করোনাভাইরাস, বর্তমান প্রেক্ষাপট ও আমাদের অবস্থান

ঠিক যে মুহূর্তে এই লেখাটি লিখছি, তখন নভেল করোনাভাইরাস নামক জীবাণু পৃথিবীর ১৪,৩২,৫৭৭ জন মানুষকে নিশ্চিতভাবে আক্রান্ত করেছে। এদের মধ্যে মৃত্যুবরণ করেছেন ৮২,১৯৪ জন এবং সুস্থ হয়ে উঠেছেন ২,৭৫,০৬৩ জন । তার মানে, এই ভাইরাসের আক্রমণে প্রতি ১০০ জনে ৫.৭ জন মানুষ মারা যাচ্ছেন এবং ১৯.২ জন মানুষ সুস্থ হয়ে উঠছেন। আপনি যখন এই তথ্যগুলি জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের করোনাভাইরাস রিসোর্স সেন্টারে (https://coronavirus.jhu.edu/) অনুসন্ধান করতে যাবেন, তখন সংস্থাগুলো এক পাবেন না। কারণ প্রতিনিয়ত তথ্য হালনাগাদ করা হচ্ছে। এর অর্থ হচ্ছে, সংক্রমণ আর মৃত্যু মিছিলে সংখ্যা কেবল বেড়েই চলেছে। পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলিতে আক্রান্তের হার পর্যালোচনা করলে হয়তো আমরা এই ভাইরাসের সংক্রমণের গতি প্রকৃতি সম্পর্কে একটা ধারণা করতে পারব— যা নিচের ছকে তুলে ধরা হলো।

ছক-১: করোনাভাইরাস সংক্রমণে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দশটি দেশের হালহকিকত।

দেশপ্রথম শনাক্তের তারিখ ০৮ এপ্রিল ২০২০ পর্যন্ত আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যা ০৮ এপ্রিল ২০২০ তারিখ পর্যন্ত অতিক্রান্ত দিন ০৮ এপ্রিল ২০২০ তারিখ পর্যন্তমৃত্যু
(শতকরা হার)সুস্থ হয়ে ওঠা মানুষের সংখ্যা (শতকরা হার)ইতালি৩১/০১/২০২০১৩৫৫৮৬৬৭১৭১২৭ (১২.৬%)     ২৪৩৯২ (১৮%)স্পেন ০১/০২/২০২০১৪১৯৪২ ৬৬ ১৪০৪৫ (৯.৮৯%)৪৩২০৮ (৩০.৪%)যুক্তরাষ্ট্র ২৩/০১/২০২০৩৯৬২২৩৭৫১২৭২২ (৩.২১%)১২৫৩৯ (৬.১৫%)ফ্রান্স২৪/০১/২০২০১১০০৬৫৭৪১০৩৪৩ (৯.৩৯%)১৯৫২৩ (১৭.৭৪)যুক্তরাজ্য ৩১/০১/২০২০৫৫৯৪৯৬৭ ৬১৭১ (১১.০৩%)৩২৫ (০.৬%)ইরান১৯/০২/২০২০৬২৫৮৯৪৮৩৮৭২ (৬.২%)২৭০৩৯ (৪৩.২%)চীন৩১/১২/২০২০ ৮২৭১৮৯৮৩৩৩৫ (৪.০৩%)৭৭৫৩৭ (৯৩.৭৫%)হল্যান্ড১৭/০২/২০২০ ১৯৭০৯  ৪০২১০৮ (১০.৭%)  ২৭২ (১.৪%)বেলজিয়াম ০৪/০২/২০২০২২১৯৪৬৩ ২০৩৫ (৯.১৬%)৪১৫৭ (১৮.৭৩%)জার্মানি২৭/০১/২০২০১০৭৬৬৩৭১ ২০১৬ (১.৯%)৩৬০৮১ (৩৩.৫%)



সূত্র: জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়; https://www.worldometers.info/coronavirus

