়ে উঠেছেন। বললেন, ‘বাসার সহকারীকে কাজের জন্য ডাকতে চাইছি। কিন্তু সংক্রমণের ভয়ে আমার স্বামী সহকারীকে বাসায় প্রবেশ করতে দিতে রাজি নন। কিন্তু আমি সত্যি আর একা এত কাজ সামাল দিতে পারছি না। এ নিয়ে স্বামীর সঙ্গে প্রায়ই খিটিমিটি লেগে যাচ্ছে।’
চিকিৎসকসহ স্বাস্থ্যকর্মী, পুলিশের অনেক সদস্য দীর্ঘ কর্মঘণ্টা ও ব্যবস্থাপনা নিয়ে হতাশায় ভুগছেন। এর মধ্যে নারীদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য। মার্কিন নারী চিকিৎসক লরনা ব্রিন (৪৯) গত ২৬ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়ায় বোনের বাসায় আত্মহত্যা করেন। ১৮ ঘণ্টার ডিউটি, ক্লান্তিতে হলওয়েতে ঘুমিয়ে পড়া, আক্রান্ত রোগীদের আধিক্য নিয়ে মানসিক চাপ বোধ করার কথা সহকর্মীদের কাছে প্রায়ই বলতেন। পরিবারের সদস্যদের মতে, এই চাপই তাঁকে আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দিয়েছে।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক মেখলা সরকার বলেন, বিষণ্নতা দুভাবে দেখা দেয়। একটি রোগ, অপরটি রোগ নয়। যখন স্বাভাবিক জীবন ব্যাহত হয়, তার প্রতিক্রিয়া হিসেবে এ ধরনের বিষণ্নতা দেখা দেয়। করোনাকালে বাড়িতে কোনো সহকারীর সাহায্য ছাড়া কাজ করতে হচ্ছে। এতে নারীদের ওপর অতিরিক্ত কাজের চাপ বেড়েছে। কর্মজীবী নারীদের ক্ষেত্রে সেই চাপ আরও বেশি। বর্তমান পরিস্থিতিতে নিরাপত্তা বোধ হারিয়ে ফেলছেন নারীরা।
কিছু পরামর্শ
কোভিড পরিস্থিতি নিয়ে মেন্টাল হেলথ অব দ্য ন্যাশনাল টেকনিক্যাল কমিটির সাব-কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় গত ২৫ এপ্রিল। বৈঠকে বলা হয়, করোনাকালে সাধারণ মানসিক সমস্যাগুলোর মধ্যে রয়েছে দুশ্চিন্তা, উদ্বেগ, দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, হতাশা, পরিবারে সংক্রমণের ভয় এবং পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার ভয়। ফ্রন্টলাইনারদের ক্ষেত্রে দীর্ঘ সময়ের কাজের ক্লান্তি ও স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে।
এসব সমস্যায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের কাছে দু-একটি নির্ভরযোগ্য গণমাধ্যম ছাড়া ঘন ঘন সংবাদ দেখা থেকে বিরত থাকা, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ন্যূনতম ব্যবহার, কোয়ারেন্টিন সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা দেওয়া, অপপ্রচারে কান না দেওয়া, মানসিকভাবে সক্রিয় থাকার জন্য বিভিন্ন শখ ও ব্যায়ামের দিকে ঝোঁকা, সুষম খাবার, যথেষ্ট ঘুম এবং যাঁরা কর্মক্ষেত্রে রয়েছেন তাঁদের ক্ষেত্রে কর্মবিরতি এবং ‘মিক্স অ্যান্ড ম্যাচ’ অনুসরণের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এতে একজন অভিজ্ঞ জ্যেষ্ঠ কর্মীর সঙ্গে কম অভিজ্ঞ কনিষ্ঠ কর্মীকে যুক্ত করা হয়।