স্থলবন্দর ও শুল্ক স্টেশনের তথ্য অনুযায়ী, গেল অর্থবছরে আগের তুলনায় আমদানি কমেছে ৫২ শতাংশ। আমদানি কমলেও আমদানি ব্যয় ছিল আগেরবারের তুলনায় ১৫৫ কোটি টাকা বেশি।
গত বছরের ২৯ সেপ্টেম্বর থেকে গত মার্চের মাঝামাঝি পর্যন্ত ভারত থেকে পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ ছিল। এ সময় দেশে প্রতি কেজি সর্বোচ্চ ২৫০ টাকায় পেঁয়াজ বিক্রি হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে পেঁয়াজ আমদানিতে ব্যয় হয় ১ হাজার ৭৮২ কোটি টাকা।
ভারতীয় আর দেশি পেঁয়াজই ছিল রসুইঘরের চেনা পণ্য। বেশির ভাগ সময় দামও ছিল কম। বহু বছরের এই চেনা চিত্র ছিল না অন্তত সাড়ে পাঁচ মাস। ভারত রপ্তানি না করায় এ সময়ে উড়োজাহাজ, জাহাজ আর ট্রলারে করে আনা হয় ৯ দেশের পেঁয়াজ। দাম বেশি বলে খরচ সমন্বয় করতে কেজির বদলে এক-দুটি বা হালি পেঁয়াজও কিনেছেন অনেক ক্রেতা। অর্থবছর শেষে দেখা গেল, কম খেয়েও বেশি খরচ করতে হয়েছে। আমদানি ব্যয়ও হয়েছে বেশি।
স্থলবন্দর ও শুল্ক স্টেশনের তথ্য অনুযায়ী, গেল অর্থবছরে আগের তুলনায় আমদানি কমেছে ৫২ শতাংশ। আমদানি কমলেও আমদানি ব্যয় ছিল আগেরবারের তুলনায় ১৫৫ কোটি টাকা বেশি। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে পেঁয়াজ আমদানিতে ব্যয় হয় ১ হাজার ৭৮২ কোটি টাকা। শুল্ক স্টেশনের তথ্য অনুযায়ী, গেল অর্থবছরে পেঁয়াজ আমদানিতে ব্যয় হয়েছে ১ হাজার ৯৩৭ কোটি টাকা। আমদানি ব্যয়ের মতো খুচরা পর্যায়েও ক্রেতাকে খরচ করতে হয়েছে আরও বেশি।
গত বছরের ২৯ সেপ্টেম্বর থেকে গত মার্চের মাঝামাঝি পর্যন্ত ভারত থেকে পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ ছিল। এ সময় দেশে প্রতি কেজি সর্বোচ্চ ২৫০ টাকায় পেঁয়াজ বিক্রি হয়। ক্রেতার পকেট কাটা গেলেও সংকটের সময়জুড়ে দেশে উৎপাদিত পেঁয়াজ বেচে ভালো দাম পেয়েছেন কৃষক। ফলনও বেড়েছে। ভারতের বিকল্প আমদানির নতুন নতুন বাজারও তৈরি হয়েছে। অবশ্য রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা তুলে দেওয়ার পর দেশটি থেকে আবার পুরোদমে আমদানি শুরু হয়েছে।
সংকট থেকে শিক্ষণীয় অনেক কিছুই আছে। দেশে উৎপাদিত পেঁয়াজের ভালো সরবরাহ থাকে মার্চ থেকে আগস্ট পর্যন্ত। বছরের বাকি সময় আমদানির ওপর নির্ভরশীলতা বেশি। এবারের মতো যাতে আর সংকট তৈরি না হয়, তাই এ সময় (আগস্টের শেষ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত) ভারতে পেঁয়াজ উৎপাদনে সমস্যা হচ্ছে কি না, তা খেয়াল রাখা উচিত।নাজনীন আহমেদ, জ্যেষ্ঠ গবেষক, বিআইডিএস
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) জ্যেষ্ঠ গবেষক নাজনীন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, সংকট থেকে শিক্ষণীয় অনেক কিছুই আছে। দেশে উৎপাদিত পেঁয়াজের ভালো সরবরাহ থাকে মার্চ থেকে আগস্ট পর্যন্ত। বছরের বাকি সময় আমদানির ওপর নির্ভরশীলতা বেশি। এবারের মতো যাতে আর সংকট তৈরি না হয়, তাই এ সময় (আগস্টের শেষ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত) ভারতে পেঁয়াজ উৎপাদনে সমস্যা হচ্ছে কি না, তা খেয়াল রাখা উচিত। আবার বিকল্প বাজার থেকে আমদানি এবং পেঁয়াজ সংরক্ষণের আধুনিক ব্যবস্থায় নজর দেওয়া উচিত। তাহলে সংকট হলেও খুব বেশি দামে পেঁয়াজ খেতে হবে না।
