কচুরিপানা, পাটে নারীর প্যাড

অলংকরণ: অপরাজিতা রহমান
অলংকরণ: অপরাজিতা রহমান

পিরিয়ড বা মাসিক নিয়ে সমাজে প্রচলিত বিভিন্ন ‘ট্যাবু’ আস্তে আস্তে ভাঙছে। তবে মাসিক ব্যবস্থাপনাকে নারী ও পরিবেশবান্ধব করার ক্ষেত্রে উদ্যোগের ঘাটতি আছে। এই ঘাটতি দূর করতে প্লাস্টিক ব্যবহার না করে কচুরিপানা ও পাট দিয়ে স্যানিটারি ন্যাপকিন তৈরিতে এগিয়ে এসেছেন নারীরা।

মাসিকের কারণে বাংলাদেশের স্কুলছাত্রীদের ক্লাসে অনুপস্থিতির তথ্য নিয়ে গত বছর ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নালে ‘ম্যান্সট্রুয়াল হাইজিন ম্যানেজমেন্ট অ্যামং বাংলাদেশি অ্যাডলোসেন্ট স্কুল গার্লস অ্যান্ড রিস্ক ফ্যাক্টরস অ্যাফেক্টিং স্কুল অ্যাবসেন্স: রেজাল্টস ফ্রম আ ক্রস-সেকশনাল সার্ভে’ শীর্ষক নিবন্ধে বলা হয়, মাসিকের কারণে দেশের ৪১ শতাংশ মেয়ে শিক্ষার্থী মাসে গড়ে প্রায় তিন দিন স্কুলে অনুপস্থিত থাকে। প্রায় ৯৯ শতাংশ শিক্ষার্থীই মাসিকের সময় স্কুলে অস্বস্তিতে ভোগে।

আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) সহকারী বিজ্ঞানী ফারহানা সুলতানা জানান, দেশের বর্জ্য ব্যবস্থাপনাও যথেষ্ট উন্নত না। এ ছাড়া এখন পর্যন্ত বাজারে যেসব প্যাড বিক্রি হচ্ছে, তার বেশির ভাগই পরিবেশবান্ধব না। ফলে, ব্যবহৃত প্যাড নিয়ে একধরনের ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।

তৈরি হবে পাটের প্যাড, হাতের স্পর্শ ছাড়া কাপড় পরিষ্কার

মাসিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে বিভিন্ন কার্যক্রমের মূল অনুসন্ধানকারীর দায়িত্ব পালন করছেন আইসিডিডিআরবির বিজ্ঞানী ফারহানা সুলতানা। প্লাস্টিকের ব্যবহার কমিয়ে পাট দিয়ে প্যাড তৈরিতে এক প্রকল্পের জন্য ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের পক্ষ থেকে এক লাখ মার্কিন ডলার (প্রায় ৮৪ লাখ টাকা) মূল্যমানের পুরস্কার জিতেছেন তিনি।

ফারহানা জানালেন, প্রকল্পটি প্রাথমিক পর্যায়ে আছে। ভারতের একটি গবেষণার তথ্য তুলে ধরে তিনি বলেন, বাজারে বাণিজ্যিকভাবে যেসব স্যানিটারি প্যাড বিক্রি হয়, তাতে ৩ দশমিক ৪ গ্রাম প্লাস্টিক থাকে। জীবনব্যাপী একজন নারী প্যাড ব্যবহার করলে প্লাস্টিকের পরিমাণ দাঁড়াবে ২৩ কিলোগ্রাম, যা মাটির সঙ্গে মিশে যেতে সময় লাগবে ৫০০ থেকে ৮০০ বছর।

পাট দিয়ে প্যাড তৈরির আগে থেকেই মাসিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে কাজ করছেন ফারহানা সুলতানা ও তাঁর দল। এ দলের শিক্ষানবিশ গবেষক মেহজাবিন তিশান মাহফুজ জানালেন, স্কুলে শিক্ষার্থী কেন অনুপস্থিত থাকে, তা জানার জন্য ২০১৬ সালে ঢাকা এবং মানিকগঞ্জের চারটি স্কুলে আঙুলের ছাপ নেওয়ার ডিভাইস দেওয়া হয়। স্কুলে আসার পর হঠাৎ মাসিক শুরু হলে স্যানিটারি প্যাড দেওয়া হয়। এতে দেখা যায়, মেয়েদের মধ্যে স্কুলে অনুপস্থিতি উল্লেখযোগ্য মাত্রায় কমেছে।

