করোনাকালে জীবনধারা কেবল নয়; আমাদের ভাবনা, চিন্তা ও জীবন পরিকল্পনাও অনেকাংশে বদলে গেছে। স্বাভাবিকভাবেই করোনাভাইরাসের গতিপ্রকৃতি নিয়ে সবার মনে ভয় ও অনিশ্চয়তা রয়েছে, তবু আমাদের সঠিক তথ্য-উপাত্ত দিয়ে একে মোকাবিলা করতে হবে, কুসংস্কার দূর করতে হবে আর একে নিয়েই ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা করতে হবে। যেকোনো মহামারির সময় যৌন এবং প্রজনন স্বাস্থ্যব্যবস্থা বিশেষ ঝুঁকির মধ্যে থাকে। তবে যথাযথভাবে সংক্রমণ প্রতিরোধ সতর্কতা মেনে চলার ওপর নিরাপদ গর্ভাবস্থা এবং প্রসবকালীন স্বাস্থ্য নির্ভর করে।
আবার লকডাউনের মতো পরিস্থিতিতে গর্ভনিরোধসামগ্রীর সংকটে অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণও বাড়তে পারে। তবে সবদিক বিবেচনা করে পরিকল্পনা করলে পারিবারিক স্বাস্থ্য সুনিশ্চিত করা সম্ভব। যেহেতু ভাইরাসটি অভূতপূর্ব, গর্ভবতী নারীদের ওপর এর প্রভাব সম্পর্কে খুব কমই জানা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা অন্যান্য সংস্থা এখন পর্যন্ত কোনো নিশ্চিত তথ্য দেয়নি, যাতে বলা যায় যে অন্তঃসত্ত্বা নারীরা অন্যদের থেকে বেশি ঝুঁকিতে আছেন।
করোনাকালে গর্ভধারণ
কারও হয়তো ইচ্ছা বা পরিকল্পনা ছিল, এ বছর বা নিকট ভবিষ্যতে সন্তান নেওয়ার চেষ্টা করবেন। অনেকে সন্তান ধারণের আশায় আগে থেকেই কিছু চিকিৎসা নিচ্ছিলেন। কারও হয়তো বয়স একটু বেশি, তাই সন্তান নিতে আর দেরি করতে চান না। কিন্তু এখন করোনাভাইরাসের কারণে মনে কাজ করছে নানা প্রশ্ন। এদিকে করোনার প্রকোপ ঠিক কত দিন পর্যন্ত থাকবে, তা–ও কেউ জানে না। এ রকম পরিস্থিতিতে সন্তান ধারণের পরিকল্পনায় দুশ্চিন্তা হওয়ারই কথা।
এ সময়ে সন্তান ধারণ করতে চান কি না, এটা পুরোপুরিভাবেই দম্পতির ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিষয়ের ওপর নির্ভর করে। এই ক্রান্তিকালে গর্ভকালীন (যেমন ন্যূনতম পরীক্ষা-নিরীক্ষা, নিয়মিত চেকআপ), প্রসবকালীন এবং প্রসব–পরবর্তী চিকিৎসাসেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা থাকতেই পারে। এই বিষয়গুলো বিবেচনা করতে হবে গর্ভধারণের পরিকল্পনার সময়। সব বিবেচনা করেই সিদ্ধান্ত নিন, ঝুঁকি নেবেন কি না। অবশ্য অন্য কোনো শারীরিক সমস্যার ইতিহাস (যেমন উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, ফুসফুসের সমস্যা প্রভৃতি) থাকলে কিছু সময় অপেক্ষা করাই উত্তম। মহামারির মহাদুর্যোগে ভয় ও আশঙ্কা তো থাকতেই পারে, কিন্তু কোনো অবস্থাতেই ভিত্তিহীন ও অবৈজ্ঞানিক ধারণার ভিত্তিতে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত নয়। ইন্টারনেটে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ নানা উৎস থেকে তথ্য আপনার সামনে উপস্থিত হতে পারে, বৈজ্ঞানিক ভিত্তি না থাকলে কোনো তথ্য বিশ্বাস করবেন না।
গর্ভকালে করোনা-ভাবনা
