শিক্ষাপঞ্জিতে এমন জট আগে কখনো বাঁধেনি। শুধু উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের কথাই ধরা যাক। কলেজগুলোয় এখন একটাই ব্যাচ—যারা এ বছর উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দেবে। আর যাদের প্রথম বর্ষে থাকার কথা, তারা এখনো ভর্তিই হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের অবস্থা আরও হযবরল। ‘স্বপ্ন নিয়ে’র পাতাতেই এক শিক্ষার্থী আক্ষেপ করে লিখেছিলেন, ‘আমার ছোট ভাই ক্লাস ফোর থেকে সিক্সে উঠে গেল, অথচ আমি এখনো চতুর্থ বর্ষে আটকে আছি।’
গত দই বছরে করোনার সংক্রমণের কারণে দেশের পুরো শিক্ষাপঞ্জিই এলোমেলো হয়ে গেছে। স্কুলপর্যায়ে পরীক্ষা না নিয়ে কিংবা শিক্ষার ঘাটতি রেখেই সময় ধরে ছাত্রছাত্রীদের ওপরের শ্রেণিতে তুলে দেওয়া হয়েছে। এসএসসি, এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা এবং উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে তা সম্ভব হয়নি। এ কারণে দু–তিনটি ব্যাচ একে অপরের কাঁধে নিশ্বাস ফেলতে শুরু করেছে।
গত এক দশকে সেশনজট প্রায় নাই হয়ে এসেছিল। কিন্তু করোনার দীর্ঘ ছুটির জের ধরে আবারও ফিরে এসেছে সেই পুরোনো ব্যাধি। আগে সংঘাত-সংঘর্ষ বা নানামুখী আন্দোলনের কারণে সেশনজট হয়েছে। এবারের পরিস্থিতির ওপর অবশ্য মানুষের হাত নেই। ক্ষুদ্র ভাইরাসের কারণে পুরো বিশ্বই বিপর্যস্ত।
আবারও শঙ্কা
করোনার সংক্রমণের কারণে ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় ছুটি শুরু হয়েছিল। দীর্ঘ প্রায় দেড় বছর পর গত বছরের সেপ্টেম্বরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বন্ধ দরজা খুললেও এখনো সীমিত পরিসরে চলছে শিক্ষা কার্যক্রম। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো খুলেছে আরও পরে। লম্বা এই ছুটির কারণে সব শিক্ষার্থীই কমবেশি ক্ষতির মুখে পড়েছে।
করোনার সংক্রমণ আবার বেড়ে যাওয়ায় নতুন করে আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে; যদিও সরকার এখন পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছুটি না দিয়ে শিক্ষার্থীদের করোনার টিকাদান এবং স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে মেনে শিক্ষা কার্যক্রম চালু রাখার চেষ্টা করছে। কিন্তু প্রতিদিন যেভাবে সংক্রমণ বাড়ছে, তাতে এ অবস্থান কত দিন ধরে রাখা যাবে, তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছে শিক্ষা প্রশাসন।
এসএসসি থেকে উচ্চশিক্ষা, সবখানেই সেশনজট
করোনার ছুটি শুরুর আগে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে ওই বছরের এসএসসি পরীক্ষা হয়েছিল। কিন্তু করোনার কারণে ফলাফল আটকে যায়। নির্ধারিত সময়ের কয়েক মাস পর ওই বছরের মে মাসের শেষে ফলাফল প্রকাশ করা হয়। অনলাইনে সম্পন্ন হয় একাদশ শ্রেণির ভর্তি কার্যক্রম। কিন্তু এসব শিক্ষার্থী প্রথমে শ্রেণিকক্ষে পা রাখে প্রায় এক বছর পর, গত সেপ্টেম্বরে। স্বাভাবিক নিয়মে এই শিক্ষার্থীদের এইচএসসি পরীক্ষা হওয়ার কথা ছিল এ বছরের এপ্রিলে। কিন্তু ইতিমধ্যেই শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি জানিয়ে দিয়েছেন, ২০২২ সালের এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা সময়মতো নেওয়া সম্ভব নয়। এই পরীক্ষা হতে পারে বছরের মাঝামাঝিতে। সেটিও নির্ভর করছে করোনা পরিস্থিতির ওপর। এর মানে স্পষ্টই, এসব শিক্ষার্থী কয়েক মাস পিছিয়ে যাচ্ছে।
