করোনাভাইরাসের এই দুর্যোগে আমরা যদি শুধু নেতিবাচক চিন্তা করি, তাহলে চরম হতাশায় ডুবে যাব। আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হয়ে পড়বে। দেখা দিবে নানা শারীরিক ও মানসিক সমস্যা। পরিবারের বড়রা ভেঙে পড়লে শিশুদের কী হবে? বরং শিশুদের নিয়ে এই সময়টা কত ভালোভাবে পাড়ি দেওয়া যায়, সেই চেষ্টাই বাবা–মাকে করতে হবে।
বলা হয়ে থাকে, গর্ভের সময় থেকে প্রথম ৫ বছরের মধ্যে শিশুর বিকাশ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এর ওপর ভিত্তি করেই শিশুর পরবর্তী জীবনটা গড়ে ওঠে। তাই প্রথমেই আসা যাক, করোনার এই দিনগুলোতে অন্তঃসত্ত্বা মা কী কী করতে পারেন; সেই আলোচনায়। কোনোভাবেই আতঙ্কিত হওয়া যাবে না। কারণ, কোনো বিপদই চিরকাল থাকে না। করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট পরিস্থিতিও অনন্তকাল চলবে না। পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাবার ও বিশ্রাম নিতে হবে। শুধু ফেসবুকে উঁকি না দিয়ে পছন্দের বই বেছে নিতে পারেন। অনাগত সন্তানের জন্য বাড়িতে থাকা জিনিস দিয়ে সুন্দর সুন্দর খেলনা, কাঁথা বা জামা বানাতে পারেন। আপনার সুন্দর কাজ ও চিন্তা–ভাবনাগুলো সন্তানের সুষ্ঠু বিকাশে প্রভাব ফেলবে।
শিশুর বিকাশে খেলনা বেশ ভূমিকা রাখে। সন্তানকে তার বয়স অনুযায়ী খেলনা দিন। বাচ্চার বয়স যদি ৪ মাসের মধ্যে হয় তাকে নানা রকম নরম রঙিন খেলনা দিন। তার সঙ্গে সেটা দিয়ে খেলা করুন। হাসিমুখে বারবার নানা ধরনের কথা বলুন। ৫ থেকে ৭ মাসের বাচ্চার চোখের সামনে খেলনা লুকিয়ে রেখে তাকে তা বের করতে দিন। ১৮ মাস বয়সে বাচ্চাকে ছোট নরম রঙিন বল হাতে দিয়ে ছুড়তে দিন। কিংবা গুঁটি হাতে দিয়ে বলুন গাছ বানাতে। ২১ থেকে ৪২ মাস বয়সে কোনো জিনিস এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় নেওয়া, একটার ওপর আরেকটা সাজানোর মতো ধাঁধাঁর খেলা খেলতে দিন।
অবসরে শিশুর সঙ্গে কথা বলুন, ছড়া কিংবা খেলা শেখান, গল্প বলুন, প্রাণ খুলে হাসুন। তাকে গান গাইতে বা মনের আনন্দে নাচতে দিন। এতে বাচ্চার ভাষাগত বিকাশ দ্রুত হবে। সে আত্মবিশ্বাসী হয়ে বেড়ে ওঠবে। রঙিন পেন্সিল ও খাতা দিয়ে যা ইচ্ছে আঁকতে দিন। কাগজ দিয়ে নৌকা কিংবা ফুল–পাখি বানানো শেখাতে পারেন। পরিত্যক্ত জিনিস দিয়ে রঙিন নরম বল, পুতুল বা অন্যকিছু বানাতে উৎসাহ দিন।
