কিশোরী বেড়ে উঠুক থাকুক উচ্ছলতায়
কিশোরী বেড়ে উঠুক থাকুক উচ্ছলতায়

কন্যাশিশুর অভিভাবকদের বলছি

ভাইঝির কাছে গল্প করেছিলাম। পাহাড়ি পথ পেরিয়ে উদ্দাম ঝরনা দেখার ‘মেয়েজীবন’-এর গল্প। পাঠক হয়তো ভাবছেন, পারিবারিক আলাপচারিতা জেনে কী লাভ? ক্রমশ প্রকাশ্য, পাঠক। প্রসঙ্গটা যে মনে পড়ল এই লেখার কাজ করতে গিয়েই।

নারীজীবনের অবিচ্ছেদ্য এক স্বাভাবিক বিষয়ের গল্প, অদম্য গতিতে এগিয়ে চলা কোটি কোটি মেয়ের গল্প। নির্দিষ্ট বয়স পেরোনোর পর থেকে প্রত্যেক মেয়ের প্রতিটি মাসের নির্দিষ্ট কয়েকটি ‘বিশেষ’ দিনের গল্প। এ দেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে একটি মেয়ের প্রথম মাসিক হওয়ার অভিজ্ঞতাটি অনেক ক্ষেত্রেই বেশ ভীতিকর হয়। তবে অভিভাবক ইতিবাচকভাবে বিষয়টিকে উপস্থাপন করলে মেয়েটির জন্য তা গ্রহণ করা সহজ হবে, জীবনের পথে একে প্রতিকূলতা মনে করবে না সে। এমনই ইতিবাচক পরামর্শ দিলেন ঢাকা শিশু হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডা. সারাবন তহুরা।

কীভাবে বলবেন, কখন বলবেন

অভিভাবকেরা ভাবতে পারেন, এসব কথা কীভাবে বলা যায় কন্যাকে? সাধারণত ১১-১২ বছর বয়সে মাসিক শুরু হয়। এই বয়সী মেয়েদের মাসিক হওয়ার আগেই বিষয়টি খুব স্বাভাবিকভাবে তার সঙ্গে আলাপ করে রাখতে পারেন। আজকাল এই বয়সের আগেই মাসিক শুরু হতে দেখা যাচ্ছে। সে ক্ষেত্রে অবশ্য প্রথম মাসিকের আগে এ প্রসঙ্গে বললে শিশু বিষয়টি বুঝতে পারবে না।

যখন আলাপ করা হবে, উপস্থাপন হতে হবে একেবারে স্বাভাবিক ও স্বচ্ছন্দ। শিশু বড় হচ্ছে, তার হাত-পা, চুল বড় হচ্ছে। এসব পরিবর্তনের মতো এটিও স্বাভাবিক। শিশুর মা, খালা, নানি তো বটেই, কয়েক বছরের বড় বোনটিকেও যে এই অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয় এবং এ জন্য যে কারও জীবন থেমে থাকে না, সেটাই তাকে বোঝাতে হবে। মায়ের সঙ্গে বোন (খালাতো-চাচাতো হলেও) উপস্থিত থাকতে পারে এই আলাপচারিতায়, বলতে পারেন নিজের অভিজ্ঞতার কথা। ‘কাউকে বলা যাবে না’—এমন ধারার কথায় ভীতি আর দ্বিধা জন্মাবে। আবার বাইরে থেকে মামা-চাচা কিংবা অন্য কেউ এলে তার সামনে আলাপ করলেও শিশু অস্বস্তিতে পড়বে। বিষয়টি ব্যক্তিগতই থাকুক, কিন্তু বাবা বা বড় ভাইয়ের মতো আপনজনের থেকে লুকানোর প্রয়োজন নেই—এভাবেই বোঝান শিশুকে।

আমি কি তবে ‘বঞ্চিত’

পিরিয়ডের পর ‘এমন কেন হলো আমার সঙ্গে?’ এমন কোনো ভাবনা যেন আসতে না পারে শিশুমনে। মাসিক শুরু হলেই মেয়েদের স্বাধীনতা হরণের প্রবণতা রয়েছে কোথাও কোথাও। এতে শিশু গুটিয়ে যায় নিজের মধ্যে, বিকশিত হতে পারে না স্বাভাবিকতায়। তাই মাসিকের অজুহাতে কোনো কাজে বাধা দেবেন না। খেলাধুলা-পড়ালেখা-দৌড়ঝাঁপ চলুক পুরোদমে। হয়তো ওই সময় ঘুরতে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল। কন্যার মাসিক হয়েছে বলে তা পিছিয়ে দেবেন না। আর অবশ্যই নিশ্চিত করুন সুষম খাবারদাবার। কোনো খাবার খেতে নিষেধ করবেন না মাসিকের জন্য। বরং এই দিনগুলোতে একটু বাড়তি খাবার এবং তার পছন্দের খাবার দিলে নিজেকে বঞ্চিত নয়, ‘সুবিধাপ্রাপ্ত’ ভাবতে পারে সে। খেয়াল করুন, শিশু যেন পানি পান করে পর্যাপ্ত। সবার সঙ্গে বসে খেতে বাধা দেবেন না।

শারীরিক সুস্থতায় আরও যা

কাপড়ের মতো অস্বাস্থ্যকর ব্যবস্থা নয়, বরং স্যানিটারি ন্যাপকিন বেছে নিতে উৎসাহিত করুন। কোনো অবস্থাতেই যেন ৬ ঘণ্টার বেশি সময় একই ন্যাপকিন না রাখা হয়। ন্যাপকিন বদলানোর সময় নিজেকে পরিষ্কার রাখার নিয়ম, পরিষ্কারের পর স্থানটি শুকনা রাখা শেখানোর পাশাপাশি সঠিকভাবে ন্যাপকিন ফেলার পদ্ধতিও শেখান। প্রয়োজনে সাহায্য করুন। একটু ছোটদের জন্য ‘ডিসপোজেবল প্যান্টি’ বেছে নেওয়া ভালো, ব্যবহার শেষে যা পুরোটাই ফেলে দেওয়া হয়। মাসিকের সময় কোনো সমস্যাই (পেটব্যথা, চুলকানি, প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া, অধিক রক্তক্ষরণ প্রভৃতি) শিশু যেন না লুকায়। প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।

সামাজিক পরিসরে

স্কুলব্যাগে ছোট একটি কিট বক্স রেখে দিন, যাতে হঠাৎ প্রয়োজনে মেয়েটি বিব্রতকর পরিস্থিতিতে না পড়ে। মেয়েটির প্রথম মাসিক স্কুলে হলে শিক্ষকদের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ক্লাসে কোনো মেয়েশিশু অস্বস্তি বোধ করলে অবশ্যই একজন নারী শিক্ষককে বিষয়টিতে যুক্ত থাকতে হবে। এ দেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটের দাবি এটি। কোনো অবস্থাতেই যাতে কারও মাসিক নিয়ে হাসাহাসি-কানাকানি না হয়। ক্লাসের সবার সামনে কথা না বলে আলাদা করে বলুন। আর জাতীয় পর্যায়ে মীনা কার্টুনের মতো জনপ্রিয় কোনো মাধ্যমকে কাজে লাগিয়ে সচেতনতা সৃষ্টি করা তো সময়ের দাবি।