অন্যদের মতো গর্ভবতী নারীদের জন্যও সংক্রমণ এড়াতে একই প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত। এই সংকটকালে নিজেকে নিরাপদ রাখুন। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন। মাছ, মাংস ও ডিম ইত্যাদি পুরোপুরি সেদ্ধ করে রান্না করে খেতে হবে। গর্ভবতী নারীর আশপাশে যাঁরা থাকবেন, তাঁরাও অবশ্যই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন। গর্ভাবস্থায় স্বাভাবিকভাবেই শারীরিক পরিবর্তন হওয়ার কারণে শ্বাসপ্রশ্বাসে একটু অসুবিধা হতে পারে। গর্ভাবস্থায় শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণের হারও বেশি। তা ছাড়া প্রথম তিন মাস শারীরিক দুর্বলতা, খারাপ লাগা, জ্বর জ্বর ভাব, বমি ভাব, অরুচি প্রভৃতি সমস্যা হয়েই থাকে, যেগুলোর সঙ্গে করোনা সংক্রমণের লক্ষণের মিল রয়েছে। তাই লক্ষণ সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখতে হবে। করোনা সংক্রমণের কোনো লক্ষণ দেখা দিলে সেটিকে গুরুত্বসহকারে দেখুন, চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। প্রয়োজনে টেলিমেডিসিন সেবা গ্রহণ করুন।
গর্ভধারণের প্রথম সাত মাসের মধ্যে আক্রান্ত হলে লক্ষণগুলো তেমন গুরুতর হয় না এবং সাধারণত তা খুব একটা জটিল আকার ধারণ করে না। তবে সাত মাসের পর করোনা সংক্রমণ হলে কিছুটা জটিলতার ঝুঁকি থাকে। করোনায় আক্রান্ত গর্ভবতীদের মধ্যে পূর্ণ গর্ভকাল পেরোনোর আগে সন্তান জন্মানোর হার বেশি। তবে মায়ের কাছ থেকে তাঁর গর্ভের সন্তানের শরীরে করোনা ছড়ায় কি না বা মায়ের শরীরে উপস্থিত করোনাভাইরাসের কারণে গর্ভস্থ শিশুর কোনো জটিলতা দেখা দেয় কি না—এসব বিষয়ের এখন পর্যন্ত কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্যপ্রমাণ নেই। নবজাতকের করোনা সংক্রমণ হলেও সাধারণত তা খুব একটা জটিল আকার ধারণ করে না, ধারণা করা হয় মায়ের থেকে অ্যান্টিবডি পাওয়ার সুবাদেই এমনটা হয়। শিশুকে বুকের দুধ খাওয়াতেও কোনো বাধা নেই, শুধু স্বাস্থ্যবিধি মেনে খাওয়াতে হবে।
গর্ভধারণের পরিকল্পনা
করোনাকালে গর্ভধারণের পরিকল্পনা করলে পরিকল্পনার শুরু থেকেই ফলিক অ্যাসিড, ভিটামিন ডি, জিংক গ্রহণ করতে হবে। শারীরিক সুস্থতার বিকল্প নেই। রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়ানোর চেষ্টা করুন। সুষম খাদ্যাভ্যাস গড়ে তুলুন। চা-কফির পরিমাণ কমিয়ে আনুন, সঠিক সময়ে ঘুমের অভ্যাস করুন। বাড়িতেই নিয়মিত হালকা ব্যায়াম করুন। কাজের মধ্যে থাকুন। বাড়ির টুকটাক কাজ করুন। মানসিকভাবে প্রফুল্ল থাকুন। বাড়িতে গাছের পরিচর্যা, বারান্দায় বা লনে সময় কাটানো এবং বই পড়ার মতো সু–অভ্যাস গড়ে তুলতে পারেন।
করোনাকালে বন্ধ্যাত্বের চিকিৎসা
বন্ধ্যাত্বের চিকিৎসা বেশ সময়সাপেক্ষ এবং ব্যয়বহুল। এর জন্য ধারাবাহিকভাবে অনেকগুলো ধাপের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। তাই যাঁরা ইতিমধ্যে বন্ধ্যাত্বের চিকিৎসা নিচ্ছেন, তাঁরা মাঝপথে থামিয়ে না দিয়ে চিকিৎসা চালিয়ে যেতে পারেন। মাঝে চিকিৎসা থামিয়ে দিলে এত দিন ধরে যে চিকিৎসা নিয়েছেন, সেই পুরো প্রক্রিয়ার পুনরাবৃত্তির প্রয়োজন হবে। তবে যাঁরা বন্ধ্যাত্বের চিকিৎসা নেওয়ার পরিকল্পনা করছিলেন (এখনো চিকিৎসা শুরু করেননি), তাঁরা বয়স ও অন্যান্য বিষয় অনুকূলে থাকলে আর কিছুটা সময় অপেক্ষা করতে পারেন। সবচেয়ে বড় কথা হলো, আপনার ভাবনাচিন্তা ও পরিকল্পনাগুলো নিয়ে যৌক্তিক চিন্তা আর আলোচনা করুন দুজনে মিলে, চাইলে আপনার চিকিৎসকের সঙ্গেও কথা বলুন।
ডা. ডা. জাকিউর রহমান জাকিউর রহমান
স্ত্রীরোগ ও প্রসূতিবিদ্যা বিশেষজ্ঞ
অনুলিখন: ডা. রাফিয়া আলম