ওপরের পরিসংখ্যান থেকে পরিষ্কারভাবেই করোনা প্রাদুর্ভাবের বর্তমান অবস্থান বোঝা যাচ্ছে। মৃত্যুহার ও সুস্থ হওয়ার হারের মাঝেও দেশভিত্তিক তারতম্য স্পষ্ট পরিলক্ষিত হচ্ছে (ছক-১) । এই ভিন্নতার কারণ হতে পারে আক্রান্ত ব্যক্তির বয়স, বসবাসের পরিবেশ, পূর্বের দীর্ঘস্থায়ী রোগের (যেমন, ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ, হৃদ্‌রোগ, বৃক্কের সমস্যা বা কোনো কারণে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়া ইত্যাদি) উপস্থিতি। আরেকটি কারণ নিহিত থাকতে পারে, করোনাভাইরাসের বংশগতি বহনকারী উপাদান আর.এন.এ. এর মধ্যে। এই উপাদানকে বিশ্লেষণ (Genome Sequence এর মাধ্যমে) করে দেখা যায়, চীনে যে ভাইরাস দ্বারা সংক্রমণ ঘটেছিল সেটি ইউরোপ, আমেরিকাসহ অন্যান্য দেশেও বিদ্যমান। কিন্তু আর.এন.এ. ভাইরাসগুলি দ্রুত পরিবর্তনশীল। করোনাভাইরাসটিও ইউরোপ এবং আমেরিকায় গিয়ে তার সুবিধা অনুযায়ী রূপ পরিবর্তন করতে সক্ষম হয়েছে। ইউরোপ এবং আমেরিকায় নতুন আক্রান্ত ব্যক্তির শরীর থেকে ভাইরাসটির নমুনা সংগ্রহ করে জেনোম সিকোয়েন্সিং করে বিশ্লেষণ করলে সিকোয়েন্সগুলোকে ভিন্ন অঞ্চল ভিত্তিক গুচ্ছে বা Cluster-এ ভাগ করা যায় (https://www.gisaid.org/epiflu-applications/next-hcov-19-app/)। তার মানে, যে আর.এন.এ. দ্বারা ভাইরাসটি গঠিত সেটি পরিবর্তনশীল অর্থাৎ এদের মধ্যে মিউটেশন ঘটছে। এ সমস্ত কারণেই এই ভাইরাসের সংক্রমণের প্রভাব ও ফলাফল অঞ্চলভেদে, জনসংখ্যা ভেদে পৃথক হয়। আরেকটু বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, একদিনে সর্বোচ্চ সংখ্যক আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ইতালিতে ৬,৫৭৭ জনে পৌঁছায় ৫১তম দিনে, যুক্তরাষ্ট্রে ৩৪,১৯৬ জন পৌঁছায় ৪২তম দিনে, স্পেনে ৮,২৭১ জন পৌঁছায় ৫৫তম দিনে, ফ্রান্সে ২৩,০৬০ জন পৌঁছায় ৭০তম দিনে, যুক্তরাজ্যে ৫,৯০৩ জন পৌঁছায় ৬৬তম দিনে, ইরানে ৩,১৮৬ জন পৌঁছায় ৪১তম দিনে, চীনে ১৪,১০৮ জন পৌঁছায় ৪৪তম দিনে, হল্যান্ডে ১,২২৪ জন পৌঁছায় ৩৯তম দিনে, বেলজিয়ামে ১,৮৫০ জন পৌঁছায় ৫৪তম দিনে আর জার্মানিতে ৬,৯৩৩ জন পৌঁছায় ৬১তম দিনে। উল্লেখিত সর্বোচ্চ সংখ্যক রোগী শনাক্তের পরও সংক্রমণের সংখ্যা এর আশপাশেই ঘোরাঘুরি করেছে কোথাও ৭ দিন, কোথাও ১০ দিন আবার কোথাও ১৫ দিন। বর্তমানে অবশ্য এই দেশগুলিতে সংক্রমণের হার কমে এসেছে।

বর্তমানে অনেকটা জ্যামিতিক হারেই দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে ভাইরাসটির সংক্রমণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ভারত আর পাকিস্তানে করোনা রোগী প্রথম শনাক্তের পর যথাক্রমে ৬৭ (৫ই এপ্রিল) এবং ৪১তম দিন (৬ই এপ্রিল) পার হওয়ার পর সর্বোচ্চ সংখ্যক, যথাক্রমে ৭০১ ও ৬০৯ জন রোগী শনাক্ত হয়। গুরুত্বপূর্ণ হলো, গত ১-২ দিনে এই হার কম। হতে পারে দেশগুলির প্রশাসন লোকজনের গতিবিধি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করেছে। আমরা কেবল ৩২তম দিন পার করছি। গত চার দিনে অর্থাৎ ৫, ৬, ৭ ও ৮ই এপ্রিল আমাদের দেশে শনাক্তের সংখ্যা যথাক্রমে ১৮, ৩৫, ৪১ ও ৫৪ জন। তার মানে এখানে সংক্রমণের গতি পেয়েছে, নতুন নতুন স্থান যুক্ত হচ্ছে। হতে পারে আমাদের ল্যাবরেটরি পরীক্ষার পরিধি বেড়েছে, তাই শনাক্তের সংখ্যাও বাড়ছে। আগে যেখানে একটি মাত্র প্রতিষ্ঠান পরীক্ষা করার অনুমোদন পেয়েছিল, এখন সেখানে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রংপুর, রাজশাহী ও সিলেটসহ ১৪টি ল্যাবে রোগীদের মধ্যে ভাইরাসের উপস্থিতি পরীক্ষা করা হচ্ছে। এরপরও এটা অপ্রতুল। কারণ আক্রান্তের সংখ্যার ওপর নির্ভর করে ভাইরাসের গতি প্রকৃতি, কোনো এলাকার জনসাধারণকে কীভাবে এবং কত দিন নিয়ন্ত্রণের দরকার, যেটা নীতিনির্ধারণসহ নানা বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণে অনেক সাহায্য করে।