দেশে পেঁয়াজের উৎপাদন বাড়লেও চাহিদা বাড়ছে তার চেয়ে বেশি। এতে প্রতিবছর পেঁয়াজ আমদানি বাড়ছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবে, বছরে চাহিদার ৩০ থেকে ৩৪ শতাংশ পেঁয়াজ আমদানি করতে হয়। কম দাম ও কম সময়ে আনা যায় বলে ভারত থেকেই পেঁয়াজ আমদানি হয়। এতে বছরে গড়ে দুই হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়।
কৃষকের সুরক্ষা
পেঁয়াজ–সংকটের সময় দেশে উৎপাদনের মৌসুমে আমদানিতে শুল্ককর বাড়িয়ে কৃষকদের স্বার্থ সুরক্ষার কথা বলা হয়। গত মার্চের মাঝামাঝি ভারত যখন রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে, তখন দেশে উৎপাদনের ভরা মৌসুম। ফলে সংকটের সময় কৃষক ভালো দাম পেলেও পড়ে যায় পেঁয়াজের বাজার। অবশ্য জুনে বাজেটে পেঁয়াজ আমদানিতে ৫ শতাংশ শুল্ককর আরোপ করে। পেঁয়াজের আমদানি মূল্য অনুযায়ী, কেজিপ্রতি পেঁয়াজ আমদানিতে শুল্ককরের পরিমাণ এক টাকারও কম।
সংকটের সময় বিকল্প দেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানিতে শীর্ষ স্থানে ছিল বিএসএম গ্রুপ। গ্রুপটির চেয়ারম্যান আবুল বশর চৌধুরী গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ৫ শতাংশ শুল্ককর দিয়ে কৃষকের স্বার্থ সুরক্ষা হবে না, বরং আন্তর্জাতিক বাজারে দরদাম বিবেচনায় নিয়ে বছরে কয়েকবার শুল্ককর পরিবর্তন করা উচিত। এমনভাবে তা করা উচিত, যাতে কৃষকদের স্বার্থ যেমন সুরক্ষা হয়, তেমনি সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকে পেঁয়াজের দাম।
সংকট চেনাল বিকল্প বাজার
ভারতের কৃষি ও প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য রপ্তানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৮৮ সাল থেকে মূলত ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানির ওপর নির্ভরশীল হতে শুরু করে বাংলাদেশ। সে সময় থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত বছরে ৬০ হাজার টনের মতো পেঁয়াজ আমদানি করত বাংলাদেশ।
২০০৩-০৪ (এপ্রিল-মার্চ) সময়ে ভারতের পেঁয়াজ রপ্তানির শীর্ষ দেশের তালিকায় ছিল বাংলাদেশের নাম। ১৭ বছর ধরে এই শীর্ষ স্থানে ছিল বাংলাদেশ। গত বছর ভারত রপ্তানি বন্ধের পর দেশের মোট আমদানির ৪০ শতাংশ আসে বিকল্প বাজার থেকে।
২০০৩-০৪ (এপ্রিল-মার্চ) সময়ে ভারতের পেঁয়াজ রপ্তানির শীর্ষ দেশের তালিকায় চলে আসে বাংলাদেশের নাম। ১৭ বছর ধরে শীর্ষ স্থান থেকে সরেনি। সর্বনিম্ন ৯৫ শতাংশ থেকে সর্বোচ্চ প্রায় শতভাগ পেঁয়াজই আমদানি হতো ভারত থেকে।
গত বছর ভারত রপ্তানি বন্ধের পর বিকল্প বাজার খুলে যায়। মোট আমদানির ৪০ শতাংশ আসে বিকল্প বাজার থেকে। তবে এখন আবার বিকল্প বাজার থেকে আমদানি হচ্ছে না। এরপরও বিকল্প বাজারের মধ্যে সবচেয়ে কম সময়ে এবং কম দামে আমদানির সুযোগ আছে মিয়ানমার থেকে। সংকটের সময় এই দেশ থেকে মোট আমদানির ২৪ শতাংশ আমদানি হয়েছিল। ভারতের পাশাপাশি এই বাজারও সরবরাহ বাড়ানোর ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারে বলে ব্যবসায়ীরা জানান।