বাড়িতে একাধিক শিশু থাকলে কিছু সমস্যা দেখা যায়। যেমন একই জিনিস একসঙ্গে দুজন দাবি করে বসে। এ নিয়ে চিৎকার–মারামারি পর্যন্ত লেগে যায়। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে যাওয়ার আগেই তাদের সময় নির্ধারণ করে দিন। বলুন, এটা তুমি এতক্ষণ ব্যবহার করতে পারবে। ফলে শেয়ারিং শিখতে পারবে শিশু। এ ছাড়া পালা করে সব সন্তানকে খেলায় নেতৃত্ব দিতে দিন।
ঘরে থাকার এই দিনগুলোতে বাড়ির পরিবেশ আনন্দময় করে তুলুন। বিষন্নতা আর আতঙ্ক বর্জন করুন। সন্তানের সঙ্গে কতগুলো খেলা খেলতে পারেন। যেমন: তাকে বলতে পারেন, আমি যা দেখছি তুমি তা দেখছ? ছন্দ মিলিয়ে হাততালি দেওয়া, লুকোচুরি খেলা। তাদের নিয়ে সিনেমা দেখতে পারেন। আপনি সন্তানের সঙ্গে এতটা সময় কাটালে সে নানা ধরনের গ্যাজেটে (মোবাইল, ট্যাব) আসক্ত হবে না। সন্তানের ওপর কোনো কিছু চাপিয়ে দেবেন না। জেদ করলে তাকে বুঝিয়ে বলুন। সন্তানের সমালোচনা বাদ দিন। কারও সঙ্গে তুলনা না করে তাকে তার মতো বড় হতে দিন।
স্বাভাবিক সময়ে বাবা–মায়ের কর্মব্যস্ততা অনেক বেশি থাকে। করোনার কারণে কর্মজীবী বাবা–মায়ের অনেকে ছুটিতে কিংবা বাসা থেকে অফিসের কাজ করছেন। এটাকে সন্তানের কাছাকাছি থাকার একটা সুযোগ মনে করে সদ্ব্যবহার করুন। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত আপনার সন্তান কী কী করে, গভীর মন দিয়ে দেখুন। দেখবেন, সারা দিনে সে অনেক ধরনের সৃষ্টিশীল কাজ করে। যেমন: ছবি আঁকে, খেলনা বানিয়ে নিজে নিজে খেলে, খেলতে খেলতে নানা রকম গল্প বলে কিংবা আধো আধো কণ্ঠে গান গায়। এগুলোর প্রশংসা করুন আর আপনার সন্তান কতটা সৃজনশীল সেটা ভেবে আনন্দিত হোন।
দীর্ঘদিন ধরে বাচ্চাদের ডে কেয়ার বা স্কুল বন্ধ। বন্ধুদের সঙ্গে দেখা নেই। করোনার ভয়ে আশপাশের বাড়ির কারও সঙ্গে খেলার সুযোগ নেই। ফলে আপনার ঘরবন্দী সন্তান অকারণে অন্য সময়ের চেয়ে বেশি দুষ্টুমি করতে পারে। এ অবস্থায় তাকে আদর দিয়ে শাসন করুন। নিজেরা একটু ধৈর্য ধরুন। যদি শান্ত না হয় তাকে জড়িয়ে ধরে বলুন, 'তোমার কি অনেক দুষ্টুমি করতে ইচ্ছে করছে? তাহলে করো, যতক্ষণ ইচ্ছা।' দেখবেন একটু পরে সে নিজে থেকেই থেমে যাবে।
বাবা–মা যে সন্তানের জন্য এগুলো করবেন, তাতে কী হবে? সন্তানের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ হবে। ইতিবাচক ব্যক্তিত্ব নিয়ে গড়ে ওঠলে সে ভবিষ্যতে সমস্যা সমাধানে পারদর্শী হবে, আত্মবিশ্বাসী হবে, নিজের সৃজনশীলতা দিয়ে সমাজে অবদান রাখতে পারবে। সব মিলিয়ে আপনার সন্তান হবে সুনাগরিক, যার জন্য আপনি গর্বিত হবেন।
লেখক: জ্যেষ্ঠ মনোবিদ, মা ও শিশু স্বাস্থ্য বিভাগ, আইসিডিডিআর, বি