অন্যদিকে, ২০২০ সালের এইচএসসি পরীক্ষা শুরু হওয়ার কথা ছিল ওই বছরের এপ্রিলে। কিন্তু তা আর হয়নি। দীর্ঘ অপেক্ষার পর গত বছরের জানুয়ারি মাসে পরীক্ষা ছাড়াই জেএসসি ও এসএসসি এবং সমমানের পরীক্ষার গড় ফলের ভিত্তিতে উচ্চমাধ্যমিকের ফল প্রকাশ করা হয়। তাতে পরীক্ষার্থীদের সবাই পাস করেন। কিন্তু উচ্চশিক্ষায় ভর্তিতেও পিছিয়ে পড়েন তাঁরা। ২০২০ সালের শেষে যাঁদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার কথা ছিল, তাঁদের ক্লাস এখন কেবল হয়েছে বা শুরু হচ্ছে। অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাজীবনের শুরুটাই হচ্ছে এক বছরের সেশনজট মাথায় নিয়ে।
অন্যদিকে, কাটছাঁট সিলেবাসে ২০২১ সালের এইচএসসি পরীক্ষা নেওয়া হয়েছে গত ডিসেম্বরে। আগামী মাসে তাঁদের ফলাফল প্রকাশের কথা। এরপর তাঁরাও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে যাবেন। ফলে, কয়েক মাসের ব্যবধানে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষে ভর্তি হচ্ছেন দুটি বছরের এইচএসসি ও সমমান পাস শিক্ষার্থীরা। অতএব আগে থেকেই সেশনজটে থাকা একদল শিক্ষার্থীর সমস্যা মাথায় নিয়েই নতুন করে আরেক দল ছাত্রছাত্রী ভর্তির প্রস্তুতি নিতে হবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে।
সমাধান কী
করোনা পরিস্থিতির কারণে উদ্ভূত এই সেশনজট থেকে উত্তরণের উপায় কী? দুটি বিষয় বিবেচনায় নিয়ে পরিকল্পনা করে বাস্তবায়নের পরামর্শ দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইআর) অধ্যাপক এস এম হাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, প্রথমত যে সময় নষ্ট হয়েছে, সেটি পূরণের দিকে নজর দিতে হবে। আরেকটি বিষয় হলো মূল শিখন (কোর লার্নিং) শেখানোর প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। কারণ, সময় পূরণ করা হলো, কিন্তু মূল শিখন হলো না, তাহলে কিন্তু হবে না। এ জন্য পুরো শিক্ষা কার্যক্রম ঢেলে সাজাতে হবে। স্কুল ও কলেজ পর্যায়ের মূল শিখন কীভাবে হবে, সে সিদ্ধান্ত আসবে কেন্দ্রীয়ভাবে, যা অনুসরণ করে শিক্ষকেরা শিক্ষার্থীদের শেখাবেন। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে সময় বেঁধে দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের হাতে কাজটি ছেড়ে দিতে হবে।
এস এম হাফিজুর রহমান জানান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এই দুটি বিষয় মাথায় রেখে একটি পথরেখা করেছে, যেখানে ট্রাইমিস্টার (পুরো বছরকে তিনটি একাডেমিক সেশনে ভাগ করা) পদ্ধতিতে পাঠদানের কথা বলা হয়েছে। এত দিন সেমিস্টার (বছরে দুটি একাডেমিক সেশন) পদ্ধতিতে পড়ানো হতো। তিনি বলেন, মনে রাখতে হবে, সময়ের ঘাটতি পূরণের পাশাপাশি মূল শিখনের ঘাটতিও পূরণ করতে হবে। এভাবে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক শিক্ষা কার্যক্রমে ফিরে যেতে হবে।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম বলেন, করোনার সংক্রমণের কারণে গত প্রায় দুই বছর শিক্ষাঙ্গনসহ সব ক্ষেত্রে খারাপ সময় গেছে। সামনেও পরিস্থিতি খারাপ হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। কাজেই এ অবস্থায় সেশনজট কমাতে গেলে, বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে সেশনজট কমানোর জন্য প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম জোরদার করতে হবে। যেমন বুয়েট ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় আবারও অনলাইনে পড়াশোনা চালানোর ঘোষণা দিয়েছে। কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ও অনলাইনে পড়াশোনা চালিয়েছে। তবে অনলাইনে পড়াশোনা চালিয়ে নেওয়ার জন্য যেসব সুযোগ-সুবিধা দরকার, তা-ও নিশ্চিত করতে হবে।