ছক-২: করোনাভাইরাস সংক্রমণে দক্ষিণ এশিয়ার জনসংখ্যাবহুল দেশগুলোর হালহকিকত।

দেশ প্রথম শনাক্তের তারিখ ০৮ এপ্রিল ২০২০ পর্যন্ত আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যা ০৮ এপ্রিল ২০২০ তারিখ পর্যন্তঅতিক্রান্ত দিন ০৮ এপ্রিল ২০২০ তারিখ পর্যন্তমৃত্যু
(শতকরা হার)সুস্থ হয়ে ওঠা মানুষের সংখ্যা
(শতকরা হার)ভারত৩০/০১/২০২০ ৫,৭৪৯৭৫ ১৬৪(২.৮৫%)৪৬৮ (৮.১৪%)পাকিস্তান২৬/০২/২০২০ ৪,১৯৬৪৩৬০ (১.৪৩%) ৪৬৭ (১১.১৫%)শ্রীলঙ্কা২৭/০১/২০২০১৮৬৭২৬ (৩.২২%)৪২ (২২.৬%)বাংলাদেশ ০৮/০৩/২০২০২১৮৩২ ২০ (৯.২%)   ৩৩ (১৫.১৪%)


সূত্র: জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়; https://www.worldometers.info/coronavirus

উন্নত বিশ্বের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই, প্রতি হাজার মানুষের মাঝে জার্মানিতে ১১.১৩, ফ্রান্সে ৩.৪১, বেলজিয়ামে ৬.১৬, ইতালিতে ১২.২১, হল্যান্ডে ৫.২৭, যুক্তরাজ্যে ৩.৯৬, যুক্তরাষ্ট্রে ৬.২, ইরানে ২.৫, স্পেনে ৭.৬ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। বিশেষ করে জার্মানি ভাইরাস শনাক্তের ফল খুব ভালোমতো পেয়েছে। সেখানে লক্ষাধিক আক্রান্ত হলেও মৃত্যুহার সবচেয়ে কম (১.৯), কিন্তু সুস্থ হয়ে ওঠার শতকরা হার ৩৩.৫ ভাগ। দক্ষিণ কোরিয়াও আক্রান্তের প্রথমভাগে থাকলেও দ্রুত রোগী শনাক্তের মাধ্যমে (হাজারে ৯.০৬ জন) সংক্রমণের হার একদম নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছে (মার্চের ৩ তারিখে আক্রান্ত ছিল ৮৫১ জন আর এপ্রিলের ৭ তারিখে ছিল ৪৭ জন; https://www.worldometers.info/coronavirus)। পক্ষান্তরে, ভারতে প্রতি হাজারে ০.১, পাকিস্তানে ০.১৯, শ্রীলঙ্কায় ০.১৫ এমনকি ভুটানে ১.৫ জন মানুষের নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। এদিক দিয়ে আমরা অনেক পিছিয়ে। বাংলাদেশে প্রতি হাজারে মাত্র ০.০২ জনের মধ্যে ভাইরাসের উপস্থিতি পরীক্ষা করা হয়েছে। এই সীমাবদ্ধতার মধ্যেই মৃত্যুহারে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর চেয়ে আমরা অনেক এগিয়ে (ছক-২ দ্রষ্টব্য)। সংক্রমণের সর্বোচ্চ চূড়াটিতে পৌঁছাতে এখনো আমাদের বাকি। এত কড়াকড়ি আরোপ করার পরেও চীনের তিন মাসের বেশি সময় লেগেছে করোনাভাইরাস আক্রান্তের হার শূন্যের কোটায় আনতে। আবার লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, শ্রীলঙ্কায় ৭২ দিনে মোট আক্রান্ত মাত্র ১৮৬ জন আর শতকরা মৃত্যু হার ৩.৬৬। গবেষণায় দেখা, গেছে চীনে আক্রান্ত ব্যক্তির প্রতি তিনজনে একজনের লক্ষণ প্রকাশ পায় আর যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি চারজনে একজনের। আক্রান্ত হলে লক্ষণ প্রকাশ পাবে না কিন্তু আপনি ভাইরাস বহন করবেন যেটা আরও মারাত্মক। কোনোভাবে সুস্থ মানুষের সংস্পর্শে আসলে তিনি আক্রান্ত হবেন এবং তার মধ্যে লক্ষণ ও উপসর্গগুলো প্রকাশ পাবে যা জীবন হানিকর।

তাই দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তিরা যা বলছেন, তার ওপর আস্থা রাখতে হবে। সরকার ও আমাদের সম্মিলিত উদ্যোগে, মানুষে-মানুষে সংস্পর্শ এড়ানোর মাধ্যমে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়া রোধ করতে হবে। ভিয়েতনামে এখন পর্যন্ত কোন রোগী মারা যায়নি। কারণ দুনিয়াজুড়ে করোনা ছড়িয়ে পড়ার আগেই ভিয়েতনাম সরকার গোটা দেশটাকেই লকডাউন করে দেয় যার ফলে ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে রাখা সহজ হয়।

লেখক: অধ্যাপক, প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
ইমেইল: nabi@du.ac.bd