করি কাজ মিলেমিশে

অভিনেত্রী বাঁধন ছোটবেলা থেকেই তাঁর মেয়ে সায়রাকে ঘরের নানা কাজ শেখাচ্ছেন। যাতে বড় হয়ে মেয়ে একা একাই সব কাজ করতে পারে। বাসায় নিজেদের কাজের সময়ের ছবি পাঠিয়েছেন অধুনার জন্য
অভিনেত্রী বাঁধন ছোটবেলা থেকেই তাঁর মেয়ে সায়রাকে ঘরের নানা কাজ শেখাচ্ছেন। যাতে বড় হয়ে মেয়ে একা একাই সব কাজ করতে পারে। বাসায় নিজেদের কাজের সময়ের ছবি পাঠিয়েছেন অধুনার জন্য

ঘরবন্দী হয়ে যেন বিষিয়ে উঠেছে রাজধানীর মগবাজারের শাহানা রহিমের জীবন। কাজ, কাজ আর কাজ, যেন ফুরোয় না। করোনার প্রাদুর্ভাবের পর থেকে বাসার গৃহকর্মী আসে না। সব একা হাতেই করতে হয় শাহানাকে। দুই সন্তান তাঁর। ছেলের বয়স ১৫, মেয়ের ১২ বছর। মেয়েকে দিয়ে তা–ও টুকটাক কাজ করানো যায়, ছেলে একদমই ঘর থেকে বের হয় না। সারা দিন গ্যাজেট নিয়ে বসে থাকে। কিছু করতে বললেই বলে, ‘আমি পারব না।’ অথচ ওর ঘর গোছাতে, জিনসের প্যান্ট ধুতে জান বের হয়ে যায় তাঁর। শাহানার স্বামী সকাল থেকে বাসায় বসে অফিস করেন। কিছু বললেই বলেন, ‘আমাকে অফিস করতে হচ্ছে।

জীবন রক্ষার প্রশ্নে কোভিড-১৯-এর অবরুদ্ধ পরিস্থিতি মানুষের জীবনকে নানা দিক দিয়ে দুর্বিষহ করে তুলেছে। বেশির ভাগ বাসাতেই কাজের সহকারী নেই। স্কুল বন্ধ এবং পুরো পরিবার বাড়িতে থাকায় নারীর কাজ আরও বেড়েছে। অনেক বাসাতেই পরিবারের অন্য সদস্যেরা কাজে এগিয়ে আসেন না। তবে এর ব্যতিক্রমও আছে। বাড়িতে সব সদস্য মিলে ভাগাভাগি করে কাজ করছেন, এমন উদাহরণও দেখা যায়।

এ সময় মানুষে মানুষে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে হলেও বেঁচে থাকার জন্য পরিবারগুলোর মধ্যে এক দৃঢ় বন্ধন গড়ে তোলা দরকার। একটি সংসারের সবাই যদি মিলেমিশে কাজটা করে, তবে সব অনেক সহজ হয়। একে অপরের মধ্যে আস্থা তৈরি করতে পারেন স্বামী–স্ত্রী। আবার অভিভাবকেরা তাঁদের সন্তানদের দায়িত্বশীল করে গড়ে তুলতে পারেন। যা কখনোই করেনি, তা এখন করার সময় এসেছে—এমনটাই ভেবে নিতে হবে।

নিজের কাজ নিজেই করি

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রাফসান আহমেদ জানান, বরাবরই সংসারের কাজ করেন তিনি। তিনি মনে করেন, তাঁর নিজের পরিষ্কার কাপড়, পরিষ্কার ঘর, খাবারের প্রয়োজন মেটানোর দায়িত্ব নিজেরই। তাঁর মা বা স্ত্রীর নয়। রাফসান বলেন, ‘একজন মানুষ নিজের খাবার নিজে তৈরি করতে না পারা, নিজের কাপড় ধুতে না পারা, অন্যের ওপর নির্ভরশীল হয়ে থাকায় গর্বের কিছু নেই। বরং আমি এতে কিছুটা লজ্জাই পাই। আমি মনে করি আমার স্ত্রীর দায়িত্ব নয় আমার সব কাজ করে দেওয়া। বরং আমাদের দুজনের দায়িত্ব আমাদের সংসারটা চমৎকারভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া।’

ছোটবেলাতেই স্বাবলম্বী হওয়ার শিক্ষা

অভিনেত্রী আজমেরি হক বাঁধন জানালেন তাঁর আট বছরের মেয়েকে অনেক আগে থেকে দায়িত্বশীল হতে শিখিয়েছেন তিনি। তাঁর ছোট্ট মেয়েটি নিজের হাতে খায়, খেয়ে প্লেট ধুয়ে রাখে, এমনকি বাসায় পরার কাপড়ও সে গোসল করে ধুয়ে আনে। নিজের খেলনাগুলো গুছিয়ে রাখে। পড়া শেষ করে টেবিলটাও সে গোছায় একেবারে তার মনের মতো করে। ঘরের কোনো কিছুই এলোমেলো করে না সে। বাসার বয়স্ক মানুষের ওষুধ খাওয়ানোর বিষয়ও নজরে রাখে ছোট্ট মেয়েটি।