ফারহানা সুলতানা ও নাজিবা নায়লা ওয়াফা

এর পরের ধাপ সম্পর্কে মেহজাবিন তিশান জানালেন, রাজধানীর বাউনিয়া বাঁধে নারী ও কিশোরীদের মাসিকের জন্য ব্যবহৃত কাপড় ধোয়া ও শুকানো নিয়ে অস্বস্তি দূর করতে কালো রঙের ব্যাগের ভেতরে কাপড়টি ধোয়ার বিশেষ ব্যবস্থা করা হয়েছে। এতে করে সরাসরি হাতের স্পর্শ ছাড়াই কাপড় ধোয়া যাবে। একইভাবে ধোয়ার পর বিশেষ কায়দায় বানানো একটি ব্যাগে ভরে তা অন্যান্য কাপড়ের সঙ্গে রোদে শুকানো যাবে।

সম্প্রতি বাউনিয়া বাঁধে রোখসানা বেগম বললেন, মাসিকের কাপড় এখন বাইরে রোদে শুকাতে দেন, বৃষ্টি থাকলে ঘরের ভেতরেই ছড়িয়ে রাখতে পারেন।

কচুরিপানার প্যাড, বাংলাদেশি তরুণী পুরস্কৃত

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএর শিক্ষার্থী নাজিবা নায়লা ওয়াফা কচুরিপানা দিয়ে প্যাড তৈরির একটি পাইলট প্রকল্প চালাচ্ছেন।

নাজিবা জানালেন, কেনিয়াতে জানিপ্যাড নামক একটি কোম্পানি কচুরিপানা দিয়ে প্যাড বানাত। সেখান থেকে প্রাথমিক ধারণা নিয়ে কাজ শুরু করতে করতে কোম্পানিটিই বন্ধ হয়ে যায়। পরে রাজধানীর ধোলাইখাল থেকে স্টেরিলাইজার মেশিন, প্যাড বানানোর ছোট মেশিন কেনা হয়। মোহাম্মদপুরে জেনেভা ক্যাম্পের ১০ জন নারীকে প্যাড বানানোর প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। ক্যাম্পের দুই হাজার নারী এই প্যাড ব্যবহার করেন। হাজারীবাগ বস্তিতেও চার মাসের একটি পাইলট প্রকল্প চালানো হয়।

রাজধানীর বাউনিয়া বাঁধে বিশেষভাবে তৈরি ব্যাগে মাসিকের কাপড় শুকাচ্ছেন এক নারী। ছবি: সাবরিনা ইয়াসমীন

নাজিবা জানালেন, কচুরিপানা শুকিয়ে, ব্লেন্ডারে গুঁড়া করে মাঝে ও ওপরে তুলা দিয়ে বিশেষ কায়দায় বানানো প্যাড তিনিসহ দলের আরও দুই নারী ব্যবহার করেন। ব্যবহারের দুই সপ্তাহের মধ্যে প্যাড মাটির সঙ্গে মিশে যায়। তবে এ প্যাড ব্যবহারে কিছু সমস্যাও চিহ্নিত করা হয়। পড়াশোনা শেষ না করে এ কাজে তেমন সময় দিতে পারছেন না বলে তা ধীর গতিতে চলছে।

আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী উদ্যোক্তা পুরস্কার (জিএসইএ) বাংলাদেশ পর্বের জন্য উদ্যোক্তাদের সংগঠন ইও-বাংলাদেশ আয়োজিত প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হয়েছিলেন নাজিবা নায়লা ওয়াফা। এরই ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি চীনে অনুষ্ঠিত ‘সোশ্যাল ইমপ্যাক্ট’ ক্যাটাগরিতে বিজয়ী হয়েছেন, যা বাংলাদেশ থেকে প্রথম।