অভিনেত্রী বাঁধন ছোটবেলা থেকেই তাঁর মেয়ে সায়রাকে ঘরের নানা কাজ শেখাচ্ছেন। যাতে বড় হয়ে মেয়ে একা একাই সব কাজ করতে পারে। বাসায় নিজেদের কাজের সময়ের ছবি পাঠিয়েছেন অধুনার জন্য

নিজের কাজ নিজে করে নিতে হয় এবং সব কাজ শিখতে হয় চার–পাঁচ বছর বয়স থেকেই—মেয়ের মধ্যে এমন বোধ দিয়েছেন বাঁধন। তাই ঘরবন্দী এই সময়ে মেয়ের সঙ্গে চমৎকার সময় কাটছে তাঁর। তিনি বলেন, ‘একদম ছোট থেকেই ওকে সব কাজে নিতাম, যাতে ওর মধ্যে এই বোধ হয় যে ও আমাকে সাহায্য করছে। ও যেন দায়িত্বশীল হয়। আমার যদি ছেলে থাকত, তাকেও আমি একই শিক্ষাই দিতাম। আসলে একদম ছোট থেকে সন্তানদের (ছেলে–মেয়ে যে–ই হোক) দায়িত্ব শিখিয়ে বড় করতে হয়। তাহলে কখনো একা থাকতে হলে বা সংসারজীবনে বিপদে পড়বে না সে।’

প্রয়োজনটা ভবিষ্যতের জন্যই

যেমনটা করেন সোমা আর জসিম দম্পতি। দুই কিশোর ছেলেকে পরিস্থিতি খুব সুন্দর করে বুঝিয়েছেন তাঁরা। সন্তানেরা এখন অনেক কিছু করতে পারে। প্রতিদিন বড় ছেলের দায়িত্ব ঘর পরিষ্কার করা। এক ছেলে থালাবাসন ধুয়ে দেয়। জসিম নিজে কাটাকুটি করে দেন, বাজার করেন। সোমা জানান, এখন তো বাড়তি কাজ যুক্ত হয়েছে ঘরবাড়ি জীবাণুমুক্ত করার বিষয়টি। ছেলেরা এই দায়িত্ব খুবই মনোযোগ দিয়ে পালন করে। বাবা অফিস থেকে বাসায় আসার সঙ্গে সঙ্গে দরজার হাতল, মেঝে পরিষ্কার করে তারা।

অভিনেত্রী বাঁধন ছোটবেলা থেকেই তাঁর মেয়ে সায়রাকে ঘরের নানা কাজ শেখাচ্ছেন। যাতে বড় হয়ে মেয়ে একা একাই সব কাজ করতে পারে। বাসায় নিজেদের কাজের সময়ের ছবি পাঠিয়েছেন অধুনার জন্য

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক তানজির আহম্মেদ বললেন, আমাদের মধ্যে সামাজিকভাবে একটা ভুল ধারণা প্রচলিত আছে যে ঘরের কাজ নারীদের। এখন সংসার মানে দুজন মানুষের, সঙ্গে সন্তান। আগের ধারণার সঙ্গে খাপ খাওয়ানো যাবে না। সংসারের কাজের ক্ষেত্রে নারী–পুরুষ নেই। সবাইকে সব করতে জানতে হবে। কারণ, নানা দরকারে নানা সময়ে কাজ জানার প্রয়োজন হবে।

জানতে হবে নিজের কাজ

করোনা প্রাদুর্ভাবের এই দুঃসময় সারা জীবন থাকবে না। পরবর্তী যে সময় আসবে, তখনো ঘরের কাজ, নিজের কাজগুলো জানার প্রয়োজন হবে। ভুল ধারণা নিয়ে যদি পুরুষ বসে থাকে, তবে সে ক্ষতির মুখে পড়বে। আসলে একটি সংসারে সবাই যদি মিলেমিশে কাজ করে, তবে সম্পর্ক ভালো হয়—এমনটাই দেখা যায় বাস্তবে। বাচ্চাদের সঙ্গে ভালো বন্ধন তৈরি হয়। আনন্দদায়ক বিষয়গুলো ভাগ করে নেওয়া যায়। একজন খেটেই যাচ্ছেন, সবাই বসে আছে—এমন সংসারের বন্ধন ভালো হয় না। তাই তো সমাজবিজ্ঞানীরা মনে করেন, সন্তানদের সব কাজ শেখাতে হবে। সন্তানকে সব ক্ষেত্রে দক্ষ করে গড়ে তোলা মা–বাবার দায়িত্ব। কারণ, বর্তমান বিশ্বে কখন কার কী প্রয়োজন হয়, তার জন্য প্রস্তুত থাকা উচিত। সন্তান যেন উদ্ভূত পরিস্থিতিতে তাল না হারিয়ে ফেলে। তাকে সংসারের কাজটা বুঝতে হবে, শিখতে হবে। এতে জীবন চলার পথে তাকে ঠকতে হবে না।